- বিশেষ আয়োজন
- বাংলাদেশ: রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রভাষা
বাংলাদেশ: রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রভাষা

১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তার পরেই বিদেশি সব ভাষাকে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রেখে রাষ্ট্রব্যবস্থার সব স্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের চেষ্টা চালানো হচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতিও সাধিত হচ্ছিল। বাংলা ভাষার এই অগ্রগতি সূচিত হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনাকালেই।
কিন্তু কালক্রমে সে-চেষ্টায় ব্যত্যয় ঘটিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা থেকে অপসারিত করে নিছক মাতৃভাষায় সীমাবদ্ধ করে ফেলার ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। বাংলা ভাষার প্রতি শাসক শ্রেণির লোকদের যে মনোভাব দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয়, চার দশক সময়ও লাগবে না, বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হবে। সংবিধানে যাই লেখা থাকুক, বাস্তবে এটাই ঘটে চলছে। জানি না, পাঠক আমার সঙ্গে একমত হবেন কিনা, তবে বিচার-বিবেচনার পর আমি নিঃসংশয়ে এটাই অনুভব করি।
দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্থলাভিষিক্ত করা হচ্ছে ইংরেজি ভাষাকে। সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন, আমলাগোষ্ঠী, এনজিওপতি, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা, কথিত বিশিষ্ট নাগরিকরা এ কাজটি করে চলছেন।
বাংলা ভাষার রাষ্ট্রভাষা থেকে মাতৃভাষায় অবনয়ন এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্থলে ইংরেজি ভাষার প্রতিষ্ঠা- এই প্রক্রিয়া কি আমাদের রাষ্ট্র, জাতি ও জনজীবনের জন্য কল্যাণকর হচ্ছে? আমরা কোন গন্তব্যের দিকে যাচ্ছি? রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করা এবং বাংলা ভাষার উন্নতি ও ব্যাপ্তিতে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা কি আমাদের কর্তব্য নয়? বাংলাদেশের বিবেকবান, চিন্তাশীল, সৃষ্টিপ্রয়াসী, প্রগতিপ্রয়াসী প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য এ বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা, বিচার-বিবেচনাপূর্বক সিদ্ধান্তে পৌঁছা এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য জনমত গঠন করা ও সরকারকে জানানো।
মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষার মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে হবে। এই যে ফেব্রুয়ারি মাস চলছে, এ মাসে প্রতিদিন মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষাকে একাকার করে এতসব লেখালেখি, টকশো, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও অনুষ্ঠান হচ্ছে যে, লোকে যুক্তিসিদ্ধ কিংবা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চিন্তা করতে পারছে না। প্রচারমাধ্যম এত দ্রুতগতিতে কাজ করে যাচ্ছে যে, কারও মনে গতানুগতিক ধারণার বাইরে কোনো ধারণাকেই দানা বেঁধে উঠতে দিচ্ছে না। সংস্কৃতির নামে বিনোদনের স্রোতে প্রায় সকলেই ভেসে চলছেন।
মাতৃভাষা থেকেই জাতীয় ভাষা ও রাষ্ট্রভাষার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। তবে মাতৃভাষা, জাতীয় ভাষা ও রাষ্ট্রভাষা এক নয়। প্রতিটিরই স্বাতন্ত্র্য আছে। মাতৃভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্র তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র- মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর পরিমণ্ডল। ব্যক্তিগত আলাপ, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র লেখা, গান শোনা, কবিতা পড়া, নাটক দেখা, গল্প-উপন্যাস পড়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে লোকে মাতৃভাষা পছন্দ করে।
তবে এসব ক্ষেত্রে প্রমিত ভাষা ব্যবহূত হয়। প্রমিত ভাষা হলো মাতৃভাষারই উন্নত ও পরিশ্রুত রূপ; যাকে জাতীয় পর্যায়ে সকলে শুদ্ধ, সুন্দর, প্রয়োজনীয় বলে মেনে চলে। শিক্ষা ও পাণ্ডিত্যের আশ্রয়ে ভাষার প্রমিত রূপ গড়ে তোলা হয়। জাতীয় পর্যায়ে ব্যবহূত ও সবার বোধগম্য প্রমিত ভাষাই জাতীয় ভাষা। জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও কার্যক্ষেত্রে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জাতীয় ভাষার বিকাশ ঘটে। মানবশিশু স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবেই মাতৃভাষা শিখে নেয়। কিন্তু প্রমিত ভাষা কিংবা জাতীয় ভাষা অর্জনের জন্য তাকে আয়াসসাধ্য শিক্ষা ও চর্চার প্রক্রিয়া পার হতে হয়। জাতীয় ভাষা দ্বারা জাতির অন্তর্গত সব কাজই সম্পন্ন হতে পারে। রাষ্ট্রের বেলায় উপজাতি, জাতি (nation)-মহাজাতি থাকতে পারে এবং তাদের ভাষার অবস্থাও বিভিন্ন রকম হতে পারে। জাতীয় ভাষা ও রাষ্ট্রভাষা এক হতে পারে, আলাদাও হতে পারে। যেমন- ভারতে বাংলা, হিন্দি, পাঞ্জাবি, মারাঠি, গুজরাটি, উড়িয়া, অসমিয়াসহ পনেরোটি ভাষা সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত এবং এগুলোর মধ্যে হিন্দি রাষ্ট্রভাষা। প্রতিটি ভাষারই প্রমিত রূপের বাইরে আছে নানা আঞ্চলিক রূপ। উপজাতির ভাষা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা, আঞ্চলিক ভাষা, জাতীয় ভাষা, প্রমিত ভাষা, রাষ্ট্রভাষা ইত্যাদি এক করে দেখলে ক্ষতি হয়। বিকাশমান ভাষা এবং বিলীয়মান ভাষা আছে। ভাষাবিষয়ক এ সবকিছু সম্পর্কেই শিক্ষিত লোকদের পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকা দরকার। প্রমিত ভাষা, রাষ্ট্রভাষাকে বিকশিত করতে হয়; বিশৃঙ্খল করতে হয় না।
বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছিল এই সংকল্প নিয়ে যে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রশাসন ব্যবস্থার সব কাজ বাংলা ভাষায় করা হবে, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সব পর্যায়ে বাংলা ভাষা ব্যবহূত হবে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সব কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হবে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে- সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত- এবং গবেষণায় বাংলা ভাষা অবলম্বন করা হবে। সেই সঙ্গে ভাবা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক; আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চ পর্যায়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে লেনদেন-ভাববিনিময় ইত্যাদিতে প্রয়োজন অনুযায়ী ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষা ব্যবহার করা হবে। ভাবা হয়েছিল, উৎকৃষ্ট শিক্ষা এবং উন্নত গবেষণার ব্যবস্থা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে করা হবে। বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত অল্প কয়েকটি ভাষার একটিতে উন্নীত করার আশা ও চিন্তা আমাদের জাতির মধ্যে ছিল।
সব শিক্ষার্থীর ইংরেজি ভাষা শেখায় জোর দিতে গিয়ে মানবীয় শক্তির যে অপচয় হচ্ছে, তা রোধের কথাও সেদিন চিন্তা করা হয়েছিল। চিন্তা করা হয়েছিল, বাংলাদেশের প্রয়োজনে পৃথিবীর সব ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এবং বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর সব ভাষায় পুস্তকাদি অনুবাদের বিপুল ব্যবস্থা করা হবে। চলমান ঘটনাবলি এবং চলমান চিন্তার বিষয়গুলোও অন্য ভাষা থেকে বাংলায় এবং বাংলা ভাষা থেকে অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ ও প্রচার করার কথাও তখন ভাবা হয়েছিল। বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় উন্নতির বিপুল সম্ভাবনা তখন অনুভূত হয়েছিল। ধরে নেওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশ উন্নতির ধারায় চলবে এবং গোটা পৃথিবী বাংলাদেশের দিকে প্রসন্ন দৃষ্টি দিয়ে তাকাবে।
ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান আমলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ভাষা ছিল বাংলা। ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার আন্দোলন এবং নতুন সাহিত্য সৃষ্টির অবলম্বন হওয়ার ফলে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষার অভাবনীয় উন্নতি হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেও বাংলা ভাষার সেই গতি অব্যাহত ছিল এবং তাতে নতুন বেগ সঞ্চারিত হয়েছিল। সব পর্যায়ে সরকারি অফিস, বাংলা একাডেমি এবং অন্য সব প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অল্প সময়ের মধ্যে বাংলা মাধ্যমে অনেক উন্নতি হয়েছিল। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অল্প সময়ের মধ্যে বাংলা প্রচলনে অসাধারণ উন্নতি সাধন করেছিল। উচ্চশিক্ষা ও উচ্চতর গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং বাংলায় উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজ বেগবান হয়েছিল। দু-তিন বছরের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাংলা পড়তে এবং বাংলা পরীক্ষা দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আশা করা হয়েছিল, ক্রমে সর্বস্তরে বাংলা মাধ্যমে শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অপরদিকে বাংলার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে, বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও উচ্চতর গবেষণার ক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষাকে উন্নততর করার চিন্তাও ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ায় এবং দুর্নীতি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে অচিরেই বাংলা ভাষার অগ্রযাত্রা বিঘ্নসংকুুল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে বাংলা শিক্ষা, ইংরেজি শিক্ষা, সাধারণভাবে সব পর্যায়ে সব ধারার শিক্ষা দুর্গতিতে পড়ে গেল। বর্তমানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে নতুন পাঠ্যসূচি, পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তনের যে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে, তাতেও নতুন জটিলতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। উন্নতির সম্ভাবনা সামান্যই দেখা যাচ্ছে।
আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য আর ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদ্দেশ্য এক নয়। এর দ্বারা আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছে।
বাংলা ভাষার উন্নতি এবং বাংলাদেশের উন্নতি অবিচ্ছেদ্য। বাংলা ভাষার উন্নতি ছাড়া বাংলাদেশের উন্নতি হবে না। বাংলাদেশের উন্নতি ছাড়া বাংলা ভাষার উন্নতি সম্ভব হবে না।
লেখক
প্রাবন্ধিক
শিক্ষাবিদ
মন্তব্য করুন