- বিশেষ আয়োজন
- পরম্পরা: সত্যপীর
পরম্পরা: সত্যপীর

পীরবাদের উৎস সপ্তম অষ্টম শতকের ইরান, ইরাক ও সিরিয়া। ইসলামে মরমীবাদের উদ্ভবের ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণের বাঁধাধরা প্রথার ক্ষেত্রে সৃষ্টি ও স্রষ্টার সম্পর্ক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পুনরাবিষ্কৃত হলো। মরমীবাদ, যা সুফীতত্ত্ব নামে পরিচিত তাতে স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক ‘মাশুক’ ‘আশক’ বা ‘আশেক’ও প্রেমাস্পদের সম্পর্ক। পরবর্তীকালে এই নব্য ধর্মতত্ত্ব পীর-দরবেশ ও তাঁদের অনুসারীদের দ্বারা ভারতবর্ষে প্রচারিত হলো।
বাঙলায় নাথপন্থীদের কঠোর তপস্যা, কঠিন আত্মনিগ্রহমূলক বৈরাগ্য ও অতিলৌকিক ক্ষমতার কল্পকথা প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালী মানসে ছিল দৃঢ়মূল। প্রচলিত ধর্মসংঘের বিরুদ্ধে উদ্ভূত নাথসিদ্ধান্তের সহজিয়াপন্থা সেকালে শুধু বাঙলায় নয়, সর্বভারতেও ব্যাপ্তি লাভ করেছিল।
সুফীতত্ত্বের ধারায়, হলকায়ে জিকির, ধ্যানমগ্নতায় আত্মার নানা রূপদর্শনের প্রয়াসের সঙ্গে বাঙালীর নিজস্ব দর্শন সংখ্যযোগতন্ত্রের একটি গভীর মিল আছে।
সপ্তদশ শতকে বাঙলায় পীরপূজাকেন্দ্রিক পাঁচালির উদ্ভব। সুফীতত্ত্বের পীর আধ্যাত্মিক গুরু এবং তিনি আত্মিক বিকাশের ক্ষেত্রে, স্রষ্টার ‘দিদার’ লাভে শরণাগতের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু বাঙলা পীরপাঁচালি কাব্যে যেসকল পীর- দরবেশের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তাদের জীবনকথা, অলৌকিক ক্ষমতা, হিংস্রতা ও ভক্তবাৎসল্যের রূপ, মঙ্গলকাব্যের পূজালোভী দেবদেবীর তুল্য।
পীরপাঁচালি মূলত অসাম্প্রদায়িক মনের সৃষ্টি। পীরের ‘সেবা’ ‘হাজোত-মানোত’ প্রভৃতি কৃত্যে হিন্দু মুসলমান সকলেরই সমান অধিকার। এ-শ্রেণীর পাঁচালিতে হিন্দু-মুসলিম পুরাণের একটি সমন্বিত রূপ আবিষ্কারের প্রয়াস আছে। সকল পীরগাথায় তাই ধর্মীয় ভেদবুদ্ধির ঊর্ধ্বে আমাদের লোকমানসের একটি বিশিষ্ট দিকের পরিচয় লভ্য। আধুনিককালের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার উত্থানের কালে, পাঁচালিকাব্যের এই ক্ষয়িষ্ণু ধারাতেই সাম্প্রদায়িক ঐক্যের এক নিগূঢ় সঙ্কেত পাওয়া যেতে পারে। পীরগাথাগুলি আমাদের সমাজ-মানসের সাংস্কৃতিক-নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনের সাক্ষ্যবাহী।
ঐ সত্যপীর ব্রতকথায় পীরের সিন্নি নিয়ে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের ধনবান হবার কাহিনী আছে। ১ সত্যপীরের কাহিনী অবলম্বনপূর্বক সর্বপ্রথম কাব্যরচনা করেন। ‘গোরক্ষবিজয়’ ও ‘গাক্ষীবিজয়ে’র রচয়িতা শেখ ফয়জুল্লাহ। এরপর এ ধারায় অজস্র কবির সাক্ষাৎ মেলে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন, ভৈরব ঘটক, ঘনরাম চক্রবর্তী, রামেশ্বর চক্রবর্তী, ফকির গরিবুল্লাহ, শ্রীকবিবল্লভ, দ্বিজরামকৃষ্ণ, তাহির মাহমুদ প্রমুখ। কোনো কোনো কবি উনিশ শতকেও সত্যপীরের কাহিনী রচনা করেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন ফৈজুল্লা। ২ ভারতচন্দ্র ‘সত্যপীরের ব্রতকথা” ও ‘সত্যনারায়ণ মাহাত্ম্যকথা’ রচনা করেন।
শ্রীকবিবল্লভ রচিত সত্যনারায়ণের পুঁথি আসলে ‘মদনসুন্দরের পালা’। এ কাব্যে বাণিজপুত্র মদন ও রাজকন্যা কুন্তলার প্রণয়কাহিনী রূপকথা ধরনের।
সদানন্দ ও বিনোদ সদাগর রাজার ‘আঙ্গায়’ ‘মধুকর’ সাজিয়ে সফরে যাবার কালে ছোট ভাই মদনের উপর দুই স্ত্রী সুমতি ও কুমতির দায়িত্ব অর্পণ করল। সুমতি কুমতি শিবপূজা দিতে গিয়ে একদিন ‘খোদা’ অর্থাৎ সত্যপীরের দেখা পেল। সত্যপীরের যেন বালকৃষ্ণেরই প্রতিমূর্তি—
সুমতি বলেন দিদি হর দেখ চায়্যা। অপূর্ব্ব ফকির এক আছে দণ্ডাইয়া।।
বয়েস প্রবিন নয় বৎসর বারর।
নবদল শ্যাম যেন নন্দের কিশোর।।
সত্যনারায়ণ তাদের বললেন ‘হও পুত্রবর্তী’।
স্বামীর অবর্তমানে তারা পুত্রবতী হবে কি করে ?
তারা বলে হেন কি পুরিব মনোরথ।
ভেগে ভগে জন্ম কি হইব ভগীরথ।।
‘ছেণ্ডা কাঁথা গায়’ ফকিরকে দেখে তারা অবজ্ঞা করে—
ফকীরের পানে ঘন চাহে দুই জায়।
কোথাকার ফকীর দেখ শিব হতে চায়।
তারপর—
হর হরি এক তনু বেদে ইহা কয়।
ফকিরে কহেন আমি সেই মৃত্যুঞ্জয়।।
মধ্যযুগে বিভিন্ন পীরের পূজা বা সেবা-কেন্দ্রিক ব্রতকথা ও কৃত্যমূলক- পাঁচালির উদ্ভব ঘটে। এই পীরদের মধ্যে কেউ কেউ বাস্তবে বিদ্যমান ছিলেন, আবার কেউবা লোকমানসের উদ্ভাবনা। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, সত্যপীর, গাজীপীর, মানিকপীর, খোয়াজখিজির, বড়পীর, মাদারপীর প্রমুখ।
সেলিম আল দীন রচিত ‘মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য’ গ্রন্থ থেকে গৃহীত।
বিষয় : সত্যপীর নববর্ষ ১৪৩০
মন্তব্য করুন