বাঙালি জীবনের সঙ্গে মেলার যোগ দীর্ঘকালের। এই সম্পর্ক নিবিড় ও আত্মিক। লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতির সমন্বিত অন্তরঙ্গ পরিচয় মেলাতেই সার্থকভাবে প্রকাশিত। এই মেলা বা আড়ং-এর চালচিত্রের আভাস পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি থেকে। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে তিনি বলেছিলেন: ‘আমাদের দেশ প্রধানত পল্লীবাসী। এই পল্লী মাঝে মাঝে যখন আপনার বাড়ির মধ্যে বাহিরের বৃহৎ জগতের রক্তচলাচল অনুভব করিবার জন্য উৎসুক হইয়া উঠে, তখন মেলাই তাহার প্রধান উপায়। এই মেলাই আমাদের দেশে বাহিরকে ঘরের মধ্যে আহ্বান। এই উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়– তাহার হৃদয় খুলিয়া দান করিবার ও গ্রহণ করিবার এই প্রধান উপলক্ষ্য। যেমন আকাশের জলে জলাশয় পূর্ণ করিবার সময় বর্ষাগম, তেমনি বিশ্বের ভাবে পল্লীর হৃদয়কে ভরিয়া দিবার উপযুক্ত অবসর মেলা’ (‘আত্মশক্তি’)।

বাংলাদেশের মেলার ঐতিহ্য বহুকালের। কিন্তু তা যে কত পুরোনো, কবে এবং কীভাবে এর সৃষ্টি সে-সব তথ্য অজ্ঞাত। মেলার আদিবৃত্তান্ত না জানা গেলেও ধারণা করা চলে যে ধর্মীয় উপলক্ষেই এ দেশে মেলার জন্ম। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষ। কেউ কেউ মনে করেন, গ্রামীণ মেলা ছিল জমিদারদের উদ্ভাবিত ও পরিকল্পিত। কেননা এর সাহায্যে তাঁরা রোজগার বাড়াতেন (‘দেশ’, ৬ এপ্রিল ১৯৯১)। জমিদারদের পাশাপাশি লৌকিক উদ্যোগের কথাও স্মরণ করতে হয়। মেলার এই সমাবেশ ও বিকিকিনির প্রাথমিক ধারণা সম্ভবত গ্রামীণ হাট থেকেই এসেছিল। সেই অর্থে হাটই মেলার আদিরূপ।
    এবারে মেলার ধরন-ধারণের কিছু পরিচয় নেওয়া যাক। বাংলাদেশে প্রচলিত মেলার সংখ্যা কত তার সঠিক হিসাব পাওয়া ভার। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা যে জরিপ চালায় (১৯৮৩), অসম্পূর্ণ হলেও তা থেকে সাধারণভাবে বাংলাদেশের মেলার সংখ্যা, প্রকৃতি ও বৈচিত্র্য সম্পর্কে একটি খণ্ড চিত্র পাওয়া যায়। আশ্রাফ সিদ্দিকী তাঁর ‘লোকসাহিত্য’ বইয়ে গ্রামীণ মেলার জেলাওয়ারি তালিকা প্রণয়ন করেছেন। জেলা গেজেটিয়ার ও আঞ্চলিক ইতিহাসের গ্রন্থেও মেলার কিছু বিবরণ মেলে। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থার জরিপে মোট মেলার সংখ্যা বলা হয়েছে ১০০৫। এসব মেলার প্রায় নব্বই ভাগই গ্রামীণ মেলা। সারা বছরই দেশের কোনো না কোনো স্থানে মেলা বসে ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষে। এসব মেলার স্থায়িত্ব সমান নয়। একদিন থেকে এক মাস পর্যন্ত এর স্থিতিকাল। মেলার স্থান নির্বাচনে প্রাধান্য পায় নদীর তীর, গ্রামের বট-পাকুড়াশ্রিত চত্বর কিংবা খোলা মাঠ, মঠ-মন্দিরসংলগ্ন প্রাঙ্গণ, সাধু-সন্ত-ফকির-দরবেশের সাধনপীঠ বা মাজার, প্রসিদ্ধ পুণ্য ‘থান’ বা তীর্থক্ষেত্র। কখনো স্কুল-কলেজের চত্বর বা খেলার মাঠেও মেলা বসে থাকে। মেলা মানে উৎসব, বিনোদন, বিকিকিনি আর সামাজিক মেলামেশার এক উদার ক্ষেত্র। ধর্মাশ্রিত লৌকিক মেলার বহিরঙ্গে আছে ধর্মীয় উপলক্ষ ও প্রেরণা, কিন্তু এর অস্তিত্বে মিশে আছে বিনোদন ও ব্যবসায়ের ধারা। আসলে প্রায় সব গ্রামীণ মেলারই উৎস, উপলক্ষ ও প্রেরণার মূলে ধর্মীয় অনুষঙ্গ থাকলেও এর চারিত্র্য ধর্মনিরপেক্ষ, আর্থ-সাংস্কৃতিক চেতনার উদ্বুদ্ধ ও পরিচালিত।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মেলাই ধর্মীয় উপলক্ষে প্রবর্তিত। হিন্দু সম্প্রদায়ের রথযাত্রা, দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা, দুর্গাপূজা, কালীপূজা, জন্মাষ্টমী, পৌষসংক্রান্তি, চৈত্রসংক্রান্তি, শিবরাত্রি, সাধু-সন্তের জন্ম-মৃত্যুর স্মারক দিবস ইত্যাদি উপলক্ষে মেলা বসে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের পাল-পার্বণ ও ধর্মীয় অনুষঙ্গে প্রচলিত মেলার মধ্যে রথের মেলা সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী। বিসিক-এর জরিপের সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের রথযাত্রা উপলক্ষে মেলা বসে ৬২টি। এর মধ্যে প্রাচীন ও জাঁকালো রথের মেলা ঢাকার ধামরাইয়ের। এর পরেই নাম করতে হয় কুষ্টিয়ার রথের মেলার। পনেরো দিন স্থায়ী রথের মেলা বসে বাগেরহাটের লাউপালা গ্রামে।

     চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় জগন্নাথ দেবের স্নান উপলক্ষে যে মেলার আয়োজন হয়, তাও যথেষ্ট প্রাচীন ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। লাঙ্গলবন্দের মেলা আয়োজন ও ঐতিহ্যে সবার সেরা। শিলাইদহের স্নানযাত্রার মেলার কথাও এ প্রসঙ্গে বলতে হয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় এর উল্লেখ মেলে :
বসেছে আজ রথের তলায়
    স্নানযাত্রার মেলা–
সকাল থেকে বাদল হল
    ফুরিয়ে এল বেলা।
        (‘‘সুখদুঃখ’’, ‘ক্ষণিকা’)
    
কালীপূজার প্রাচীন মেলার মধ্যে আছে কুষ্টিয়ার খোকসার মেলা। লোকবিশ্বাস মতে, এই মেলার বয়স তিনশো বছরেরও বেশি। গড়াই নদীর তীরে কয়েক মাইল এলাকাজুড়ে মেলা বসতো এক মাস ধরে। কালের প্রভাবে মেলার স্থিতি ও পরিসর দুই-ই হ্রাস পেয়েছে– জাঁকও কমেছে। এই মেলাটি আর এক কারণে বিশিষ্টতার দাবি রাখে। এর সঙ্গে শিলাইদহের ঠাকুর-জমিদার ও নলডাঙ্গার রাজাদের দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। দিনাজপুর, গোপালগঞ্জ, খুলনা ও কুমিল্লার কালীপূজার মেলাও যথেষ্ট পুরোনো। এর মধ্যে কুমিল্লার মেহের কালীবাড়ির দীপান্বিতা মেলা চলে সাত দিন ধরে।

