প্রকৃতপক্ষে গীতিকার পরিবেশনা আসরকেন্দ্রিক এবং তা স্থান নির্বিশেষে নদীতীর, বাজার, গৃহস্থ বাড়ির আঙিনা প্রভৃতি স্থানে পরিবেশিত হতো। এর মধ্যে অধিকাংশ পালাই সারা রাত্রিব্যাপী গেয়। এর কারণ গীতমধ্যস্থ ধুয়া, যা দোহার কণ্ঠে পৌনপুনিক আবৃত্তি হতো। অন্যদিকে গীতের সুরগুলি ছিল দীর্ঘ লয়ের, উজান, ভাটিয়ালী, মুর্শিদী প্রভৃতি গ্রাম্য সুরে গেয়। এ সকল পালায় গায়েন গীতের আগে ও পরে ঘটনা চরিত্র বা পরিস্থিতি গদ্যে ব্যাখ্যা করতেন। উল্লেখ্য যে, গীতিকা-পালায় সচরাচর ধুয়া নির্দিষ্ট থাকে না। এ শ্রেণীর পালায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গায়েন কোনো বর্ণনামূলক অংশের গান ধরার সঙ্গে সঙ্গে, দোহারগণ তাতে অংশগ্রহণ করে। এ ফাঁকে গায়েন, নৃত্য বা হাবভাব প্রদর্শন করে অথবা স্বল্পক্ষণের জন্য অবসর নেয়। গীতিকা-পালায় দেখা যায়, চরিত্র অনুসারে সংলাপমূলক গীতগুলি কখনও কখনও গায়েন ও দোহারের মধ্যে কেউ কেউ ভাগ করে নেয়। এর ফলে তা নাট্যমূলক হয়ে ওঠে। ‘কাজলরেখা’ শ্রেণীর গীতিকায়, পায়েন গদ্যের অংশ পুরোটাই বলে, গানের ধুয়া ধরে দোহার। দোহার কর্তৃক উক্তি-প্রত্যুক্তির ব্যবস্থাও থাকে। তবে সে পাঁচালির ঠ্যাটার মতো হাস্যরস সৃজন বা ‘Paradox’ তৈরি করে না। পাঁচালির সঙ্গে গীতিকা-পালার পরিবেশনার পার্থক্য অনেক।
গীতিকার সরল অথচ সচল বর্ণনারীতির উৎকৃষ্ট নমুনা হিসেবে মহুয়ার বয়ঃসন্ধি কালের রূপ বর্ণনার এ অংশটুকু উদ্ধৃত হতে পারে—

ছয় মাসের শিশু কইন্যা পরমা সুন্দরী।
রাত্রি নিশাকালে তুমরা তারে করল চুরী।।
চুরী না কইর‍্যা হুমরা ছারা গেল দেশ।
কইবাম্ সে কন্যার কথা শুন সবিশেষ।।
ছয় মাসের শিশুকন্যা বচ্ছরের হৈল।
পিঞ্জরে রাখিয়া পঙ্খী পালিতে লাগিল।।
এক দুই তিন করি শুল বছর যায়।
খেলা কছরত তারে যতনে শিখায়।।
সাপের মাথায় যেমন থাইক্যা জ্বলে মণি।
যে দেখে পাগল হয় বাইদ্যার নন্দিনী।।
বাইদ্যা বাইদ্যা করে লোকে বাইদ্যা কেমন জনা।
আন্দাইর ঘরে থুইলে কন্যা জ্বলে কাঞ্চা সোনা।।
হাট্টীয়া না যাইত কইন্যার পায়ে পড়ে চুল।
মুখেতে ফুট্টা উঠে কনক চাম্পার ফুল।।

‘মহুয়া’র উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক অংশগুলি সংক্ষিপ্ত অথচ তাতে নাট্যসংলাপে বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।