কোটি টাকা চাঁদাবাজির ঘটনায় আলোচিত চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি দেবাশীষ নাথ দেবুর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক তদন্ত প্রতিবেদন আজও আলোর মুখ দেখেনি। চাঁদাবাজির ঘটনা তদন্তে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা দুই সদস্যের কমিটি গঠন করেছিলেন ছয় মাস আগে। কমিটিকে ২১ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে সেই প্রতিবেদন কবে জমা দেওয়া হবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় প্রতিবেদন দেওয়া হচ্ছে না বলে সংগঠনের ভেতরেই আলোচনা হচ্ছে। এ দিকে তদন্ত প্রতিবেদন না দেওয়ায় দেবু আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এত বড় অভিযোগ প্রকাশের পরও তাঁকে সভাপতি পদ দেওয়া নিয়ে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এর মধ্যেই চাঁদাবাজি মামলায় অভিযোগ গঠন করেছেন আদালত। মূলত এর পরই ঘুম ভাঙে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাদের। নানা মহলের চাপে পড়ে গঠন করেন তদন্ত কমিটি। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি ফারুক আমজাত খান ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক একেএম আজিমকে করা হয় কমিটির সদস্য।

এত দিনেও প্রতিবেদন দিতে না পারার সুদত্তর দিতে পারছেন না তাঁরা। এ জন্য শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতার অসুস্থতাকে দায়ী করছেন তাঁরা। অথচ তিনি অসুস্থ হয়েছেন এক মাস আগে। তাহলে এর আগের পাঁচ মাসে তাঁরা কী করলেন, সেই প্রশ্নের জবাব মিলছে না। চাঁদাবাজিতে সভাপতির নাম আসা ও আদালত বিচার শুরুর আদেশ দেওয়ায় বিব্রত চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা। এতে দল ইমেজ সংকটে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তাঁরা। সভাপতিকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় নেতাকর্মীর মাঝেও দেখা দিয়েছে হতাশা।

জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্য আজিম সমকালকে বলেন, তদন্তের যাবতীয় কাজ এখনও শেষ হয়নি। এ জন্য আরও কিছু সময় লাগবে। তবে এ ঘটনার নানা তথ্য-উপাত্ত ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করেছেন তাঁরা।

এত দিনেও আলোর মুখ না দেখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় যাবতীয় বিষয় খতিয়ে দেখতে বাড়তি সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে। তাছাড়া কমিটির অপর সদস্য প্রায় এক মাস ধরে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে আছেন। এত বিলম্ব হওয়ার পেছনে এটাও একটা কারণ। তিনি দেশে আসার পর আশা করছি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।’

অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় কি প্রতিবেদন দেওয়া হচ্ছে না– এমন প্রশ্নের উত্তরে আজিম বলেন, ‘তা কেন হবে? বিষয়টি আমার মতো পুরো দলের জন্যই প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরাও চাই সত্য ঘটনা উন্মোচিত হোক। চাঁদাবাজির ঘটনায় তিনি জড়িত থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এ পর্যন্ত তদন্তে কী পেয়েছেন– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তদন্তাধীন বিষয়ে এর বাইরে কিছুই বলতে পারব না।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, ‘চট্টগ্রামের মতো একটি কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ানোয় আমরা বিব্রত। এখন প্রতিবেদনটি গুম করা মোটেও ঠিক হচ্ছে না।’

চাঁদাবাজি মামলা ছাড়াও নানা বিতর্ক আছে দেবুকে ঘিরে। গঠনতন্ত্র অমান্য ও কমিটির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যের অংশগ্রহণ ছাড়াই থানা ও ওয়ার্ডে সদস্য সংগ্রহ, নবায়ন, সম্মেলনের প্রস্তুতি এবং বিতর্কিত নেতাদের কমিটিতে স্থান দিয়ে সভা করাসহ নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ এরই মধ্যে গেছে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছেও।

মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমানের বিরুদ্ধেও ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ অভিযোগ এনে ক্ষুব্ধ নেতারা গত মাসে ঢাকায় গিয়ে নালিশ দিয়েছেন। এর পর গত ৩ মার্চ দেবুসহ পুরো কমিটিকে ঢাকায় তলব করা হয়। বৈঠকে দেবুর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলে ধরেন ২০ সদস্যের ১৫ জনই।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে দেবু সমকালের কাছে দাবি করেন, ‘চাঁদাবাজির মামলার বাদীর সঙ্গে সমস্যা অনেকটা মিটমাট হয়ে গেছে। কমিটির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিরও অবসান হয়ে গেছে।’ তদন্ত প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতারা জানেন। এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’

তবে দেশের বাইরে থাকা মামলার বাদী বন্ধন নাথ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সেই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনও ঘুমাতে পারি না। আমার পিঠে এখনও সেই ক্ষত রয়েছে। দেবাশীষ নাথ দেবু একজন কুখ্যাত চাঁদাবাজ। সে শুধু আমার সঙ্গেই চাঁদাবাজি করেছে, তা নয়। অনেক গরিবের পেটে লাথি মেরেছে, গরিবের মুখের ভাত কেড়ে নিয়েছে। ও হলো বড়লোকের চামচা, গরিবের জম। ওর মতো চাঁদাবাজ কীভাবে আওয়ামী লীগের নেতা হয়? ওর মতো চাঁদাবাজরা নেতা হলে দলেরই বদনাম হবে।’

গত বছরের আগস্টে দেবুসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানার পূর্ব নাছিরাবাদ এলাকায় একটি পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন তৈরির চেষ্টা করেন একই এলাকার বাসিন্দা প্রবাসী বন্ধন নাথ। কাজ শুরুর পর দেবুর নেতৃত্বে একদল লোক ১ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। এতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁরা বন্ধনকে মারধর এবং পরে পিঠের ডান পাশে গুলি করেন। এক পর্যায়ে চাপে পড়ে চেকের মাধ্যমে ৭০ লাখ টাকা পরিশোধও করেন বন্ধন। বাকি ৩০ লাখ টাকা না দেওয়ায় আবারও বন্ধ করে দেওয়া হয় নির্মাণকাজ।

এ নিয়ে মামলা হলে দেবু ও তাঁর সহযোগী মঞ্জুরুল ইসলাম রতনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তদন্ত শেষে পুলিশ ২০১৯ সালের অক্টোবরে মামলার অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার কথা জানিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেন। ঘটনার সময় দেবু কোনো পদে ছিলেন না। তবে বিতর্কের মধ্যেই গত বছরের মার্চে তাঁকে সভাপতি করে চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়।