দোলপূর্ণিমায় বসে অনেক মেলা। এই তিথি সাধুসঙ্গের সবচেয়ে বড়ো তিথি। দোলের সঙ্গে বাংলার লৌকিক সাধন-জগতের রয়েছে নিগূঢ় সম্পর্ক। এই দোলপূর্ণিমাতেই ছেঁউড়িয়ায় লালনের সমাধি প্রাঙ্গণে হয় বিশাল বাউল সম্মেলন। মেহেরপুরের মালোপাড়ায় বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের উৎসবের তিথিও এই দোলপূর্ণিমা। গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে এই তিথিতেই অনুষ্ঠিত হয় হরিঠাকুরের স্মরণোৎসব। আর এইসব উপলক্ষ সুযোগ করে দেয় মেলা বসানোর।
চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে চড়ক পূজার মেলার ঐতিহ্যও বহুকালের। কিছু বীভৎস ব্যাপার এই মেলার স্মৃতির সঙ্গে জড়িত– পিঠে বড়শি গেঁথে চক্করদান কিংবা বাণবিদ্ধ জিহ্বা। এই দৃশ্য এখন দুর্লভ কিন্তু বিলুপ্ত নয়। সীতাকুণ্ডের শিবমেলা একই সঙ্গে আভিজাত্য ও প্রাচীনত্বের দাবিদার। একসময় কার্তিক বারুণীর মেলারও খুব জাঁকজমক ছিল। ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকায় (৭ অগ্রহায়ণ ১২৭৬) বলা হয় : ‘বঙ্গদেশে কার্তিক বারুণীর মেলার ন্যায় আর প্রধান মেলা নাই। ঢাকার পূর্ববর্তী মুন্সীগঞ্জের নিকটে প্রতিবর্ষে এই মেলা মিলিয়ে থাকে। কার্তিক পূর্ণিমার দিন অবধি এই মেলা বিদ্যমান থাকে। এই মেলায় দেশ-বিদেশাগত লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়।’

মুসলমান সম্প্রদায়ের উৎসবকেন্দ্রিক মেলার সংখ্যা খুবই কম। আর মুসলমানি পরব-উৎসবে প্রবর্তিত মেলা খুব একটা প্রাচীনত্বের দাবিও করতে পারে না। দুই ঈদ আর মহররম– মেলার এই হলো মুসলমানি উপলক্ষ। এই দুই উপলক্ষের মেলার সংখ্যা যথাক্রমে ১৫ ও ১৬। এর চাইতে পির-ফকির-দরবেশের ‘ওরশ’ মেলার আকর্ষণীয় উপলক্ষ। ঈদ উপলক্ষে প্রাচীন যে মেলার সন্ধান পাওয়া গেছে, তার বয়স সাকুল্যে একশো বছরের বেশি নয়। মুনশি রহমান আলী তায়েশের ‘তাওয়ারিখে ঢাকা’র সূত্রে জানা যায়, উনিশ শতকের শেষের দিকে ঢাকার ধানমন্ডির ঈদগাহে ঈদের নামাজের পর আয়োজিত হতো মেলা। অবশ্য এরপর বিশ শতকে প্রথম থেকেই ঢাকায় নিয়মিত ঈদের মেলা বসতো চকবাজার আর রমনা ময়দানে। ঢাকার আজিমপুরের মহররমের মেলার দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। এই সঙ্গে মানিকগঞ্জের গড়পাড়ার মেলার কথাও বিশেষভাবে বলতে হয়। এরপরে নাম করতে হয় কুষ্টিয়ার চক দৌলতপুরের মহররমের মেলার।

    মুসলমানি পরব-উৎসবের মতো বৌদ্ধধর্মের অনুষঙ্গে রচিত মেলার সংখ্যাও সীমিত। এই মেলাগুলোর সবই বৌদ্ধ পূর্ণিমার সঙ্গে যুক্ত। আতোয়ার রহমানের সূত্রে জানা যায়, ‘চট্টগ্রামের বিজুড়ি গ্রামের আশ্বিনী পূর্ণিমায় বসে তিন দিনের মেলা, কুমিল্লার বড়ইয়াতেমাঘী পূর্ণিমায় এক দিনের। সবচেয়ে বটি মহামুনির, যার স্থিতিকাল সারা বোশেখ মাস’ (‘মেলা’, পৃ. ৮১)।
খ্রিষ্টধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে সম্পর্কিত মেলার সংখ্যা আরো নগণ্য। কেবল বড়দিন উপলক্ষেই দু-এক জায়গায় মেলা বসে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন গোপালগঞ্জের মকসুদপুর থানার অন্তর্গত কালিগ্রামের মেলা। মেলাটি প্রায় শতবর্ষের পুরোনো। প্রায় ১৪/১৫ বিঘা জমিতে সাতদিন ধরে এই মেলা চলে। মেলাটি একসময়ে খুবই জমজমাট ছিল। এও আর দশটা গ্রামীণ মেলার মতোই। তবে এর ভিন্নতর একটি বৈশিষ্ট্য হলো কবিগানের আসরে খ্রিষ্টধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা ও যিশুকীর্তন। মেহেরপুরের বল্লভপুর মিশন এলাকায় একসময়ে জাঁকিয়ে বড়দিনের মেলা বসতো। এখন অবশ্য সে মেলা বিলুপ্ত।

