যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। কিন্তু একজন অভিবাসী বিশেষ করে নারী অভিবাসী, নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধা পেরিয়ে, সব ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিদেশ যাওয়ার পর যখন লাশ হয়ে দেশে ফেরেন, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে! আমাদের দেশে পরিবারের কেউ অভিবাসী হলে অন্য সদস্যরাও উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যু তাঁর পরিবারেরও স্বপ্নভঙ্গ কিংবা দুঃস্বপ্নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

দেশ থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গিয়ে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের বিষয়ে সম্প্রতি রামরু একটি গবেষণা করেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৭-২২ সাল পর্যন্ত ৭০৯ জন বাংলাদেশি নারী অভিবাসী কর্মীর অভিবাসনের দেশে মৃত্যু হয়েছে। যাঁরা মধ্যপ্রাচ্যে মারা গেছেন, তাঁদের গড় বয়স ৩৬ বছর। ইউরোপ-আমেরিকার দেশে যেসব নারীর মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের গড় বয়স ৪৬ বছর। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এত অল্প বয়সে নারী শ্রমিকরা কেন মারা যাচ্ছেন?

প্রতি বছর আমাদের দেশ থেকে যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তাঁদের ১২ শতাংশ নারী। আর যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের প্রায় ৮৮ শতাংশ পুরুষ; ৩ দশমিক ৬ শতাংশ নারী অভিবাসী। পুরুষের তুলনায় নারীর মৃত্যুহার কম- এটি নিয়ে সান্ত্বনা পাওয়ার কিছু নেই। পুরুষ কর্মীরা অনেক আগে থেকেই বিদেশে যাচ্ছেন।

নারীদের লাশের ৯০ শতাংশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থেকে। ৮ শতাংশ এসেছে এশিয়ার অন্য দেশ থেকে, যেখানে আমরা শ্রমিক পাঠাই না। আর উন্নত দেশ থেকে এসেছে ১২ শতাংশ লাশ। তার মানে, অধিকাংশ লাশই আসছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। সৌদি আরব, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মরিশাস, ওমান, কাতার থেকে বেশিরভাগ নারী কর্মীর লাশ এসেছে।

একক দেশ হিসেবে সৌদি আরব থেকেই এসেছে ৩৭ শতাংশ লাশ। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা বিদেশে যান, তাঁদের ৬০ শতাংশই সৌদি আরবে যান। সুতরাং এ দেশ থেকে আসা লাশের সংখ্যাও বেশি। এখানে বিশেষ চিন্তার বিষয় হলো, বিদেশে গিয়ে দুর্ঘটনা ও অস্বাভাবিক মৃত্যু সৌদি আরবে বেশি হচ্ছে। ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের ডাটা বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, এসব মৃত্যুর ৩২ শতাংশই দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা ও খুন। ৩২ শতাংশ তো একটা বিশাল সংখ্যা। বাকি ৬৮ শতাংশ মারা যাচ্ছেন হৃদরোগ, কিডনি, ক্যান্সার ইত্যাদিতে, যেগুলো বলা হচ্ছে স্বাভাবিক মৃত্যু। এর মানে, অস্বাভাবিক মৃত্যু ৩২ শতাংশ, আর স্বাভাবিক মৃত্যু ৬৮ শতাংশ। তবে, বিদেশে মৃত্যুবরণ করেছেন এমন ১০০ পরিবারের ওপর পরিচালিত রামরুর সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, বেশিরভাগই বিশ্বাস করছে না- তাঁদের স্বজনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এখানে যুক্তি হচ্ছে- লাশের শরীরে কোনো না কোনো ধরনের দাগ বা ক্ষতচিহ্ন তাঁরা দেখেছেন। তাঁরা মনে করছেন, নিয়োগকারীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হয়তো হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদের স্বজন। ফলে ময়নাতদন্তে হৃদযন্ত্রের বিষয়টিই আসছে; চাপা পড়ে যাচ্ছে অত্যাচারের বিষয়টি। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও মনে করেন, ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের ডাটা সঠিক নয়। সরকারের ভেতরেও রয়েছে এক ধরনের সংশয়। এটা তো সংশ্নিষ্ট দেশ থেকে দেওয়া মৃত্যুসনদ। এ অবস্থায় আমরা কী করতে পারি? মৃত্যু বন্ধ করা হয়তো সম্ভব নয়। তবে আমরা এ মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারি।

কোনো লাশের ব্যাপারে সন্দেহ হলে, জখমের চিহ্ন থাকলে সে দেশের সংশ্নিষ্ট দপ্তরকে আমাদের দূতাবাস ময়নাতদন্ত করার অনুরোধ করতে পারে। বিদেশে করা না গেলে দেশে আসার পর ময়নাতদন্ত করা যেতে পারে। তবে সমস্যা হলো, লাশটি এ দেশে আসার পর ময়নাতদন্তের সিদ্ধান্ত নিতেই বেশ কিছু সময় পার হয়ে যায়। সেই লাশ হিমঘরে না থাকলে আলামত পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে অনেকেই মনে করছেন, দেশের বিমানবন্দরের ভেতরে হিমঘর তৈরি করা দরকার। সেখানে নির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞ থাকবেন। তিনি লাশ দেখে সন্দেহ করলে হিমঘরে রেখে দিয়ে ময়নাতদন্তের সুপারিশ করবেন। আর সন্দেহ না হলে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করবেন। তবে অভিযোগ সংশ্নিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা এটিকে ভালোভাবেই নেবে। কারণ অভিযোগ তো নিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে; সরকার বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়। দু'দেশের মধ্যে আন্তরিকতার মাধ্যমেই কাজটি করা সম্ভব।


এবার আসা যাক দেশে লাশ গ্রহণ ও সংরক্ষণ বিষয়ে। এই দায়িত্ব বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের। লাশ গ্রহণ করতে আসা পরিবারের বিমানবন্দরে দাঁড়ানো বা অবস্থান নেওয়ার মতো নির্দিষ্ট স্থান নেই। শোকাহত পরিবারের জন্য এ ব্যবস্থা করা জরুরি। যেসব মরদেহ আসে, সেগুলো অনেক সময় অন্যান্য লাগেজের কাছে পড়ে থাকে। এ রকম অব্যবস্থাপনার কারণে লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে স্বজনদের অনেক সময় রাত হয়ে যায়।

সরকারের পক্ষ থেকে লাশ দাফনের জন্য যে ৩৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়, তা বেশিরভাগ পরিবারই পেয়ে থাকে। আর ৩ লাখ টাকা যে এককালীন সহযোগিতা দেওয়া হয়, এখানে কিছু জটিলতা রয়েছে। নমিনি নিয়ে গন্ডগোল হয়। অনেক ক্ষেত্রে অভিবাসীর বাবা-মা নমিনি হয়ে নিহতের যুবতী স্ত্রীকে বঞ্চিত করতে চান। অনেক সময় পরিবারকে বঞ্চিত করে তৃতীয় কেউ টাকা নিয়ে নিতে চান। এ টাকা পরিশোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান যেমন অনেক সময় দেরি করে, অন্যদিকে সঠিক নমিনি নির্ধারণ করতে গিয়েও বিলম্ব হয়।

বিদেশে মৃত্যুবরণকারীদের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বহু মন্ত্রণালয় কাজ করছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান, পররাষ্ট্র, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তাদের মধ্যে একটি সমন্বয় প্রয়োজন। না হলে এখানে বড় রকমের ঘাটতি থেকে যাবে।

অভিবাসী নারী কর্মীদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর উচ্চ হার নিয়ে কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনা হতে দেখি না। কিন্তু এটি আলোচনায় আসা দরকার এবং এর প্রতিকারে লাশ গ্রহণকারী রাষ্ট্র কী ধরনের ব্যবস্থা নেবে, তাও আলোচনায় আসা উচিত। পরিবার যদি লাশে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক আলামত শনাক্ত করে, তাহলে তারা যেন ময়নাতদন্ত চাইতে পারে- সে ব্যবস্থাও দরকার। এ জন্য তাদের মধ্যে সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করতে হবে। আমরা যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের কেউ কেউ পুনঃময়নাতদন্ত চেয়েছেন। কিন্তু আইনি সীমাবদ্ধতায় তাঁরা সে সুযোগ পাননি। পরিবার থেকে দাবি এলে ময়নাতদন্ত করা জরুরি। পরিবার থেকে দাবি না এলেও কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হলে নারী অভিবাসনের নিরাপত্তার জন্যই তাদের এটি করা উচিত।

কোনো ব্যক্তি বিদেশ যাওয়ার সময়েই নমিনি নির্ধারণ করে গেলে মৃত্যুর পর ক্ষতিপূরণ পেতে সমস্যা হবে না। বছরে একবার নমিনি পরিবর্তনের সুযোগ রাখা উচিত। অস্বাভাবিক মৃত্যু কমাতে সচেতনমূলক কার্যক্রম প্রয়োজন। নারী কর্মী বিদেশে যাওয়ার আগে সরকারিভাবে তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কোনো ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে কোথায় এবং কার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, এ ব্যাপারে তাঁদের ধারণা দেওয়া দরকার। দেশ-বিদেশে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারলে নারী-পুরুষ উভয় অভিবাসীর অস্বাভাবিক মৃত্যু কমে আসবে।

অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী: চেয়ারপারসন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, রামরু