- বিশেষ আয়োজন
- সংকটে একুশের কাছে
সংকটে একুশের কাছে

একুশে ফেব্রুয়ারি বললেই বাঙালি মাত্রকে সালটা আর বলে দিতে হয় না। এ জাতির গত সাত দশকের ইতিহাসে জীবনের সব ক্ষেত্রে এমনই বিশাল অভিঘাত দিনটি ফেলেছে। ২০০২ সালে এই দিনটিকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সব মাতৃভাষাভাষীর কাছেও একুশে ফেব্রুয়ারি এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। কারণ, বহুভাষিক সমাজে প্রতিটি ভাষাকে সমান মর্যাদা দেওয়ার একটা আহ্বান একুশের আন্তর্জাতিক উদযাপনের পেছনে থাকে। একটি বিপন্ন মাতৃভাষাও যদি একুশের কারণে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়, তা হবে এক সাংস্কৃতিক সাফল্য; যেহেতু সব সংস্কৃতির প্রধান প্রকাশ মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। কিন্তু কোনো ভাষা যদি বিপন্ন হয়, বিশেষ করে ক্ষুদ্র কোনো নৃগোষ্ঠীর, বুঝতে হবে তার পেছনে রাজনীতিও আছে; যেহেতু পৃথিবীর অনেক দেশেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ক্রমাগত অধিকার হারানোর পেছনে সংখ্যাগুরুত্বের এবং জাতপাতের রাজনীতি আছে। এই রাজনীতির পেছনে আবার অর্থনীতিও সক্রিয় থাকে। ব্রাজিলের আমাজনে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল কেটে লোহা, বক্সাইট ও অন্যান্য ধাতু বা আকরের খনি স্থাপন করার ফলে অনেক আদিবাসী তাদের হাজার বছরের ঠিকানা হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় তাদের ভাষাও এখন হুমকির মুখে। আদিবাসীদের ঠিকানা হারানো এবং তাদের মাতৃভাষা বিপন্নতার পেছনে আছে বড় বড় খনি-মুঘল আর সে দেশের উগ্র ডানপন্থার রাজনীতির চর্চাকারী সম্প্রতি ক্ষমতা হারানো রাষ্ট্রপতি জাইর বোলসোনারো। সারাবিশ্বে এই ঘটনাগুলো কোনো না কোনোভাবে ঘটছে আর মাতৃভাষাগুলো বিপন্ন হচ্ছে।
বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারির অভিঘাতকে আমরা প্রধানত সাংস্কৃতিক হিসেবেই দেখেছি, কিন্তু একুশের রাজনৈতিক অভিঘাতও প্রবল। বিষয়টা ব্যাখ্যা করার জন্য ইতিহাসের পথে একটু পেছনে হাঁটতে হবে। যেতে হবে ১৯৩৫ সালে, যখন ইংল্যান্ডের ইতিহাসবিদ ও পার্লামেন্ট সদস্য টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকলের মধ্যস্থতা ও সক্রিয় ওকালতির কারণে পরাধীন ভারতের শিক্ষা, বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসনের প্রধান ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে বেছে নেওয়া হলো। পার্লামেন্টে দেওয়া তাঁর ভাষণে ম্যাকলে বেশ সোজাসাপ্টাই বলেছিলেন, ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য হবে এমন এক প্রজাসমাজ তৈরি করা; যাদের রক্ত ও গাত্রবর্ণই শুধু বলে দেবে তারা ভারতীয়, কিন্তু যাদের রুচি থেকে জীবনাচরণ- সব হবে ইংরেজদের মতো। অর্থাৎ এক সংকর বা হাইব্রিড সমাজ তৈরি করে, তাদের সক্রিয় সমর্থনে ইংরেজরা ঔপনিবেশিক শাসন আরও কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী করবে। ১৯৪৭ সালের আগস্টে উপমহাদেশে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হলে ভারত বেছে নিল গণতান্ত্রিক শাসন, পাকিস্তানও; কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র দশ-
এগারো বছরের মধ্যে দেশটি চলে গেল সামরিক শাসনের অধীনে। সেই যে ওই দেশের অধঃপতন শুরু হলো, এত বছর পরও তা থেকে পরিত্রাণ মেলেনি। কিন্তু ঠোঁটসেবার গণতন্ত্র অথবা সমরতন্ত্র যাই হোক, পাকিস্তানের শাসনমাধ্যম শুরু থেকেই পূর্ব বাংলাকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে গণ্য করতে থাকল এবং ইংরেজদের রেখে যাওয়া ঔপনিবেশিক শাসনের ব্যবস্থাপত্র অনুসরণ করে পূর্ব বাংলার ওপর তার প্রয়োগ শুরু করল।
ইংরেজরা যে ঔপনিবেশিক শাসন চাপিয়ে দেয় এই উপমহাদেশসহ পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে, তাতে শুরুতেই ছিল মানচিত্র-মাটি-মানুষকে দখলে নেওয়া। তারপর সেসব মানুষকে প্রজা অথবা দাসে পরিণত করা; তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের রাজনৈতিক ও অন্য সব অধিকার হরণ করে এক অনুগত, প্রতিবাদহীন, অরাজনৈতিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা। ইংরেজরাও এই ব্যবস্থাপত্র বেশ সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করছিল, কিন্তু ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সশস্ত্র স্ম্ফুরণ ভারতীয়দের রাজনৈতিক অধিকার সীমিতভাবে হলেও দেওয়ার একটা উদ্যোগ নিশ্চিত করে দেয়। কিন্তু ম্যাকলে যেভাবে অনুগত প্রজাসমাজ সৃষ্টির লক্ষ্য নির্দিষ্ট করেছিলেন, তাতে সফল হয়ে ইংরেজরা এক বিরাট সহযোগী দল তৈরি করে ফেলেছিল। যারা ইংরেজি শিক্ষা এবং সেই শিক্ষার পথ ধরে জাগতিক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিল। যখন রাজনীতির অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন উঠল, এরাও তখন সক্রিয় হলো। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হলো, কিন্তু কংগ্রেসে মুসলমানদের জায়গা তেমন না হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ হলো। এ ক্ষোভ থেকে ১৯০৬ সালে জন্ম নিল মুসলিম লীগের। এতে অবশ্য লাভ হলো ইংরেজদের। যেখানে একটি মূল দাবির ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হওয়ার কথা ছিল, সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়াল দুই ধর্মভিত্তিক জাতির দুটি দেশের জন্য বিভাজিত আন্দোলন।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ ছিল এমনই রক্তক্ষয়ী যে, এর প্রভাব এ উপমহাদেশের রাজনীতিকে এখনও পশ্চাৎপদ করে রেখেছে।
২. পাকিস্তানিরা যেহেতু ইংরেজদের ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করল, তারা দ্রুত শাসক শ্রেণি-প্রজা শ্রেণির এক দ্বিত্বতার ছকে ফেলে তাদের দেশ পরিচালনার পরিকল্পনাটি সাজাল। সেনাবাহিনীর অধিকাংশ বড় পদই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা ও সেনাপতিদের দখলে; প্রশাসনেরও প্রায় ৮০ শতাংশ, ব্যবসা-বাণিজ্যও ওই একই অনুপাতে। জোর যার মুল্লুক তার। মুল্লুকটা তাই পাকিস্তানিদেরই হলো। তারাই হলো ঔপনিবেশিক শাসক, জোরহীন পূর্ব বাংলা হলো তাদের উপনিবেশ। শুরু থেকেই মানচিত্র-মাটি দখল করে পাকিস্তানিরা নামল মানুষ দখলে। প্রথমেই তারা ভাষাকে নিশানা করল। দেশভাগের পর একটা বছরও গেল না, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দিলেন- উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এটি ছিল আপাতদৃষ্টিতে এক সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। কিন্তু ভাষা কেড়ে নেওয়া অথবা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাকে গুরুত্বহীন করে দেওয়ার পেছনে রাজনীতির একটি চালও থাকে। সেটি হলো, মাতৃভাষার মাধ্যমে যে সক্ষমতা তার ব্যবহারকারীরা অর্জন করে, সেটি যেন রাজনীতির অঞ্চলে ঢুকে না যায়। ইংরেজদের মতো পাকিস্তানিরাও একটা অনুগত প্রজাসমাজ তৈরির কাজ শুরু করল এবং সফলও হলো। এ কাজে তারা ধর্মকে ব্যবহার করল। সেই যে পাকিস্তান ধর্মকে রাজনীতির কাজে লাগাল, তাতে পূর্ব বাংলাকে শাসন করার পালা তো ২৪ বছরেই শেষ হয়ে গেল। কিছু নিজেদের মাটিতেও তারা এক চিরস্থায়ী দুর্ভোগের ব্যবস্থা করে নিল।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু আমাদের ভাষামুক্তির দিনই ছিল না, ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিরও ইঙ্গিতবাহী এক দিন। যে রাজনীতি একুশে ফেব্রুয়ারি একটি সম্ভাবনা হিসেবে নিয়ে এল, তা ছিল গণতন্ত্র। আমাদের ভাষাসংগ্রাম উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল উর্দুর পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হিসেবে বাংলার প্রাপ্য মর্যাদার স্বীকৃতি আদায়ের। এই দাবিটি ছিল প্রকৃত অর্থেই গণতান্ত্রিক। বাংলা ভাষা সংখ্যাগরিষ্ঠের, উর্দু ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠের; কাজেই বাংলার দাবিই তো অগ্রগণ্য। এই গণতান্ত্রিক দাবিই ভাষা আন্দোলনের চালিকাশক্তি ছিল। এই সংগ্রামে জয়ী হয়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস যেমন বাড়ল, আত্মবিকাশের আয়োজনও তেমনি শুরু হলো এবং একটি প্রশ্ন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই উঠল- তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনাতেও তো সংখ্যাগরিষ্ঠের ভূমিকা হবে অগ্রগণ্য। অবাধ নির্বাচন হবে, নির্বাচনে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, তারাই দেশ চালাবে। এটিই গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রের বিকল্প নেই।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে গণতন্ত্রের এই দাবি সমর্থন পেল। পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে মূল ভূমিকায় ছিল যে মুসলিম লীগ, যুক্তফ্রন্টের কাছে তা ধরাশায়ী হলো। ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে আমাদের সাংস্কৃতিক বিজয় নিশ্চিত করেছিল। কারণ, এরপর আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে পাকিস্তানিদের একটি ষড়যন্ত্রও আর সফল হয়নি। কিন্তু একুশের চেতনা থেকে শক্তি সঞ্চয় করা গণতন্ত্র ১৯৫৪ সালে আমাদের রাজনৈতিক বিজয় সূচিত করল। গণতন্ত্র যদিও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হলো এবং ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে পাকাপাকিভাবে অপসারিত হলো; বাঙালির মনে গণতন্ত্রের যে আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হলো, সেটি আইয়ুব অথবা ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন কেড়ে নিতে পারল না। এরপর ১৯৬৬ সালে বাঙালির জন্য অপ্রবেশযোগ্য অর্থনীতির অঞ্চলটিতে আমাদের পতাকা ওড়ালেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার দাবি তুলে, যেহেতু ছয় দফার মূল দাবিই ছিল অর্থনীতির ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ।
অর্থাৎ আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় একুশে ফেব্রুয়ারি এবং সার্বিক অর্থে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব ছিল অপরিসীম। একটা হিসাব নিলে দেখা যাবে, ভাষা আন্দোলনে লেখক-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীর পাশাপাশি রাজনীতিবিদদেরও ছিল বলিষ্ঠ ভূমিকা। বঙ্গবন্ধুসহ অনেক রাজনীতিবিদ এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। ছাত্র সংগঠনগুলোও ছিল মাঠের লড়াইয়ে। কেন ভাষা আন্দোলন আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে বেগবান করেছিল, তার আরও কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া যাক।
রাজনীতি বলতে এখন প্রাতিষ্ঠানিক, মতার্দশ ও দলভিত্তিক, সরকার পরিচালনা সংক্রান্ত এবং নির্বাচননির্ভর রাজনীতিকে শুধু বোঝায় না। এর আরও দু-এক পরিচয় এখন মনোযোগ পাচ্ছে। যেমন ২০২০ সাল থেকে শুরু হওয়া কভিড মহামারিতে যখন সারাবিশ্ব বিধ্বস্ত হচ্ছে, তখন অনেক দেশ তা থেকে মুনাফা করার সুযোগ খুঁজেছে। কভিড প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন বাজারে এলে তা দ্রুত পশ্চিমের দেশগুলোর কব্জায় চলে গেল। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আফ্রিকার অনেক দেশে ভ্যাকসিন দুষ্প্রাপ্য হলো। বলা হলো, বর্ণবাদের পুরোনো রাজনীতি এই মহাবিপদেও পশ্চিম ভোলেনি। বর্ণবাদ সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব বাধিয়ে কালোকে সাদার পদানত করার রাজনীতি। পশ্চিমের দাতা সংস্থাগুলো আমাদের সঙ্গে করেছে প্রতারণার রাজনীতি। পশ্চিমের যেসব দেশ আমাদের গণতন্ত্র শেখাতে দূত ও বাণী পাঠায়, তারাই ফিলিস্তিনের মানুষের ওপর ঔপনিবেশিক শাসন চাপিয়ে দেওয়া ইসরায়েলিদের নির্লজ্জ সমর্থন দেয়। এ হচ্ছে পুরোনো ঔপনিবেশিক নিজ-অপর বিভাজনে ফেলে বিশ্বকে দেখার রাজনীতি। এখানে নিজ হচ্ছে কেন্দ্র, অপর প্রান্ত; নিজ সভ্য, অপর অসভ্য ইত্যাদি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখন পরিচালিত হচ্ছে ভুলে যাওয়া সেই ষাটের দশকের শীতল যুদ্ধের পেছনে কার্যকর রাজনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করে। এ রকম উদাহরণ অসংখ্য দেওয়া যায়। কিন্তু এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধও তৈরি হয় এবং সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ওইসব রাজনীতি (বা অপরাজনীতির) কৌশল ভালো করে জেনে নিতে হয়।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলা শিখিয়েছিল এবং শত্রুপক্ষের কৌশল পড়ে ফেলার সক্ষমতাও আমাদের ভেতর তৈরি করে দিয়েছিল। আমরাও পাকিস্তানিদের নানা কূটকৌশল ও অপরাজনীতি শনাক্ত করতে দক্ষ হয়েছিলাম। একুশে আমাদের মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল এবং ভাষা যেহেতু আমাদের শিক্ষার মাধ্যম- আমাদের শিক্ষিত হওয়ার, নিজেদের মননশীল ও সৃজনশীল হওয়ার অনুপ্রেরণা সেই শিক্ষা থেকেও আমরা পেয়েছি। সে জন্য পাকিস্তানিরা তাদের দাবার চালে আমাদের কাছে ক্রমাগত হারছিল। পুরো ষাটের দশক যে রাজনীতি আমাদের একাত্তর এবং বিজয় পর্যন্ত নিয়ে গেছে, সেই রাজনীতি ছিল একুশের অভিঘাতে সৃষ্ট।
এখনও আমরা সংকটকালে একুশের কাছে ফিরে যাই। এর অভিঘাত আমাদের জীবনের সর্বত্র।
৩. একুশের রাজনৈতিক অভিঘাতের আরেকটি উদাহরণ দিয়ে লেখাটা শেষ করব। ভাষা আন্দোলন যখন ফেব্রুয়ারির একুশের দিকে যাচ্ছে, তখন এর লক্ষ্যের ভেতর ছিল বাংলা, কিন্তু তাতে প্রচ্ছন্ন ছিল বাংলাদেশের ভেতর ব্যবহূত অন্যান্য মাতৃভাষার দাবিও। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা ক্রমাগত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং আদিবাসীদের অধিকার অবহেলা করে আসছি। তাদের নানা দাবিসহ ভাষার দাবি অগ্রাহ্য করেছি। এখন তো পার্বত্য অঞ্চলের বেশিরভাগ অধিবাসী অ-পাহাড়ি! অঞ্চলটিতে এখন চলছে রিসোর্ট বসানোর প্রতিযোগিতা। কিন্তু ২০০২ সালের পর আমাদের একটা কর্তব্য হয়ে গেল সব মাতৃভাষাকে সমান চোখে দেখার। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও আদিবাসীরা যে তাদের মাতৃভাষার জন্য দাবি তুলছে, তার পেছনে আছে একুশের ভাষা। এখন যে রাজনীতি একুশ আমাদের শিখিয়েছে মাতৃভাষার, ন্যায়বিচারের, ধর্ম-বর্ণ-বিভাজনের ঊর্ধ্বে মানবিকতা; তা যদি আমরা ভুলে যাই এবং এই বিপন্ন মাতৃভাষাগুলোকে আমরা রক্ষা না করি, বাংলার সমমর্যাদা না দিই, তাহলে একুশের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা তো শুধু কাগুজে হয়ে থাকবে; বাস্তব হবে না।
একুশ দাবি করে, এ ক্ষেত্রেও সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর যদি ভাষাকে শক্তি জোগাতে হয়, ভাষাভাষীদের শক্তি জোগানোর কাজটা প্রথমেই করতে হবে। অর্থাৎ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
একুশের রাজনীতি সবাইকে নিয়ে সামনে চলার। এ জন্য একুশ শুধু এক দিন নয়, প্রতিদিনই আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক।
লেখক: কথাশিল্পী, শিক্ষাবিদ
মন্তব্য করুন