আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া কোনো বিষয় নয়। ষাটের দশকের বিকশিত রূপ সামনে আসে মুক্তিযুদ্ধে। তবে ওই দশকে যা ঘটেছিল, তার বীজ কিন্তু প্রোথিত হয় পাকিস্তান গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; যার ফলে বাংলায় শুরু হয় তীব্র প্রতিবাদ। ১৯৪৮ সালের মার্চে পাকিস্তানের ‘জাতির পিতা’ কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকা সফরে ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।’ তখন ছাত্র-জনতা যে বিরোধিতা করেছিল, বলতে গেলে সেদিনই পাকিস্তানের মৃত্যুবীজ রচিত হয়। এরপর ভাষা আন্দোলনে বাঙালি জাতির বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। ঘটনা পরিক্রমায় এসেছে ষাটের দশক। যে দশকটি দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিসরে এক ভিন্ন আঙ্গিকে গড়েছে গোটা ইতিহাসের পরিক্রমা।

১৯৪৮ সালে জিন্নাহর কারণে যে আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল, সেটি ষাটের দশকে বিশেষ গতিপ্রাপ্ত হয়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হয়। তখন আজাদ পত্রিকায় রবীন্দ্র শতবর্ষ যাঁরা পালন করেছেন, তাঁদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ আখ্যায়িত করা হয়। এ ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের সচেতন জনগণ সক্রিয় প্রতিবাদ জানান ওইসব বক্তব্যের বিরুদ্ধে।

আমি নিজেও রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে খুব বেশি আগ্রহী যে ছিলাম, এমন নয়। ১৯৬১ সালে যখন রবীন্দ্রনাথবিরোধী বক্তব্য দেওয়া শুরু হয়, তখনই আমরা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিশেষ সচেতন হয়ে উঠি। তাঁর বইপত্র নতুন করে পড়া শুরু হয়। ভারতীয় রেডিওতে বাজানো রবীন্দ্রসংগীত শোনার জন্য আমাদের কান প্রস্তুত হয়ে উঠেছিল। যাঁরা বাঙালি চেতনায় বিশ্বাস করেন, যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসেন, তাঁদের ওপর পাকিস্তানপন্থি বুদ্ধিজীবীরা প্রচারণা চালাতে শুরু করে। তাঁরা দেশটাকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল। পাকিস্তানকে একটি ধর্মরাষ্ট্রে রূপ দিতে চেয়েছিল। আমার ধারণা, রবীন্দ্রবিরোধী এমন প্রচারণা না হলে, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমরা এত সচেতন ও উদ্যোগী হয়ে উঠতাম না। কাজেই এদিক থেকে পাকিস্তানি শাসকরা এ বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে ভালোই করেছিল।

ষাটের দশকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। ১৯৬৫ সালে এ যুদ্ধ এখানকার মানুষকে নতুন করে চিন্তা করতে উজ্জীবিত করল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছিল কার্যত অরক্ষিত।
ভারত যদি পূর্ণ শক্তি দিয়ে আমাদের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তাহলে আমরা হয়তো সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করতাম; কিন্তু সেই সর্বশক্তিটুকু আসলে কতখানি? আমরা জানি, ভারত আক্রমণ করলে তা কোনো কাজে দিত না, পূর্ব পাকিস্তান ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ত। যে কারণেই হোক, ভারত তখন আমাদের ওপর আক্রমণ করেনি। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা কিন্তু নতুনভাবে ভাবতে শিখলাম। আমরা দেখলাম, আমাদের পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এ ঘটনা আমাদের নতুনভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করল। আমরা দেখলাম যে, এর পরের বছর ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিলেন। ৬ দফায় এমন কিছু ছিল না যে, এর ফলে পাকিস্তান ধসে পড়বে; কিন্তু এতে এমন কিছু ছিল যে, স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের আন্দোলন অগ্রসর হতে পারে। সেই ৬ দফার বিরুদ্ধে পাকিস্তান এমনভাবে লেগে গেল, যা আমাদের ধারণারও অতীত। এখানকার সচেতন জনগণও ৬ দফাকে কেন্দ্রে রেখেই নিজেদের চিন্তা সম্প্রসারিত করেছেন।

পাকিস্তানপন্থি চিন্তাবিদরা যদিও সংখ্যার হিসাবে ছিলেন নগণ্য, তবে তাঁদের মূল দিকটি ছিল পাকিস্তান নামক একটি শোষণ কাঠামোকে টিকিয়ে রেখে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করা, দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাঁদের সম্পদ লুট করা। এ কাজটি তাঁরা বেশ বড় পরিসরেই করেছেন। বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে তাঁরা ‘হিন্দুস্তানের দালাল’ বলে উল্লেখ করেছেন। তখন হিন্দু ধর্মাবলম্বী পাশাজীবী-বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপক পরিসরে আটক করা হয়।
১৯৬৬ সালের ১৫ জুন ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া গ্রেপ্তার হন এবং ১৬ জুন ইত্তেফাককে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে রবীন্দ্রসংগীতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

আন্দোলনের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ওইদিনই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্রমূলক মামলা করা হয়। তিনি পুনরায় গ্রেপ্তার হন। বঙ্গবন্ধুসহ মোট ৩৫ জনকে এ মামলার আসামি করা হয়।
সাধারণ মানুষ বা প্রাকৃতজন এসব ঘটনার বিরুদ্ধেই থেকেছে বরাবর। সাধারণের রুখে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়েই আমাদের সাংস্কৃতিক সচেতনতা ক্রমাগত অগ্রসর হয়েছে; যা রাজনৈতিক আন্দোলনে জনগণকে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। পরে এ আন্দোলন আরও অগ্রসর হয় ১৯৬৯ সালে। স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ প্রবল রূপ ধারণ করে। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করে। ৬ দফায় যে সীমাবদ্ধতাগুলো ছিল, তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় ১১ দফা কর্মসূচি। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভিত্তি ছিল বলেই এ রাজনীতি আপামর জনগণের মাঝে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। উনসত্তরের গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিতে পেরেছে।

এখানে আরেকটি কথা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যে ইতিহাস লেখা হয়, সেখানে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের কথা খুব কমই উঠে আসে। এটি ইতিহাসকে খণ্ডিত করে, বিকৃত করে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, তৎকালীন পূর্ব বাংলায় যে জাগরণ ঘটেছিল, তা সমগ্র গ্রামগঞ্জজুড়ে বিস্তৃত হয়েছিল। যখন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লেখা হয়, তখন গ্রামাঞ্চলে ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নে মানুষ কীভাবে সংঘবদ্ধ হয়েছিল, সে বিষয়ে প্রায় কিছুই বলা হয় না। ইতিহাস বইগুলোয় বড়জোর মহকুমা শহরগুলোর কথা কিছুটা বলা হয়। কিন্তু সারা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যদি সংঘবদ্ধতা তৈরি না হতো, তাহলে তা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারত না।

নিজে গ্রাম এলাকার একজন প্রাকৃতজন হিসেবে দেখেছি, গ্রামগঞ্জের মানুষের মধ্যে ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। তা না হলে কোনোমতেই আমরা স্বাধীনতার উপকূলে পৌঁছাতে পারতাম না। সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক সংগ্রাম বিস্তৃত হওয়ার কারণেই ষাটের দশকেই গ্রামগঞ্জের মানুষ ‘পাকিস্তান চাই না’ বলতে শিখে যান।

১৯৬৯ সালের কথা। আমি তখন শহরে শিক্ষকতা করতাম। গ্রামে ফিরলে সেখানকার সাধারণ মানুষজন বলছিলেন, ‘তুমি তো শিক্ষিত মানুষ। তুমি হিন্দুস্তানে যাও না কেন? তোমাদের মতো শিক্ষিতরা হিন্দুস্তানে গেলে তারা আমাদের সাহায্য করবে। আমরা পাকিস্তান থেকে মুক্ত হতে পারব।’
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এতে শুধু শহুরে মানুষই নয়, গ্রামগঞ্জের প্রাকৃতজনেরাও বিপুল পরিসরে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালেই গ্রামের সাধারণ মানুষ পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছিলেন। অথচ ইতিহাস বইয়ে তা কখনও লেখা হয় না। এ গণআন্দোলনের বিষয়টি জনগণ তথা প্রাকৃতজনের চোখ দিয়ে দেখতে হবে। তখনই কিন্তু সাধারণ মানুষ নিজেদের পাকিস্তান থেকে পৃথক করতে শুরু করেন।

আইয়ুব খানের পতনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন আরেক সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান। তবে তিনি নির্বাচনের কথা মেনে নিলেন। এ নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় আমাদের অধিকারের পথ সুগম করেছিল। আর যখন ন্যায্য অধিকার থেকে বাঙালিদের বঞ্চিত করা হচ্ছিল, তখন আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় আসে ২৫ মার্চের গণহত্যা, জনগণের প্রতিরোধ, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ; যা পূর্ণতা পায় দেশ স্বাধীনের মধ্য দিয়ে। আমরা তখন যে আন্দোলনটা শুরু করেছিলাম, সেটি মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলন। রাজনীতির মূলে রয়েছে সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাতেই রাজনৈতিক আন্দোলন চলেছে। সেই রাজনৈতিক আন্দোলনই একসময় আমাদের স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। বলা হয় রাজনীতিকরাই সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন এবং আমরা স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হয়েছি। এ কথা সত্য হলেও, এ সত্য আংশিক। পুরো সত্যটা হলো, আমরা একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করেছিলাম, যার হাত ধরে রাজনীতিকরা স্বাধীনতা আন্দোলনকে বলবতী করে তুলতে পেরেছিলেন। অন্যথায় সম্ভব হতো না। সাংস্কৃতিক আন্দোলন যে মানসিক ভিত তৈরি করে দিয়েছিল, তার প্রভাবেই রাজনৈতিক আন্দোলন ঘনীভূত হয় এবং স্বাধীনতা আন্দোলন সফল হয়।

ষাটের দশকে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেটিই আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনে এবং শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে আমাদের নিয়ে গেছে। কাজেই ষাটের দশককে আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে। তা না হলে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস আমাদের কাছে অবোধ্যই থেকে যাবে। v