ধর্মীয় মেলার অনুষঙ্গে সাধু-সন্তের স্মৃতিবার্ষিকী ও দরবেদেশ-পির-ফকিরের ‘ওরশ’ উপলক্ষে প্রচলিত মেলার কথাও অনিবার্যভাবেই এসে যায়। এর মধ্যে হিন্দু-পর্বে উল্লেখ করা যায়, নরোত্তম ঠাকুরের প্রয়াণ উপলক্ষে রাজশাহীর প্রেমতলির মেলা, গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দির হরিঠাকুরের মেলা, নরসিংদীর বাউল ঠাকুরের মেলার কথা। ওরশ উপলক্ষে সারাদেশেই অসংখ্য ছোট-বড় মেলার জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার নুরুল্লাপুরের সানাল শাহ ফকিরের মেলা, চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারের মেলা, বগুড়ার মহাস্থানগড়ের শাহ সুলতানের মেলা, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরীর মেলা, ফরিদপুরের সুরেশ্বরের মেলা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

    আমাদের দেশে প্রবর্তিত স্মারক ও সাংস্কৃতিক মেলার উপলক্ষ হলো নববর্ষ, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস। এই সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বইমেলারও আয়োজন হয়। এসব সাংস্কৃতিক মেলার স্থান মূলত শহর এলাকা। নববর্ষ উপলক্ষে বৈশাখী মেলার চল বেশ পুরোনো। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা, পর্যটন করপোরেশন, বাংলা একাডেমি এবং লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিকল্পিত আয়োজনে বৈশাখী মেলা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এখন প্রায় প্রতিটি শহরেই বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। একুশে, স্বাধীনতা কিংবা বিজয় দিবসের মেলার পরিকল্পনা হাল আমলের। একুশের মেলা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাংলা একাডেমির বইমেলাকে কেন্দ্র করে। পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে অনুষ্ঠিত এই বইমেলা ক্রমশ ঐতিহ্যের পথে অগ্রসরমান। এই বইমেলা অবশ্য অবিমিশ্র থাকতে পারেনি, ধীরে ধীরে মেলার সাধারণ বৈশিষ্ট্যই অর্জন করতে চলেছে। অসামান্য লোকপ্রিয়তার কারণে এই মেলার চারিত্র্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিসরও প্রসারিত হচ্ছে। বইমেলা এখন রাজধানী থেকে দূর মফস্বল শহরেও প্রসারিত।

স্মারক-সাংস্কৃতিক মেলাও এখন খুব জনপ্রিয়। খ্যাতিমান লেখক-কবির আবির্ভাব কিংবা তিরোধান বার্ষিকীতে উৎসব-অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গী হয়ে এইসব মেলার জন্ম। ছেঁউড়িয়ার লালনমেলা, শিলাইদহের রবীন্দ্রমেলা, দরিরামপুরের নজরুলমেলা, সাগরদাঁড়ির মধুমেলা, সুনামগঞ্জের হাছনমেলা, অম্বিকাপুরের জসীমমেলার কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে হয়। সম্প্রতি লাহিনীপাড়ায় প্রবর্তিত হয়েছে মশাররফমেলা।
রবীন্দ্রনাথ লোকশিক্ষা ও সমাজ-উন্নতির উপায় হিসেবে মেলার গুরুত্বকে যথার্থভাবে অনুধাবন করেছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি একবার বলেছিলেন : ‘প্রোভিশন্যাল কনফারেন্সকে যদি আমরা যথার্থই দেশের মন্ত্রণার কার্যে নিযুক্ত করিতাম, তবে আমরা কি করিতাম? তাহা হইলে আমরা বিলাতি ধাঁচের একটা সভা না বানাইয়া দেশী ধরনের একটা বৃহৎ মেলা করিতাম। সেখানে যাত্রাগান, আমোদ-আহ্লাদে দেশের লোক দূরদূরান্তর হইতে একত্র হইত। সেখানে দেশী পণ্য ও কৃষিদ্রব্যের প্রদর্শনী হইত। সেখানে ভালো কথক কীর্তন-গায়ক ও যাত্রাদলকে পুরস্কার দেওয়া হইত। সেখানে ম্যাজিক লণ্ঠন প্রভৃতির মাধ্যমে সাধারণ লোকদিগকে স্বাস্থ্যতত্ত্বের উপদেশ সুস্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া হইত এবং আমাদের যাহা কিছু বলিবার আছে, যাহা কিছু সুখদুঃখের পরামর্শ আছে, তাহা ভদ্রাভদ্রে একত্রে মিলিয়া সহজ বাংলাভাষায় আলোচনা করা যাইত’ (‘আত্মশক্তি’)।

