ইস্যুভিত্তিক গণআন্দোলন, নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচি, সংসদীয় মঞ্চে তর্ক-বিতর্ক– এসব পথেই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি অপশাসকদের পূর্ব বাংলা শোষণের নীতির বিরোধিতা করেছেন, অর্থনৈতিক নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছেন। কিন্তু গেল শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলো এবং পূর্ব বাংলায় সব ধরনের গণমুখী রাজনৈতিক বিকাশকে স্তব্ধ করার সরকারি উদ্দেশ্য স্পষ্ট প্রতিয়মান হয়ে উঠল। তখন এটা বোঝাই যাচ্ছিল যে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ছাড়া আর বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির কোনো পথ খোলা নেই। প্রত্যেক কালের মুখ্যতম রাজনৈতিক প্রশ্ন ও জনদাবিগুলোকে ধারণ করে নিজের রাজনৈতিক এজেন্ডা নির্ধারণে বঙ্গবন্ধু কোনো কালেই ব্যর্থ হননি। তাই এ সময়ও বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় করার দিকে সমস্ত মনোযোগ দেন। কেননা বঞ্চিত মানুষের কাছে এটিই ছিল তাঁদের প্রাণের দাবি।

অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের গোড়া থেকেই রাষ্ট্রের নীতি কাঠামোতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা পূর্ব বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজের শোষণকে উৎসাহিত করা হয়েছিল। এ যেন ছিল নয়া উপনিবেশবাদের আরেক রূপ। এই বৈষম্যের অর্থনীতির প্রেক্ষাপটেই অনেক ভেবেচিন্তে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঐতিহাসিক ছয় দফা পেশ করেন। মার্চ মাসের ১৮, ১৯, ২০ তারিখে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্মেলনে এই দাবিনামা উপস্থাপন করা হয় এবং তা অনুমোদন লাভ করে। এরপর থেকেই বঙ্গবন্ধু দেশের জনগণের কাছে ছয় দফার মর্মবাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যাপক গণসংযোগে বের হন। এই ছয় দফায় শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের যেসব দাবি ছিল, সেগুলোর মধ্যে তিনটিই ছিল অর্থ ও বাণিজ্য সম্পর্কিত। সংক্ষেপে ছয় দফার উল্লিখিত দাবিগুলো ছিল: ১. পাকিস্তানকে একটি ‘ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র করা, ২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি– এই দুই বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখা, ৩. পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য আলাদা মুদ্রা চালু করা, আর তা সম্ভব না হলে বিশেষ শর্তাধীনে মুদ্রা ব্যবস্থায় প্রদেশগুলোকে স্বাধীনতা দেওয়া (প্রতিটি অঙ্গ রাষ্ট্রের জন্য আলাদা রিজার্ভ ব্যাংক), ৪. কর ও শুল্ক ধার্যের ক্ষমতা অঙ্গ রাষ্ট্রের কাছে অর্পণ, ৫. প্রতিটি অঙ্গ রাষ্ট্রের আলাদা বহির্বাণিজ্যের হিসাব (যাতে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গ রাষ্ট্রের এখতিয়ারে থাকে) এবং ৬. অঙ্গ রাষ্ট্রগুলোর আলাদা আধা সামরিক বাহিনী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চে দীর্ঘকাল সংগ্রামে সক্রিয় থেকে এবং কখনও কখনও মন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞতার আলোকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসনের শোষক চরিত্রটির স্বরূপ যথার্থভাবেই চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। এসব অভিজ্ঞতা এবং পূর্ব বাংলার বাস্তব পরিস্থিতির আলোকেই তিনি ছয় দফা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পূর্ব বাংলার বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাও বঙ্গবন্ধুকে বৈষম্যের অর্থনীতির নানা দিক অবহিত করতেন। তবে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু নিজেই এই ছয় দফার মূল সূত্রগুলো প্রণয়ন করেছেন। এর অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভেতরকার কাঠামোগত বৈষম্য ও রাষ্ট্রের একচোখা ভূমিকার ওপর নজর দিতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের সুবিধার্থে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে পূর্ব বাংলাকে আর্থিকভাবে বঞ্চিত করতে থাকে। তাছাড়া ‘এমনিতেই রাষ্ট্র গঠনের সূচনায় পশ্চিমের অধিকতর বিস্তৃত এবং উন্নত অবকাঠামো ছিল। পশ্চিমের কুক্ষিগত কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষপাতিত্বমূলক নীতিমালা, দুই অঞ্চলের মধ্যে অসম সম্পদ বণ্টন ও আর্থিক বিনিয়োগ– সব মিলে উভয় অঞ্চলের মধ্যকার আর্থিক বৈষম্য ক্রমাগত বাড়তে থাকে।’ (নুরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান– কাছে থেকে দেখা, পৃ. ১৬, প্রথমা, ২০২০)। এই বাস্তবতার কথা তথ্য দিয়ে আরও স্পষ্ট করেছেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। তিনি লিখেছেন,  ‘১৯৫০-এর দশকের শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নতির ভিত্তি তৈরি করা হয়েছিল ভৌত অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ করার মাধ্যমে। তখন থেকেই এসব ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান তুলনামূলকভাবে বঞ্চিত হতে থাকে। বৈষম্যমূলক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রানীতির দ্বারা পূর্বের সম্পদকে পশ্চিমে ব্যাপকভাবে পাচারের পথ সুগম করা হয়। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে সম্পদ পাচার পুরোদমে শুরু হয়। রপ্তানি বাণিজ্যে পূর্ব পাকিস্তানের আয়ের উদ্বৃত্ত অংশ অধিক হারে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয়িত হতো। এটা ঘটত সরকার নির্ধারিত পাকিস্তানি মুদ্রার বৈদেশিক মূল্যহারের কারণে, যা ছিল প্রকৃত বিনিময় হারের চেয়ে কম।

এই রপ্তানি উদ্বৃত্তের পরিমাণ এতই বেশি ছিল, তা পশ্চিমের সঙ্গে পূর্বের যে (ক) আঞ্চলিক বাণিজ্যের ঘাটতি এবং (খ) বৈদেশিক সাহায্যে পূর্বের যে অংশ, দুইয়ের সমষ্টির চেয়ে বেশি ছিল।’
এই অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে যথাযথভাবে অনুধাবন করেই বঙ্গবন্ধু ছয় দফা নিয়ে এগিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে এই অর্থনৈতিক দাবিগুলোতে বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের গণমুখী চিন্তা ও চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। তবে বিষয়গুলো মোটেও সহজ-সরল ছিল না। তাই এগুলোর বিচার বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছিল। কেননা, পাকিস্তানি অভিজনেরা এবং অন্যান্য বিরোধীদলের নেতারাও অনবরত ছয় দফার ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। সে জন্য বঙ্গবন্ধু নিজেই ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে বঙ্গবন্ধু ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ শিরোনামে ছয় দফার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। এ সম্মেলনেই নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জহিরুদ্দীন ক্ষমতাসীনদের ছয় দফা নিয়ে প্রত্যক্ষ বিতর্কে অংশগ্রহণের আহ্বান করেন। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলিকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে উন্মুক্ত বিতর্কের আহ্বান জানানো হয়। আর বঙ্গবন্ধু নিজে সারা পূর্ব বাংলা ঘুরে ঘুরে ছয় দফার প্রচার শুরু করেন। এই প্রচার অভিযান চলাকালেই মাঝে মাঝেই তাঁকে আটক করা হয় (আতিউর রহমান, বঙ্গবন্ধু সহজতর পাঠ, পৃষ্ঠা ৬২-৭৩, সদর প্রকাশনী, ২০২১)। আদালত থেকে জামিন পেয়ে ফের তিনি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আবার আটক হন। আবার জামিন পান। এ যেন সাপ-লুডুর খেলা। কিন্তু তিনি দমে যাননি। জনগণের সমর্থনকে পুঁজি করে নির্ভয়ে যুক্ত থেকেছেন আন্দোলনে।
স্থানীয় আদালত থেকে জামিন নিয়ে আবার তিনি প্রচারে নেমে পড়েন। এরই এক পর্যায়ে নারায়ণগঞ্জে ৮ মে জনসভা শেষ করে বাড়ি ফিরলে তাঁকে দীর্ঘদিনের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ৭ জুন প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। এই ধর্মঘট খুবই সফল হয়। তবে এতে অনেক কর্মীর প্রাণ যায়। অনেক নেতাকর্মীকে জেলে ভরা হয়। আর তাঁর লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’ থেকে জানা যায়, সেই সময়টায় তিনি কী অস্থিরই না ছিলেন জেলখানায়। 

সাংবিধানিক সংসদ বসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে আগে থেকে ‘হোমওয়ার্ক করা’ ছয় দফাভিত্তিক সংবিধান সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে পাস করে নিতেন, সে কথাটি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিল। আইয়ুব খান যেমন ‘সিক্স পয়েন্টে’র বিপরীতে ‘গান পয়েন্টে’র কথা বলতেন, ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্রও শেষ পর্যন্ত সেই পথই বেছে নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বসে ছিলেন না। ৭ মার্চ তিনি কার্যত স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি মুক্তির কথাও জোর দিয়ে বলেছিলেন। পুরো অসহযোগ আন্দোলনটি ছিল আসলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব। তাই ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, ততক্ষণে ছয় দফা এক দফায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আর এই রূপান্তরের অসামান্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।