- বিশেষ আয়োজন
- বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনার শক্তি
পদ্মার নাচন ও লছিমন গান
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনার শক্তি
নববর্ষ ১৪৩০

বাঙালির যে কোনো সামাজিক উৎসব বা পার্বণে নানা ধরনের পরিবেশনা উপস্থাপিত হয়। সুর ছাড়া এ দেশের কোনো আয়োজনই যেন পূর্ণতা পায় না। তাইতো আমরা দেখি নৌকাবাইচ, ছাদ পেটা কিংবা ভারী মালামাল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহনের সময় সুরই শক্তি হয়। আমাদের সামনে নতুন প্রশ্ন বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তিনির্ভর এই সমাজে বাঙালির হাজার বছরের পরিবেশনা টিকে থাকবে কি না? এর উত্তর সন্ধানের প্রয়োজনে আমরা বাংলাদেশের দুটো পরিবেশনা পদ্মার নাচ ও লছিমনকে নমুনা হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।
জারিগান, অষ্টক গান, সারিগান, পদ্মার নাচন, বেহুলার নাচাড়ি, পুথিপাঠ, রামায়ণ গান, গম্ভীরা, আলকাপ গান, পুতুল নাচ ইত্যাদি আপনশক্তিতে টিকে আছে। বাঙালির সংস্কৃতিতে শাসকের প্রভাব আছে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। প্রাচীন সময় থেকে যারা এ দেশে বাণিজ্য ও শাসনের জন্য এসেছে তারা প্রচলিত জীবনাচরণ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে নতুন সংস্কৃতি নির্মাণ করেছে। যার ফলে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনকলায় বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশে নগরায়ণের যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে উয়ারী-বটেশ্বর, মহাস্থানগড় প্রাচীন নগর হিসেবে বিবেচিত। এই নগরসমূহে পরিবেশনা শিল্পকলার প্রচলন ছিল তার প্রমাণ টেরাকোটাসমূহ থেকে পাওয়া যায়। মোগল শাসনামলে ঢাকা নগর হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে– সে সময়ে ঢাকায় সংগীত, নৃত্য ইত্যাদির পরিবেশনার তথ্য পাওয়া যায়। ব্রিটিশ আমলেও ঢাকার নতুন মধ্যবিত্ত সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা শাসকের সংস্কৃতির পোষকতা করতেন। পাকিস্তান আমলে ভাষা-আন্দোলনের পরপরই বাঙালি নিজ সংস্কৃতি রক্ষার উদ্যোগ নেয়। এ সময় পাকিস্তানি শাসকের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে নাগরিক মানুষ। এ সময় বাঙালির সঙ্গী হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছায়ানটের উদ্যোগে বর্ষবরণ শুরু হয়। স্বাধীনতার পরও বাঙালি এই সাংস্কৃতিক পরিবেশনাকে আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করেছে। রাজধানীর সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষেরা যেন নিজের বা পূর্বপুরুষের নববর্ষ উদযাপনের আনন্দ ভোগ করতে রমনায় যায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থবছর বিবেচনা করা হয় জুলাই থেকে জুন। অথচ বৈশাখে নগরের ব্যবসায়ীরা হালখাতার আয়োজন করে। আধুনিক নগরে কৃষির প্রভাব না থাকলেও গ্রামীণ জীবনের অভিজ্ঞতায় হালখাতা করা হয়।
নাগরিক জীবনাচরণের কারণে ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনা জনপ্রিয় হতে পারেনি। বাড়ির উঠোনে এই পরিবেশনার আয়োজন করা হয়, নগরের ইট-কাঠের ভবনগুলোতে উঠোনের জায়গা থাকে না। কৃত্রিম ব্যবস্থাই তখন ভরসা। আবার পরিবেশনকারী কিন্তু নগরের অধিবাসী নন। দ্বিমাত্রিক গণমাধ্যমের জনপ্রিয়তার এই কালেও সাধারণের কাছে ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনা দুর্বল হয়ে যায়নি। ‘পদ্মার নাচন’ ও ‘লছিমন গান’ পরিবেশনার শক্তিতেই জনপ্রিয়।
কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা, মিরপুর ও দৌলতপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে মনসমঙ্গলের কাহিনি অবলম্বনে ‘পদ্মার নাচন পরিবেশিত হয়। নৃত্য, গীত, বর্ণনা এবং সংলাপ ও প্রতিসংলাপের মাধ্যমে এই পরিবেশনা উপস্থাপিত হয়। রোগবালাইসহ নানা বিপদ থেকে মুক্তির জন্য এর আয়োজন করা হয়। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ গ্রামের নজরুল ইসলাম (৬০) বলেন যে, এই পালা আয়োজিত হলে শরীরের ঘা থেকে সুস্থ হওয়া যায়। আবার অনেকে নতুন ব্যবসা শুরু করছেন। কিংবা ব্যবসা থেকে আয়-রোজগার হচ্ছে না তাহলে তিনি এই পালা আয়োজন করে থাকেন যাতে তাঁর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে। এই পরিবেশনা শুধু বিনোদন নয় কৃত্য হিসেবে পরিবেশিত হয়। কুষ্টিয়া অঞ্চলে এর প্রচলন সম্পর্কে রেজাউল হক সলক বলেন, “পাবনা থেকে এই পরিবেশনা কুষ্টিয়াতে নিয়ে আসেন মিরপুরে কেউপুর গ্রামের রিয়াজউদ্দিন মালিথা। আবার কারও মতো এই অঞ্চলে পদ্মার নাচন প্রবর্তন করেন লাল চাঁদ ও কালা চাঁদ। বংশপরম্পরায় এই পরিবেশনা কুষ্টিয়া অঞ্চলে পরিবেশিত হয়। বর্তমানে রিয়াজউদ্দিন মালিথার বংশধরদের মধ্যে হোসেন আলী ও চঞ্চল ফকির এই পরিবেশনা অব্যাহত রেখেছেন।” কুষ্টিয়া জেলায় ত্রিশের অধিক পদ্মার নাচনের দল আছে। এ থেকে অনুমান করা যায় এই পরিবেশনাটি কুষ্টিয়া জেলায় কতটা জনপ্রিয়। মনসামঙ্গলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনা প্রচলিত। যার সবগুলোই সংশিষ্ট অঞ্চলে জনপ্রিয়। রাজবাড়ী জেলায় বর্ষাকালে গ্রামে ‘মনসার গান’ নিয়মিত পরিবেশিত হয় সাপের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। মনসাকেন্দ্রিক বাংলাদেশে প্রচলিত উল্লেখযোগ্য পরিবেশনাসমূহ হচ্ছে–‘পদ্মপুরাণ গান’, ‘রয়ানি’, ‘মনসার পাঁচালি’, ‘ভাসান গান’, ‘বিষহরির গান’, ‘বেহুলার নাচাড়ি’, ‘ভাসান যাত্রা’, ‘মনসার ভাসান যাত্রা’, ‘মনসার ঢপযাত্রা’ ইত্যাদি। সাধারণত মানতের জন্য ‘পদ্মার নাচন’ পালা আয়োজিত হয়। ‘পদ্মার নাচনে’র পুরো পালার জন্য সাত রাত সাত দিন সময় প্রয়োজন। পরিবেশনাটি সাত পর্বে বিভক্ত। পর্বসমূহ হলো : ১. শিব ও পার্বতীর পালা, ২. পদ্মার পালা, ৩. বাজার পালা, ৪. বিয়ের পালা, ৫. মৃত্যুর পালা, ৬. ঘাটের পালা ও ৭. জিয়দানের পালা। এই পূর্ণাঙ্গ পরিবেশনাকে আয়োজনকারীর ইচ্ছা ও ক্ষমতা অনুসারে ছোট-বড় করা হয়। অনেক সময় এক দিনের জন্য আয়োজন করা হয়। আবার তিন দিনের পালাও আয়োজন করা হয়। পালার সময়সীমা নির্ধারিত হয় আয়োজকের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে। পুরো পালা ব্যয়বহুল তাই অনেকে এক দিন, তিন দিন বা পাঁচ দিনের পালা আয়োজন করে। সাধারণত রাতের খাবারের পর পালা শুরু হয়, মধ্যরাতে পালা শেষ করা হয়। ভোরবেলা শুরু হয়ে দুপুর পর্যন্ত পালা পরিবেশিত হয়।
‘পদ্মার নাচন’ যেন এ দেশের পরিবার ও সমাজে নারীর টিকে থাকার লড়াইকে প্রকাশিত করে। কুষ্টিয়ার বহলবাড়িয়ার এই পরিবেশনা উপভোগকালে পুরুষের চেয়ে নারী দর্শকের সংখ্যা বেশি দেখা গেছে। পদ্মার নাচন পরিবেশনার জন্য বাড়ির উঠোনে কিংবা বাড়ির সামনে খোলা স্থানকে বেছে নেওয়া হয়। আবার কোথাও কোথাও মন্দিরের চাতালে পদ্মার নাচন পরিবেশিত হয়। ভূমি সমতল মঞ্চে ‘পদ্মার নাচন’ পরিবেশিত হয়। এজন্য আলাদা মঞ্চ তৈরি করতে হয় না। দর্শকের জন্য চেয়ার বা ত্রিপলের ব্যবস্থা থাকে। আবার কোথাও কোথাও দর্শক নিজেই বসার উপকরণ সঙ্গে নিয়ে আসেন। কোনো কোনো পরিবেশনায় দর্শক অর্থের বিনিময়ে চেয়ারে বসে উপভোগ করে।
দিনে আসর আয়োজিত হলে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা হয় না, সূর্যালোকে পালা পরিবেশিত হয়। রাতের বেলা আসর হলে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা হয়। হ্যাজাকের আলো অথবা হ্যালোজেন বাতি দুই পাশে লাগিয়ে পরিবেশন স্থানকে আলোকিত করা হয়।
‘পদ্মার নাচন’ পরিবেশনার কোনো লিখিত পাণ্ডুলিপি নেই, অভিনেতা কতকক্ষেত্রে নিজে সংলাপ রচনা করেন। একই দলের একটি পরিবেশনার সঙ্গে অন্য পরিবেশনার মিল নেই। পরিবেশনকারী ইম্প্রোভাইজেশনের মাধ্যমে সংলাপ তৈরি করেন, আবার সংলাপ প্রক্ষেপনের ক্ষেত্রেও দুটি পরিবেশনায় ভিন্ন চিন্তাপ্রসূত হয়ে প্রক্ষেপন আলাদা হয়ে যায়। এ বিষয়ে পরিবেশন দলের সদস্য বলেন, “আমরা পালার সময় দর্শকের কথা ভাবি, দর্শকের মনের কাছে যেতে চাই, তাই তাদের খুশি করার জন্য সংলাপ ও গানের শব্দ বদলে দেই।”
অভিনেতার উড়নি/গামছা আর মূল গায়েনের চামরই এখানে নানা রূপে ব্যবহৃত হয়। চাঁদ সওদাগর যখন দাই-এর বাড়িতে যায় তখন তিনি শূন্য স্থানকে বাড়িতে রূপান্তরিত করেন। অথবা বেহুলা-লক্ষিন্দরের লোহার বাসর ঘর দেখানোর জন্য পরিবেশনস্থানের বদল ঘটানো হয় না। তারা মঞ্চে শুয়ে থাকেন। আলো কমানো বা বাড়ানো হয় না। অভিনেতার অভিনয় কৌশলের কারণে শূন্যস্থান বাসর ঘরে রূপান্তরিত হয়।
‘পদ্মার নাচন’ বাঙালির বর্ণবিভক্ত সমাজে সকল শ্রেণির আরাধ্য দেবতার সন্ধান করেছে। নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে দর্শকের ভাবনায় নতুন প্রশ্ন তৈরি হয়। অল্পবয়সী গৃহবধূ বেহুলা ফিরিয়ে আনে স্বামী ও পরিবারের অপর সদস্যদের, চাঁদ সওদাগর এখানে নিষ্ক্রিয়। বেহুলার এই পরিবারকে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে সমাজে নতুন প্রশ্ন তৈরি হয়। বাঙালির জীবনে নারী আপন ক্ষমতা নিয়ে উপস্থিত। যা কিনা প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধে দ্রোহ।
লছিমন গানের সন্ধান পাওয়া যায় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। এই পালা সিরাজগঞ্জ-পাবনা-কৃষ্টিয়া অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়। এর আশেপাশের জেলায়ও এই পরিবেশনা জনপ্রিয়। গীত-নৃত্য ও অভিনয়ের সংযেগে এই পালা পরিবেশিত হয়। ২০২৩ সালের মার্চে শাহজাদপুর উপজেলার ডায়া গ্রামের লছিমন দলটি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আমন্ত্রণে পরিবেশনা উপস্থাপন করেছে। এই দলে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছে। তবে তাঁতপ্রধান এলাকা বলে তাঁতশ্রমিক, মালিক ও ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশি। বিভিন্ন সামাজিক উৎসবে দলটিকে আমন্ত্রণ করা হয়। প্রধানত প্রেমকে কেন্দ্র করে এই পালার কাহিনি গড়ে উঠেছে। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনীতি ও সমকালীন সমাজ। পরিবেশনকারী সমাজের অন্যায় ও অসংগতিকে দর্শকের সমুখে তুলে ধরে। লছিমন পালায় পুরুষেরা নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। এ ক্ষেত্রে তারা নারীর পোশাক পরিধান করেন। এই পালায় প্রধান কাজ করে ওস্তাদ। মঞ্চের একপাশে তিনি বসে থেকে সংলাপ বলে যান। মৌখিক রীতির এই পরিবেশনায় ওস্তাদের কাছে কোনো লিখিত পাণ্ডুলিপি থাকে না। তিনি স্মৃতি থেকে সংলাপ বলে যান।
লছিমন গানে আলাদা বাদ্যযন্ত্রীদল থাকে। এখানে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে অক্টোপ্যাড, সানাই, কিবোর্ড, ঢোল ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। এই পরিবেশনার জন্য ভূমি থেকে উঁচু মঞ্চ তৈরি করা হয়। কেননা, এই পরিবেশনায় বিপুল দর্শক উপস্থিত থাকে। আসর বন্দনার মাধ্যমে পালার সূচনা হয়। এই পালায় ভারী রূপসজ্জা করা হয়। মঞ্চে একটি চেয়ার থাকে, তাকে নানাভাবে ব্যবহার করেন পরিবেশনকারীরা। লছিমনের ক্ষেত্রে গানই প্রধান উপজীব্য। তবে এই পরিবেশনায় শব্দযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। লছিমন গান সাধারণত রাতে শুরু হয়। কেননা, এই সময় গ্রামের অধিবাসীরা নানা কাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরে আসেন। তাই দলের জন্য দর্শক পেতে সমস্যা হয় না। স্থানীয় অধিবাসী সজীব সরকার জানান সাধারণত এশার নামাজের পর এই গান শুরু হয়। ফজরের নামাজের কিছু আগে শেষ করা হয়। আলোর ক্ষেত্রে বিশেষ আলো নয়, হ্যালোজেন লাইটে আলোকিত হয় আসর। এই পালায় বাস্তবরীতির অভিনয় প্রধান। যে শিল্প মানুষের প্রাণে আশ্রয় নিয়ে থাকে তার বিনাশ হয় না। হয়তো সময়ের প্রেক্ষাপটে তার গতি শ্লথ থাকে কিন্তু প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জনগণের শিল্প টিকে থাকবে। তাই আকাশ সংস্কৃতি কিংবা অন্তর্জালের বিপুল বিস্তারী প্রভাবের এই কালেও আপনশক্তিতে ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনা টিকে থাকবে।
লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক
বিষয় : নববর্ষ ১৪৩০ তানভীর আহমেদ সিডনী
মন্তব্য করুন