মেলায় এসে পসরা সাজায় কামার-কুমার-ছুতোর-জোলা-কৃষাণ-কাঁসারু-বেদেনী-গালাইকর-হালুইকর। নানা পণ্য সম্ভারের সে এক বিচিত্র সমাবেশ। বিকিকিনির বিশাল হাট। প্রায় একশো বছর আগের এক গ্রামীণ মেলার পণ্য-পসরা আর বিকিকিনির আকর্ষণীয় বিবরণ মেলে দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রচনায়। সে মেলা মেহেরপুরের নিকটবর্তী মুরুটিয়ার স্নানযাত্রার মেলা। দেখতে পাই : ‘দোকান পশারীও কম আসে নাই, দক্ষিণে কৃষ্ণনগর ও পশ্চিমে বহরমপুর, নদীয়া ও মুর্শিদাবাদের এই প্রধান নগরদ্বয় হইতেও বিস্তর দোকান আসিয়াছে। দোকানদারেরা সারি সারি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্থায়ী চালা তুলিয়া তাহার মধ্যে দোকান খুলিয়া বসিয়াছে। দু’দিকে দোকান, মধ্যে সংকীর্ণ পথ। এক এক রকম জিনিসের দোকান এক এক দিকে। কোথাও কাপড়ের দোকান, কোথাও বাসনের, কোথাও নানাবিধ মনিহারি দ্রব্যের দোকান।

‘এতরকম সুন্দর পিতল-কাঁসার বাসন আমদানি হইয়াছে যে, দেখিলে চক্ষু জুড়ায়...। কৃষ্ণনগর হইতে মাটির পুতুলের দোকান আসিয়াছে; নানারকম সুন্দর সুন্দর পুতুল...। জুতার দোকানে চাষীর ভয়ঙ্কর ভিড়; পেটে ভাত না থাক, পায়ে জুতা চাই...। ... কাপড়ের দোকান অনেক দেখিলাম। চাষারা সেখানে বোম্বাই কাপড় চাহিতেছে, কিন্তু দোকানদারেরা বোম্বাই বলিয়া অসঙ্কোচে বিলাতি চালাইতেছে...!’

‘লোহা-লক্কড় হইতে ‘ক্যাঁচ্কেচের পাটী’ পর্য্যন্ত কত জিনিসের দোকান দেখিলাম, তাহার সংখ্যা নাই! মিষ্টান্নের দোকানও শতাধিক।... কুমারের দোকানে মাটির হাঁড়ী-কলসি পর্বতপ্রমাণ উচ্চ হইয়া উঠিয়াছে। কাঁটাল বিক্রেতাগণ ছোটবড় হাজার হাজার কাঁটাল গরুর গাড়ীতে পুরিয়া বিক্রয় করিতে আনিয়াছে...’ (‘পল্লীচিত্র’, পৃ. ৫২-৫৪)।

