১৯৭১ সাল হলো মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত একটি পর্যায়। কিন্তু সেই পর্যন্ত আসতে আমাদের অনেক বন্ধুর পথ পারি দিতে হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে ভিত ধরেই হয়তো আমরা এগিয়েছি। তবে ষাটের দশকে, বিশেষত ওই দশকের শেষ ভাগের ঘটনাবলি আমাদের মধ্যে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের সময়ে আমি স্কুলে পড়ি। এর কিছু পরেই এলো ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। ১৯৬৬ সালে আসে ৬ দফা। ১৯৬৮ সালে আন্দোলন তীব্র হয়। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। তারই ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। ওইসব আন্দোলনে তরুণ সমাজের অসাধারণ অংশগ্রহণ ছিল।

একটা কথা বলতেই হয়– আমাদের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা ছিল, আন্দোলন ছিল, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মতো একটা ইতিহাস বদলে দেওয়ার ঘটনা যে ঘটবে, সেটি আমার ধারণা কারও মাথায়ই ছিল না। সে সময়ের একটা খুব পরিচিত ছবি আমরা দেখি– কাঠের বন্দুক হাতে ছাত্র ইউনিয়নের মেয়েরা মিছিল করছেন। কাঠের বন্দুক দিয়ে কিন্তু যুদ্ধ হয় না। তবে সেই আবেগ-অনুভূতি-আকাঙ্ক্ষাটা সেখানে ছিল। আমরা আন্দোলন করেছি স্বায়ত্তশাসনের জন্য। পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে থেকেই অধিকার আদায়ে এ সংগ্রাম আমরা করেছি। তবে ঘটনাক্রমে তার মোড় ঘুরে যায় স্বাধীনতার দিকে। এর পেছনেও বড় ভূমিকা ছিল ছাত্র-তরুণদের।

১৯৭১ সালের মার্চের কথা। ততদিনে আমার অনার্স শেষ হয়ে গেছে। আমার এক বন্ধু বিদেশে চলে গেছে। আমারও বিদেশে ভর্তি নিশ্চিত, চলে যাওয়ার কথা ছিল। ওই বন্ধুর বাবা ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা। সাবেক সেনা সদস্যদের নিয়ে তখন শহীদ মিনারে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একটি সংহতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তিনিও সেখানে গিয়েছিলেন। এ নিয়ে আমার বন্ধুর মা খুব চিন্তিত ছিলেন। তখনই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল।
তবে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এমন নির্মম হত্যাযজ্ঞ না চালাত, তাহলে কী ঘটত, বলা মুশকিল। কারণ, এ ঘটনার প্রতিক্রিয়াটা ছিল মারাত্মক। আমি সেই ঘটনার সাক্ষী। কারফিউ উঠে যাওয়ার পর ২৭ তারিখ যখন বাসা থেকে বের হলাম, তখন চোখে পড়ল– বিডিআর থেকে সদরঘাট রাস্তায় এখানে-সেখানে মরদেহ পড়ে আছে। এ হত্যাযজ্ঞ থেকে নিজের মধ্যে এই বোধ চলে আসে যে, এটাই যথেষ্ট, তাঁদের সঙ্গে আর নয়।

আমি তখন ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত ছিলাম। মস্কো-পিকিং বিভাজন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের প্রভাব ছিল আমাদের ওপর। আবার ভারতে চারু মজুমদার, কানু স্যানালদের নেতৃত্বে নকশাল আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এর একটা প্রভাবও ছিল আমাদের মধ্যে। তবে কে কোথায় যাব, কী করব, আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। হিশেহারা হয়েই তো মানুষ বেরিয়ে এসেছে। আমার বন্ধু তৌহিদ সামাদ আমার কাছে এনএসএফের একজনকে নিয়ে আসে। তাঁর নাম বদিউল আলম বদি। পরে শহীদ হয়। বদিকে দেখে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত ছিলাম। আমরা তখন জিমনেসিয়ামে শরীরচর্চা করতাম। বদিরা একবার আমাকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। জিন্নাহ হলে নিয়ে আমাকে পেটাবে। তাঁরা বামপন্থিদের ভীষণ অপছন্দ করত। বদি আমার চোখে তাঁর প্রতি একটা অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা দেখতে পায়। বদি বলল, ‘হাই কমি (কমিউনিস্ট), তোমরা তো বিপ্লবের কথা বলো। চলো যুদ্ধে যাই।’ আমরা ধানমন্ডি ৪ নম্বর রোডে আরেক বন্ধুর বাসায় যাই। সেখানে বদি একটা ব্লেড দিয়ে আমার ও তাঁর হাতে আঁচড় দিয়ে রক্ত বের করে বলে, ‘আজ থেকে আমরা রক্তের ভাই।’ সেখানে আসে আমার আরেক বন্ধু আশফাকুস সামাদ (আশফি), বিখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদের ভাইয়ের ছেলে। চাচার গাড়ি দিয়েই সে গোপীবাগ থেকে ধানমন্ডিতে আসে। আসে আরেক বন্ধু মাসুদ ওমর। আমরা চার বন্ধু (আমি, আশফি, বদি ও মাসুদ) সেখানেই সিদ্ধান্ত নিই– আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি।

দুপুরে আবার কারফিউ শুরুর আগেই আমরা ঢাকা ছাড়ছি। বদি বলল, সিরাজগঞ্জে তাঁর মামার বাড়ি। সেখানে যেতে পারি। সে মতো রওনা দিলাম। কিশোরগঞ্জে পৌঁছে দেখি, সেকেন্ড বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর থেকে বেরিয়ে সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে। আমরা সেখানে গেলাম। কিন্তু আমাদের তারা ভেতরে যেতে দেবে না। বদি তাঁর ক্যাডেট কলেজের একজন সিনিয়র ভাই লেফটেন্যান্ট গোলাম হেলাল মোর্শেদ খানকে দেখতে পায়। পরে তিনি মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। বদির ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি আমাদের শফিউল্লাহ সাহেবের কাছে নিয়ে যান। আমরা নিজেদের আবেগের কথা বলি, যে কোনো প্রকারে আমরা যুদ্ধে থাকতে চাই। সেখানে ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর নুরুজ্জামান। তিনি আমাদের চিনতেন। পরে আশ্বস্ত হয়ে আমাদের চারটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, গুলি ও হ্যান্ড গ্রেনেড দেওয়া হয়। ২-৩ দিনের মধ্যে আমাদের শিখিয়ে দেওয়া হয় কীভাবে গ্রেনেড ছুড়তে হয়, গুলি চালাতে হয়। সেই অস্ত্র নিয়ে আমরা ২ বা ৩ এপ্রিল ঢাকায় প্রবেশ করি। সম্ভবত এটাই প্রথম কোনো সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের ঢাকায় প্রবেশ। এরপর আমরা ঢাকায় বিভিন্ন গেরিলা অপারেশন চালাতে থাকি। এক পর্যায়ে আমাদের গ্রুপটির নাম দেওয়া হয় ‘ক্র্যাক প্লাটুন’।

আমার কাছে দল না রাজনীতিটা সবার ঊর্ধ্বে। তবে ওই সময় বেঙ্গল রেজিমেন্ট যদি বিদ্রোহ না করত, তাহলে আমরা ছোট একটা কেন্দ্র পেতাম না, যার সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করা যাবে। তাঁদের মধ্যে অনেকে বেরিয়ে এসেছেন জীবনের ভয়ে। কারণ একজন সৈনিকের কাছে হাতিয়ারটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। যখন সেটি বাজেয়াপ্ত করা হয়, এটি তাঁর জন্য সবচেয়ে ভয়ের। আবার খালেদ মোশারফ, সফিউল্লাহর মতো কেউ কেউ আগে থেকেই বেরিয়ে গেছেন। রাজনৈতিক চেতনা থেকেও সেখানে বেশি কাজ করেছে এই বোধ যে, এই ক্র্যাকডাউনের পর এখন যে কোনো কিছুই হতে পারে। সেখানে একটি নিউক্লিয়াস গড়ে উঠেছিল। অবসরে যাওয়া কোনো কোনো সেনা কর্মকর্তারাও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। যুদ্ধ সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসে।