
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে সংস্কৃতির যে বেহাল দশা, তাতে সমন্বয় ও রূপান্তর অনিবার্য। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বাঙালি সংস্কৃতি সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই সমন্বয় ও রূপান্তরের ধারায় বিকশিত হয়ে আসছে। আর্যভাষীদের সংস্কৃতিকে সমন্বিত হতে হয়েছিল অস্ট্রিক, দ্রাবিড়ভাষীদের সংস্কৃতির সঙ্গে। এই সমন্বিত সংস্কৃতি রূপান্তরের ধারায় বিকশিত হলে পরবর্তীকালে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম-সংস্কৃতির সঙ্গে সমন্বিত হয়। সেন যুগ পর্যন্ত বাংলায় সেই সংস্কৃতির ধারাই বাঙালির চর্যাচর্য জীবন পদ্ধতি, উৎপাদন ব্যবস্থা ও কৃত্য-আচার, লোকাচার, ব্যবহারিক সামগ্রী, বিশ্বাস, সংস্কার, কুসংস্কার, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, বাস্তুকলা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সূচিশিল্প, বয়নশিল্প ইত্যাদি জীবন ধারণের উপকরণের সমন্বয়ে বাঙালি সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল। বাঙালি সংস্কৃতি অবশ্য পাল যুগেই পূর্ণরূপ পরিগ্রহ করে। মুসলিম বিজয়কালে ইসলাম ধর্ম-সংস্কৃতির সঙ্গে প্রথমে তুর্কি, আফগান, পরে মোগলদের, অর্থাৎ মধ্য এশিয়া থেকে আসা তুর্কি, আরবি, আফগান, পারস্য সংস্কৃতির সঙ্গে সমন্বয় সাধনের মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি মধ্যযুগ পর্যন্ত বিকশিত হয়। অষ্টাদশ শতকে পুনরায় ইংরেজ ঔপনিবেশিককালে বাঙালি সংস্কৃতিকে ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সমন্বিত হতে হয়েছে।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে বিভিন্ন শাসনতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আরম্ভ হলে মধ্যযুগ পর্যন্ত বিকশিত বাঙালি সংস্কৃতি ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে আর একবার রূপান্তরিত হলো। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান আন্দোলন থেকে ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত সময়ে আবার সাংস্কৃতিক বাঁক পরিবর্তনের কাল। এ সময় মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিকের উপযোগী মুসলমানি কায়দাদুরস্ত শেখার দিকে বাঙালি মুসলমানরা ঝুঁকে পড়লে অল্পদিন সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। মুসলমানদের রচিত উনিশ শতক ও বিশ শতকের পাঁচ দশকের সাহিত্য, তাঁদের সম্পাদিত পত্রিকা দ্রষ্টব্য। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ পরবর্তী বাংলাদেশ স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য সংস্কৃতিকে ভিত্তি ধরলে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা ভিন্ন মাত্রা পায়। এই সময় থেকে খ্রি. ২০০০ শতক অবধি সাংস্কৃতিক প্রবাহ অভিন্ন খাতবাহী ছিল। বিশ্বায়নের যুগে সংস্কৃতি এমন এক সংকটের মুখোমুখি উপনীত হয়, যা থেকে উত্তরণের উপায় সমন্বয় ও রূপান্তর। দুই দশকের অধিককাল ধরে এই সংকটকাল অতিক্রম করছে বাঙালি। একুশে ফেব্রুয়ারি ও পহেলা বৈশাখ এলে প্রসঙ্গটি সম্মুখে চলে আসে। আমরা ভাবিত হই। কিন্তু সমস্যা দূরীকরণে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করি না।
বৈশাখে আমাদের সাংস্কৃতিক বোধ নবচেতনায় জাগ্রত ও উদ্দীপিত হয়। সংবৎসর সংস্কৃতির প্রতি দায়দায়িত্বহীন আমরাই বৈশাখে বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষায় মুড়কি-মোয়া, মঙ্গল কলস, নকশি হাঁড়িকুঁড়ি, কাস্তে, কোদাল, শোভাযাত্রা ইত্যাদি নিয়ে গেরুয়া পোশাকে ‘এসো হে বৈশাখ’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ঝাঁপিয়ে পড়াটা দোষের নয়, উৎসব তো বছরের সব দিন নয়, একদিন; তাই তো হবার কথা। তা নিয়ে কথা নয়; কথা এই একদিনে সংস্কৃতি রক্ষা হয় না। সংস্কৃতির শুদ্ধতা, উৎকর্ষ সাধনও একদিনে সম্ভব নয়। সম্ভব নয় জাতীয় বৈশিষ্ট্যে তাকে সমৃদ্ধ ও সমুন্নত করা। ক্ষত তো আর প্রলেপ দিয়ে ঢাকা যায় না। এ কথার অর্থ বাঙালি সংস্কৃতির শরীরে দেখা দিয়েছে ক্ষত। বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের ক্ষত এবং বাঙালি স্বয়ং তার স্রষ্টা। তা সংস্কৃতির প্রতি আমাদের অকারণ অবহেলার ফল। আমাদের বসবাস অত্যাধুনিক স্থাপত্যকলার নিদর্শন সুন্দর একটি ভবনে। তাতে আলো-হাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। দুর্ঘটনা ঘটলে তা থেকে আত্মরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। বৈদ্যুতিক লাইন ত্রুটিপূর্ণ। বাড়ির সামনে দাঁড়াবার জায়গা নেই, ময়লাঝুলে পরিপূর্ণ, দেয়ালে পানের পিক, চুনের দাগ, কাগজের টুকরা, ফলের খোসা যত্রতত্র ছড়ানো, কাত হয়ে পড়ে আছে ডাস্টবিন, ঘরে কাপড়, আসবাব বিক্ষিপ্তভাবে রাখা। এটি রুচিসম্মত সংস্কৃতিবানের জীবন নয়।
আমি শিক্ষিত, কথা বলছি, তার একটি শব্দও নিরক্ষর মানুষের উচ্চারিত ভাষা বৈশিষ্ট্য থেকে আলাদা নয়। অর্থাৎ আমার ভাষা অশুদ্ধ। ক্রিয়ার কালের ঠিকঠিকানা নেই। আমি সংস্কৃতিবান এ দাবি করবার উপায় নেই। আমি একা এরূপ হলে আপনি সংস্কৃতিবান, আমি অসংস্কৃত। কিন্তু আমরা সবাই যখন কথা বলি বুঝবার উপায় নেই কে, শিক্ষিত, কে অশিক্ষিত এবং বুঝবার উপায় নেই আমাদের ভাষার একটা আদর্শ রূপ আছে। আমি কথা বলছি, কথা বলবার ফাঁকে একটি-দুটি শব্দ ইংরেজি বলে আমি কী বোঝাতে চাই, আমি অনেক ইংরেজি জানি? আমি তো আসলে ওইটুকুই জানি। এর চেয়ে শুদ্ধ বাংলায় চমৎকার বাচনভঙ্গিতে শ্রুতি সুন্দর করে কথা বলাই অধিকতর সংস্কৃতিসচেতন মানুষের কাজ নয় কি?
আমার একটা সেলফোন আছে, তাতে পৃথিবীর বহু ভাষা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। আমার মাতৃভাষাও রয়েছে। আমি একটি প্রয়োজনীয় সংবাদ লিখছি ইংরেজি অক্ষরে। মাতৃভাষার প্রতি এমনই শ্রদ্ধা যে, বাংলা বর্ণমালা আমার জানা নেই। এই অশ্রদ্ধা দ্বারা যে ভাষাকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে, সে বোধও আমার নেই। আমাকে বলা হলো– এই চিঠি বা দরখাস্তটা বাংলায় টাইপ করে আনো, আমি বললাম বাংলায়? অনেক কষ্ট। কষ্টের কারণ আমি বাংলা যুক্তাক্ষর চিনি না, সংযুক্ত শব্দের গঠন জানি না। আপনি আমাকে শিক্ষিত না বললে আমার কিছু করবার নেই।
আর একটি রোগ টেলিকমিউনিকেশন চর্চা। কী আছে সেখানে? সেটি বিচিত্র অ্যাপ ও সফটওয়্যারে ঠাসা– সে এক রহস্যময়ী স্বৈরিণী। নাটক, চলচ্চিত্র, সাংকৃতিক ঐতিহ্যের নিদর্শন, খেলাধুলা, সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপন, পর্ণগ্রাফি, কার্টুন, কোরআন, গীতা, বাইবেল, ক্যামেরা, অডিও, ভিডিও করার ব্যবস্থা– মানুষের ব্যবহারিক জীবনে, জাগতিক ও মহাজাগতিক এমন কিছু নেই, যা এই রহস্যময়ী স্বৈরিণীর মধ্যে নেই। আরও আছে নিও মিডিয়ার যাবতীয় অ্যাপ। এত ক্ষমতা যার একমুঠোয়, সে তো স্বাভাবিক কিছু নয়। এই অস্বাভাবিক চর্চা এখন মাদকসামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। সেলফোন আসক্তি কারও কারও জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। মানসিক স্বাস্থ্য সংকট দেখা দেওয়ায় অনেক অভিভাবক সন্তানকে নিয়ে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হচ্ছেন। সেলফোন শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের অসামাজিক করে তুলছে। সকল সময় তারা একাকী থাকতে পছন্দ করছে। মেজাজ খারাপ থাকে সকল সময়, দুর্ব্যবহার করে। সামাজিক মেলামেশা না করায় তারা অসামাজিক হয়ে পড়ছে। ভার্চুয়াল বন্ধু ছাড়া তার কোনো বন্ধু নেই। দুঃসময়ে ভাববিনিময়ের কেউ না থাকায় চরম একাকিত্বের শিকার হয়ে হতাশায় ভুগছে, কেউ কেউ আত্মহত্যা করছে। এই অবস্থা নিশ্চয়ই বিপন্নাবস্থা। নিশ্চয়ই এই বিপন্নাবস্থা জাতীয় ও সামাজিক জীবনে সাংস্কৃতিক সংকট সৃষ্টি করছে এবং ভবিষ্যতে এর প্রকোপ আরও বাড়বে। আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে মান্যতার অভাব, অবিশ্বাস, সন্দেহ, প্রতারণার মানসিকতা, অবিবেচনা ইত্যাদি নষ্ট মূল্যবোধ; যা দূর হওয়া অত্যাবশ্যক।
এই দুঃসময়েও দেখা যায়, বৈশাখের রং বদল ঘটছে। জাতির চিত্তের সমস্ত রং এই একটি মাত্র সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক উৎসবের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করায় তার অভিব্যক্তি পেয়েছে চোখ ধাঁধানো রূপ। এর মধ্য দিয়েই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে সংস্কৃতির নানামাত্রিক ভাঙচুর। অবশ্য সে ভাঙচুর দীর্ঘদিন ধরেই চলছে জীবনের, সমাজের সর্বত্র এবং আমাদের নানাজনের কথাবার্তায়, মত-মন্তব্যে তা জানবার অবকাশও জুটেছে। ‘সংস্কৃতির আজ বেহাল দশা। আমাদের উচ্চারণে, আচরণে, আচার-ব্যবহারে, চালচলনে আগের সে শুদ্ধতা, শিষ্টতা, রুচির পরিশীলন অনুপস্থিত। অনুপস্থিত মায়া-মমতা, মানবিকতা। এভাবে সব বদলে যাচ্ছে। কী হবে শেষে!’ এ দুর্ভাবনা তো আছেই, তার সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের বিশেষত ষোল থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সসীমার তরুণ-তরুণীদের নিয়ে দুশ্চিন্তার অবধি নেই। তাদের সমস্ত আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখছেন অভিভাবক মহল, সমাজের নিয়ন্তারা। তারা একাকী থাকতে পছন্দ করছে, সামাজিক-পারিবারিক কর্মকাণ্ডে আগের মতো তাদের পাওয়া যাচ্ছে না, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও তারা কাঙ্ক্ষিত আচরণ করছে না। নেশাগ্রস্ত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে; শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের মাত্রাতিরিক্ত সেলফোন আসক্তি, বিকৃত উচ্চারণে কথা বলা, লেখাপড়ায় অনাসক্তি, হতাশা, আত্মহত্যার প্রবণতা, বিবাহবিচ্ছেদ, ধর্মীয় সন্ত্রাসে আসক্ত হয়ে পড়া– এত সব সমস্যা হালের জাতীয় সমস্যার অন্যতম। অগ্রজ প্রজন্ম দেশ-জাতির অন্ধকার ভবিষ্যৎ ভাবনায় দিশেহারা। আমাদের বিবেচনায় এসবের নিশ্চয়ই সুনির্দিষ্ট হেতু বিদ্যমান। সকলের জানা সেই কারণগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় পুনর্বার আলোচনা করা যায়।
তরুণ সমাজের দিকভ্রান্তির কারণগুলোকে এভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে–
ক) বাজার অর্থনীতি প্রভাবিত বৈশ্বিক আর্থরাজনৈতিক অস্থিরতা।
খ) জাতীয়-আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্যে বিচিত্র নামা মাদকের অবাধ
বাজারে পরিণত হওয়া।
গ) ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত বেকার সৃষ্টি।
ঘ) ভার্চুয়াল দুনিয়ার বিভিন্ন কুপ্রভাব।
ঙ) তরুণ সমাজের জন্য সরকারের কোনো তাৎপর্যপূর্ণ কর্মসূচি না থাকা।
চ) পরিবর্তমান সমাজব্যবস্থার অবক্ষয়কালীন নানামুখী দ্বন্দ্ব ও বিশ্বসন্ত্রাস।
ছ) উদ্দেশ্যহীন ছাত্ররাজনীতির ক্রমিক ব্যর্থতা।
ছ) অভিভাবকদের বিষয়নিষ্ঠা ও সন্তানদের প্রতি উদাসীনতা।
জ) শিক্ষা ব্যবস্থার অসারতা ইত্যাদি
বলা বাহুল্য, রচনার বিষয় তরুণ সমাজ নয়, বাঙালি সংস্কৃতির অবক্ষয় কালের করণীয় নির্ধারণ। যখন পূর্বতন সমাজব্যবস্থা ভেঙে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ভিতে শিল্প উৎপাদননির্ভর সমাজব্যবস্থা উঠতে যাচ্ছে, তখন সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে দেখা দিচ্ছে প্রচণ্ড অসংগতি। এবং তথ্যপ্রযুক্তির বহুল ব্যবহার তাকে আরও প্রকট করে তুলছে।
বাঙালি সংস্কৃতি আজ বিপুল ভাঙনের মুখে। ইতোপূর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি প্রাচীনকাল থেকে ঔপনিবেশিক কাল পর্যন্ত একমাত্র ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের সচেতন প্রচেষ্টায়ই বাঙালি সংস্কৃতি সামগ্রিক পরিবর্তনের প্রবল ও অনভিপ্রেত চাপে পড়ে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রতিটি শাসক রাজবংশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার কালে কেবল অনুসারীদের ধর্মীয় কৃত্যাদি ও পোশাকাদি, লোকাচারের পরিবর্তন পূর্বতন সংস্কৃতির প্রবাহে নতুন সংযোজন হিসেবে গৃহীত হয়েছে। পূর্বতন সংস্কৃতির মধ্যে বরাবরের মতোই চলেছে বৃহত্তর গণমানুষের জীবনযাপন। আমরা দেখেছি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ভারতবর্ষের হাজার বছরের উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে তাকে নতুনভাবে আত্মস্বার্থে বিন্যস্ত করে। সৃষ্টি করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশ ছিল চাকরিসর্বস্ব। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সৃষ্টি অভিজাত জমিদার শ্রেণির (অভিজাত?) ও মধ্যস্বত্বভোগীর সঙ্গে উপর্যুক্ত চাকরিসর্বস্ব মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানসদ্বন্দ্বের ফলেই বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের প্রবহমান ধারাটি প্রান্তিক ব্রাত্যজনের সংস্কৃতিরূপে টিকে যায়। ওপরের তলে স্থান করে নেয় ফরাসি বিপ্লব-পরবর্তী ইউরোপীয় জীবনচেতনার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা বিশ্বাস, বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, স্বাধীনতার স্পৃহা এবং দেশপ্রেমপ্রসূত উন্মূল ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি। উপনিবেশ-উত্তরকালেও সে ধারাটিই ছিল প্রবহমান।
সংস্কৃতির অপর সর্বব্যাপী পরিবর্তনটি ঘটমান। আমাদের একালে বিশ্বায়নের যুগে, মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাবে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো শিল্পায়নের যুগে প্রবেশ করছে। কৃষি অর্থনীতির ভিতে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বাণিজ্য অর্থনীতি। উৎপাদন ও বিপণনে বাংলাদেশ এখন বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভরশীল। পণ্যের অবাধ প্রবাহের দরুন দেশীয় বাজারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রকমারি ব্যবহার্য পণ্যের বিপুল সংগ্রহ চোখ ধাঁধায়। বিজ্ঞানের কল্যাণে যেমন বেড়েছে বিচিত্র সব ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে শৌখিন মনোহরণ দ্রব্যসামগ্রীরও উৎপাদন। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর সভ্যতার এ যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। মানুষের সব বিস্ময়কর আবিষ্কার এই তথ্যপ্রযুক্তির ফলে সভ্যতায় সূচিত হয়েছে নতুন অধ্যায়। বাংলাদেশও এখন এর আওতায়। উন্নয়ন সূচকের নানাবিধ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বেড়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার। জীবনমানের পরিবর্তন রুচি ও চিন্তার পরিবর্তন আনয়নে সহায়ক হয়েছে। আকাশসংস্কৃতির প্রভাবে সমগ্র বিশ্বের মানুষের পোশাকাদি, খাদ্যাভ্যাস, আচার-সংস্কার, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক, দাম্পত্য বিধি, শিক্ষা, বিনোদন, নৃত্য-সংগীত-শিল্প-সাহিত্য, চলচ্চিত্র ইত্যাদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ লাভ করেছে এ সময়ের বাঙালি। বৈশ্বিক এসব সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ বাঙালির জীবনে ইতোমধ্যে ঘনিষ্ঠ ও গভীর ছাপ ফেলেছে। দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গিয়ে অনৈতিক, অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন করতে কিংবা বস্তুটির মালিক হবার চেষ্টা করছে। ফলে সমাজে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। বস্তুত অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সূচিত পরিবর্তের ঢেউ লেগেছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের সর্বত্র। তন্মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে– অর্থনীতি, সামাজিক কাঠামো, ভাষা, শিক্ষা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, যোগাযোগ ব্যবস্থা, নারীর সামাজিক অবস্থান, মূল্যবোধ ইত্যাদি। সে পরিবর্তন সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের দাবিদার।
লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক
বিষয় : নববর্ষ ১৪৩০ লুৎফর রহমান
মন্তব্য করুন