উপলক্ষ যাই থাকুক না কেন, মেলার একটা সর্বজনীন রূপ আছে। মেলায় অংশগ্রহণে সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিন্নতা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কেননা মেলার আর্থ-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সবকিছু ছাপিয়ে প্রকাশিত। তাই মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা। মৈত্রী-সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র মেলা। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সকলেই আসে মেলায়। তাদের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা একটিই তা হলো মেলা বা আড়ং দেখা। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান। গাঁয়ের বধূর ঝোঁক আল্তা-সিঁদুর-স্নো-পাউডার-জলে ভাসা সাবান, ঘর-গেরস্থালির টুকিটাকি জিনিসের প্রতি। আকর্ষণ তার যাত্রা বা সার্কাসের প্রতিও। আর শিশু-কিশোরের টান তো মূলত খেলনার দিকেই। মাটির পুতুল, কাঠের ঘোড়া, টিনের জাহাজ। মুড়ি-মুড়কি, খই-বাতাসা, কদ্মা-খাগড়াই, জিলিপি-রসগোল্লা– এসব খাদ্য-খাবারেও তার তো অরুচি থাকার কথা নয়! সবই তার চাই। সবার ওপরে ‘তালপাতার এক বাঁশি’।
এরপর আসে মেলার বিনোদনের দিক। মেলায় আগত দর্শকদের মনোরঞ্জনের নানা ব্যবস্থা থাকে। নাগরদোলা, ম্যাজিক, লাঠিখেলা, কুস্তি, পুতুলনাচ, যাত্রা, কবিগান, বাউল-ফকিরি গান, জারিগান, বায়োস্কোপ তো থাকেই, কখনো কখনো সার্কাসের তাঁবুও পড়ে। সঙ-এর কৌতুক-মশ্করা সারা মেলাকে মাতিয়ে রাখে। এর ওপরে আরো কিছু বাড়তি আনন্দ-ফুর্তির ব্যবস্থা থাকে– বারবিলাসিনীর অন্তরঙ্গ সঙ্গলাভ। সেকালে এ সুযোগ অবারিত ছিল। একালে প্রকাশ্যে আর ঘটে না এ ব্যাপার। সেকালের অবিদ্যার ভূমিকায় এখন কখনো কখনো যাত্রা বা সার্কাসের মেয়েরা অবতীর্ণ হয়। দু-চারজন ভ্রাম্যমাণ বারবধূও মেলায় আসে। মেলায় বিশেষ ব্যবস্থাপনায় বসে তাড়ি-মদ আর জুয়ার আসর। এ-নেশায় ডুবে সর্বস্বান্ত হতে হয় অনেককে।
একসময়ে পতিতা-সমাগম কোনো কোনো মেলার অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। মেলার প্রবর্তক-আয়োজকদের মুনাফা স্ফীত হতো এদের কল্যাণে। এ-প্রসঙ্গে আবার ফিরে যেতে হয় দীনেন্দ্রকুমার রায়ের কাছে। প্রত্যক্ষদর্শীয় যে বিবরণ তিনি দিয়েছেন তা যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক : ‘বারবিলাসিনীগণের ‘দোকান’ এ অঞ্চলের মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য।... ইহাদের প্রবেশাধিকার না থাকিলে, শুনিয়াছি মেলা জমে না।... অর্থোপার্জনের আশায় এখানে নানা পল্লী হইতে তিন শতাধিক রূপজীবিনীর সমাগম হইয়াছে।... শিকারের সন্ধানে অনেকে চারিগাছা মলের ঝনঝনিতে গ্রাম্য চাষীদের ও পাইক-পেয়াদা নগদীগণের তৃষিত চিত্ত উদ্ভ্রান্ত করিয়া মেলার মধ্যে বিচরণ করিতেছে...’ (‘পল্লীচিত্র’, পৃ. ৫৫)।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেলার চিত্র-চরিত্রেও পরিবর্তন এসেছে। গ্রামীণ মেলা রূপে ও মেজাজে অনেকখানিই বদ্লেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের পাল-পার্বণ উপলক্ষে যেসব মেলা বসতো তার মধ্যে অনেকগুলোই আজ বিলুপ্ত। এর প্রধান কারণ, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব আর হিন্দুদের দেশত্যাগ। কোনো কোনো মেলা রূপান্তরিত হয়ে বেঁচে আছে। যেমন, সাতক্ষীরার পাঁচপোতা-রত্নেশ্বরপুর গ্রামে ইংরেজ আমল থেকেই চৈত্রসংক্রান্তিতে চড়কমেলা হতো। সাতচল্লিশের পর হিন্দুদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ফলে এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই মেলাটি শেষ পর্যন্ত বৈশাখী মেলায় রূপান্তরিত হয়।

অপরদিকে অনেক গ্রামীণ মেলায় আধুনিকতার স্পর্শ লাগছে। বিজলিবাতি পৌঁছেছে গ্রামে, মেলায়। নতুন বিন্যাসের ছাপ আজ স্পষ্ট এসব মেলায়। দেশি-বিদেশি চোখ-ধাঁধানো বাহারি পণ্যের জৌলুসে দর কমেছে কুটির শিল্পজাত গ্রামীণ পণ্যের। এই রুচির পালাবদল অবশ্য বেশ আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। স্বদেশি যুগেও গ্রামীণ মেলায় দেশি শিল্পের চাইতে জার্মানির চিনামাটির তৈজসপত্র, বিলাতি কাচ ও এনামেলের বাসন, বিলাতি ছাতার সমাদর ছিল বেশি। বিলাতি সিগারেট ও দিয়াশলাই স্থান দখল করেছিল দেশি তামাক ও চকমকি। এই পর্যবেক্ষণ দীনেন্দ্রকুমার রায়ের। একশো বছর পরে এই চিত্র যে আরো বদ্লে যাবে সেটাই স্বাভাবিক।
চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। মেলায় এখন হামেশাই মাইকে গান বাজে। দোকানে দোকানে চল হয়েছে রেডিও আর টেপ-রেকর্ডারের। এখন অনেক গ্রামীণ মেলাতেই ভিসিআর বা ডিভিডি প্লেয়ারে ছবি দেখানো হয়। সেই সঙ্গে কখনো কখনো নীলছবির প্রদর্শনও চলে। আর সর্বস্ব-লুণ্ঠক জুয়া ছাড়া তো মেলার অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। আগে যে গ্রামীণ মেলা ছিল নির্মল আনন্দের পরম প্রত্যাশিত মিলন-উৎসব, আজ তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থোপার্জন ও চরিত্রহননের উপায় হয়ে উঠেছে। গ্রামীণ সমাজের অবক্ষয় মেলাকেও স্পর্শ করেছে। নাগরিক জীবনের ক্লেদ-গ্লানি-কৃত্রিমতা-রুচিবিকারের হাত থেকে মেলা পারেনি আত্মরক্ষা করতে।

গ্রামীণ মেলার উজ্জীবনে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা এবং লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। মেলার লৌকিক ধারা এসে মিশেছে নাগরিক প্রয়াসের সঙ্গে। বৈশাখীমেলা, ঈদমেলা, বইমেলা– মেলার লোকধারার প্রেরণা নিয়ে নতুন আঙ্গিক ও মাত্রায় আজ নগরজীবনে প্রতিষ্ঠিত এবং ঐতিহ্যে পরিণত। এ ধারায় সর্বশেষ সংযোজন বিজয়মেলা, যথার্থই যা ‘ঐতিহ্য ও আধুনিক চেতনার... অপূর্ব সমন্বয়’ (শামসুজ্জামান খান, ‘লোকসংস্কৃতি : বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আত্মার সন্ধানে’, ‘অধুনা’, এপ্রিল ১৯৯২, পৃ. ১৮)। সচেতন মধ্যশ্রেণি তাদের অস্তিত্বের শিকড় যে লোকসংস্কৃতি ও লোকায়ত জীবনধারার গভীরে প্রোথিত এই সত্যটি ক্রমশ উপলব্ধি করতে পারছে।

    আলোচনা শেষ করতে চাই রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়েই, স্বদেশ-অন্বেষা ও স্বরূপ-সন্ধানের নিরন্তর প্রয়াসে যে বক্তব্য কালান্তরেও প্রাসঙ্গিক ও দিক-নির্দেশক : ‘বাংলাদেশে এমন জেলা নাই যেখানে নানা স্থানে বৎসরের নানা সময়ে মেলা না হইয়া থাকে– প্রথমত এই মেলাগুলির তালিকা ও বিবরণ সংগ্রহ করা আমাদের কর্তব্য। তাহার পরে এই মেলাগুলির সূত্রে, দেশের লোকের সঙ্গে যথার্থভাবে পরিচিত হইবার উপলক্ষ্য আমরা যেন অবলম্বন করি’ (‘আত্মশক্তি’)।

লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক