১৯৮৪ সালের ১১ জুলাই ঢাকায় আমার জন্ম। বাবা মোহাম্মদ হানিফ আর মা সুফিয়া বেগম। বাবা যেহেতু সরকারি চাকরি করতেন। সেই সুবাদে আমরা ঢাকার শাহবাগ পিজি হাসপাতাল কোয়ার্টারে থাকতাম। সেখানেই আমি আর আমার বড় বোন দিলরুবা বেড়ে উঠেছি। তবে আমাদের আদি বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি। যাই হোক জন্মসূত্রে কর্কট রাশির জাতিকা আমি। এই রাশির জাতিকারা নাকি বেশ আবেগপ্রবণ হন। আমিও তাই। মায়ের কাছে শুনেছি, শৈশব থেকেই নাকি আমার আবেগপ্রবণতা অন্যদের চেয়ে একটু বেশি ছিল। ছোটবেলা থেকেই মাকে দেখেছি অসুস্থ বাবাকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছেন। যখন একটু বড় হলাম, বাবার রোগটি সম্পর্কে জানতে পারলাম। জানলাম, বাবা ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত। ঢাকা ও কলকাতায় তাঁর চিকিৎসা চলত। ১৯৯৩ সালে বাবা মারা গেলেন। তখন আমার বয়স ছিল আট বছর। মা আমাদের দুই বোনকে নিয়ে নতুন করে জীবনযুদ্ধ শুরু করলেন।

শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো

আমার ছোটবেলাটা ছিল অন্যরকম। কারণ, বয়সের তুলনায় তখনই আমাকে কিছুটা বড় মনে হতো। সেই সময় আমার একমাত্র খেলার সঙ্গী ছিল বোন দিলরুবা। সে আমার থেকে পাঁচ বছরের বড় হলেও আমরা ছিলাম বন্ধু। মাঝে মধ্যে ঝগড়াও হতো। নানা অজুহাতে মায়ের হাতে মার খাওয়াতাম ওকে। ওই সময় ভিউকার্ডের যুগ ছিল। মৌসুমী, সালমান শাহ, শাবনূরসহ আরও অনেক চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পীর ভিউকার্ড সংগ্রহ করতাম। শৈশবের জন্মদিনগুলোর স্মৃতি আমার চোখে সবসময় জ্বলজ্বল করে। জন্মদিনে মা-বাবার সঙ্গে কেক কাটা। মাথায় মুকুট পরে কেকের সামনে বসে থাকা। কখন কেক কাটব তার জন্য কত ব্যাকুলতা। আর উপহারের জন্য মুখিয়ে থাকা। আহা!
ছোটবেলায় রমজান মাস শুরু হলে স্কুল বন্ধ দিত। আর আমি অপেক্ষা করতাম ঈদের। শেষ রোজার ইফতার করেই ছাদে উঠে যেতাম। আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। কখন দেখা মিলবে ঈদের চাঁদ। আর দেখতে পেলেই চিৎকার শুরু করে দেওয়া। চাঁদরাতেই মেহেদি লাগানোর ধুম পড়ত। ডিজাইন করে মেহেদি দিতাম। মা সন্ধ্যা থেকেই পরদিনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আর আমরা ঈদের দিন সকাল, দুপুর ও রাতে কী ড্রেস পরব তা গুছিয়ে রাখতাম।

প্রথম এফডিসি দর্শন

এফডিসিতে প্রথম যাই ১৯৯২ সালে। সেই সময় স্বপন চৌধুরীর ‘শত্রু ঘায়েল’ ছবির জন্য শিশুশিল্পীর প্রয়োজন ছিল। সেই সুবাদে গিয়েছিলাম। এফডিসির মূল গেটের সামনে শত শত মানুষের জটলা। মানুষের ভিড়ে গেট দেখা যাচ্ছে না। কেউ গাড়ি কিংবা বেবি ট্যাক্সি নিয়ে ঢুকলেই মানুষজন সামনে চলে আসে। লোকজন এভাবে কেন গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে, তা সেই সময় বুঝতে পারিনি।

শুটিং দেখা

বড় বোন দিলরুবা সেই সময় থিয়েটার থেকে সিনেমায় অভিনয় শুরু করেছে। তার অভিনীত সিনেমার দৃশ্যধারণ হবে নারায়ণগঞ্জের পাগলার একটি পুরোনো স্টুডিওতে। সেখানে সালমান শাহ ও মৌসুমী অভিনীত ‘অন্তরে অন্তরে’ ছবির সেটও ছিল। জমিদারবাড়ির লম্বা রাজকীয় সিঁড়ি। সেখানে গিয়ে আমি ছবি তুললাম। সিনেমার সেট সম্পর্কে তখন আমার ধারণা হলো। শুটিংয়ে গিয়ে মনে হলো পিকনিকে এসেছি।

যেভাবে সিনেমায়

আমাদের পরিবারের সবাই সংস্কৃতিমনা। মা গান করেন। বাবার বন্ধু ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা নূর মোহাম্মদ মনি। বাবা যখন জীবিত ছিলেন তখন প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন মনি আঙ্কেল। সেই সূত্রে সিনেমার অনেকের সঙ্গেই আমাদের পরিচয় হয়েছিল। সেই সময় দিলরুবার সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব আসে কিন্তু তার সিনেমা নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না। এরপর জীবন চলে যাচ্ছিল একই বৃত্তে ঘুরপাক খেয়ে। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন সাংবাদিক শামীম আহমেদ মাকে বললেন, চলচ্চিত্র পরিচালক জাকির হোসেন রাজু নতুন মুখ নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। আপনার ছোট মেয়েকে দিয়ে একবার চেষ্টা করাতে পারেন। সেই সময় আমার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। এরপর রাজু ভাই [জাকির হোসেন রাজু] ও শামীম ভাই বাসায় এলেন। বাসায় কোনো মেহমান এলে আম্মার কথামতো আমাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও গান শোনাতে হতো। তাদেরও গান শোনালাম। গান শুনে রাজু ভাই বললেন, তুমি গায়িকা নয়, নায়িকা হবে! তখন আমার যে বয়স, তাতে নায়িকার ‘ন’ও বুঝি না। দু’দিন পর ছবির প্রযোজক মতিউর রহমান পানুকে আমাদের বাসায় নিয়ে এলেন রাজু ভাই। তিনি দেখে বললেন, এই পিচ্চি মেয়েকে তুমি নায়িকা বানাবে! রাজু ভাই বললেন, ‘এটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। আমাদের ছবির দৃশ্যধারণ আরও তিন মাস বাকি আছে। তাকে এক-দেড় মাস অনুশীলন করালে সিনেমার জন্য তৈরি হতে পারবে। তখন পানু আঙ্কেল রাজি হলেন। এই ছবির নায়ক হিসেবে রিয়াজ অভিনয় করবেন বলেছেন। ওই সময় রিয়াজ ভাইকে চিনতাম না। পরে একদিন রিহার্সালে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলো। এরই মধ্যে আমি নাচ আর অভিনয়ের ওপর ক্লাস করছি। ভোর ৬টায় উঠে গাড়ি চালানো শিখলাম। তখন আমি সবেমাত্র নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। ওই সময় পড়ালেখা আর অভিনয় করছি। আমার প্রথম চলচ্চিত্র ‘এ জীবন তোমার আমার’। ছবিতে প্রযোজক মতিউর রহমান পানু আমার নাম রাখেন পূর্ণিমা। সেই থেকে আমার নাম রীতা থেকে হয়ে গেল পূর্ণিমা। সব যেন স্বপ্নের মতো বদলে গেল। যখন সিনেমায় অভিষেক হলো, তখন এই অঙ্গনের মানুষের কথাবার্তা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করলাম।

ক্যামেরার সামনে...

‘এ জীবন তোমার আমার’–ছবির যখন রিহার্সাল হয়েছিল তখন আমাকে বলা হলো, আমার প্রথম দৃশ্য থাকবে ফারুক ভাই ও ববিতা আপার সঙ্গে। সেভাবেই আমি মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছি। ক্যামেরার সামনে যেন জড়তা না থাকে সে জন্য শুটিংয়ের আগে তাদের বাসায় গেলাম। ববিতা আপা আমাকে নানা পদের খাবার খাওয়ালেন। তার পুরো বাড়ি ঘুরে দেখালেন। শুটিংয়ের প্রথম দিন তিনি আমাকে তাঁর কসমেটিকস দিয়ে নিজ হাতে মেকআপ দিয়েছেন। গুলশানের একটি বাড়িতে শুটিং হয়েছিল। তাঁর গাড়িতেই শুটিং স্পটে যাই। ক্যামেরার সামনে পুরো সংলাপ মুখস্থ বলেছি। দেখি চারদিকে সবাই তালি দিচ্ছে। আমি বুঝতে পারিনি কেন তারা তালি দিচ্ছে। প্রথম শট একবারে ওকে হওয়া বড় ব্যাপার, এটা অনেক পরে বুঝেছি। এই দৃশ্যটির জন্য পাঁচ দিন রিহার্সাল করতে হয়েছে। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৮ সালে।

মন খারাপের ডায়েরি

ক্যারিয়ারের শুরুতেই বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছি। প্রথম ছবি ‘এ জীবন তোমার আমার’ মুক্তি পায় রুবেল-তামান্না অভিনীত বাণিজ্যসফল নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘ভণ্ড’র সঙ্গে। তামান্নাও নতুন অভিনেত্রী। ‘ভণ্ড’ ছবির অভাবনীয় সাফল্য ও আমার প্রথম ছবির দর্শক সাফল্য না পাওয়ায় বেশ ভেঙে পড়েছিলাম ওই সময়। তখন আমি দুটি ছবিই দেখেছি। মধুমিতা হলে আমার ছবি দেখে অভিসারে গিয়ে ‘ভণ্ড’ দেখেছি। যখন দেখলাম ‘ভণ্ড’ বেশি দর্শক দেখছে, তখন মন খারাপ হয়েছিল। এই ছবিতে আমার অভিনয় করার কথা ছিল। কিন্তু করা হয়নি। শহীদুল ইসলাম খোকন ভাই তাড়াতাড়ি ছবির কাজ শেষ করে আমার প্রথম ছবির সঙ্গে মুক্তি দিয়েছিলেন। ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। প্রমোশন থেকে শুরু করে সব জায়গায় ‘ভণ্ড’র জয়গান। এটি অস্বস্তি লাগছিল। ছবি মুক্তির আগের দিন আমি রিকশায় কাজে বের হয়েছিলাম। রিকশাওয়ালার কাছে জানতে চাইলাম, শুক্রবার দুটি ছবি মুক্তি পাবে। তুমি কোনটি দেখবে? সে কালক্ষেপণ না করেই বলল, ‘ভণ্ড’ ছবিটি দেখব। ওসব এখন অবশ্য ভুলে গেছি। ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় বিয়ে করেছি বলে গুজব ছড়ানো হয়েছিল। ওই সময় আমার সবচেয়ে খারাপ কেটেছে। নানামুখী গসিপ, গুঞ্জন রটিয়ে আমাকে বিরক্ত করে রেখেছিল অনেকেই। যে জন্য চলচ্চিত্রে অভিনয় থেকে নিজেকে কিছুটা সরিয়ে নিয়েছিলাম।

সংসার জীবন

২০০৭ সালের ৪ নভেম্বর আহমেদ ফাহাদের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। ঘর আলো করে আসে কন্যাসন্তান আরশিয়া উমাইজা। জীবনে ভাঙাগড়া থাকে। ফাহাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল ১৩ বছর। এত বছর ধরে চেষ্টা করে গেছি। কোনোভাবে মনের মিল হচ্ছিল না। অনেক চেষ্টা করেও যখন আর পারছিলাম না, তখনই বিচ্ছেদের পথে হেঁটেছি। তবে মেয়ে উমাইজাকে নিজের কাছেই রেখেছি। এরপর নিঃসঙ্গতায় কাটল অনেক দিন। সেই নিঃসঙ্গতা কাটাতে ব্যস্ত থাকলাম নানা কাজে। অভিনয়-মডেলিং-উপস্থাপনা সবই চলল। তবু ব্যস্ততা ফুরোলেই দেখা যেত, এই আমি শুধুই একা। অবশেষে সেই একাকিত্ব ঘোচানোর সুযোগ এলো রবিনের সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্বের পর। এরপর গত বছরের ২৭ মে নতুন জীবন শুরুর সিদ্ধান্ত নিই। আশফাকুর রহমান রবিনের সঙ্গে আবদ্ধ হই বিয়েবন্ধনে। বন্ধুত্ব, বিশ্বাস আর শ্রদ্ধাবোধ সবকিছু পেয়েছি তাঁর মধ্যে। সেখান থেকে সম্পর্ক মজবুত হয়। কাজের ক্ষেত্রে স্বামীর কাছ থেকে সব সময়ই সহযোগিতা পাচ্ছি। সংসার সামলানো, মেয়ের পড়াশোনার দেখভাল ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে  ফোনে গল্প করে বেশ আনন্দময় সময় কাটছে।

আমার অভিনীত চলচ্চিত্র

পঁচিশ বছরের অভিনয় ক্যারিয়ারে এ পর্যন্ত সর্বমোট ৮০টি ছবিতে কাজ করেছি। এগুলো হলো– ‘এ জীবন তোমার আমার’, ‘নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি’, ‘মেঘলা আকাশ’, ‘মায়ের সম্মান’, ‘শিকারী’, ‘লাল দরিয়া’, ‘মাস্তানের ওপর মাস্তান’, ‘স্বামী-স্ত্রীর যুদ্ধ’, ‘আরমান’, ‘জামাই শ্বশুর’, ‘মনের মাঝে তুমি’, ‘মেঘের পরে মেঘ’, ‘টক ঝাল মিষ্টি’, ‘আজকের সমাজ’, ‘শাস্তি’, ‘গাদ্দারী’, ‘ডেঞ্জার সেভেন’, ‘বলো না ভালোবাসি’, ‘সুভা’, ‘টাকা’, ‘ছোট্ট একটু ভালোবাসা’, ‘বাধা’, ‘সাথী তুমি কার’, ‘রাক্ষুসী’, ‘দাফন’, ‘হৃদয়ের কথা’, ‘তুমি কত সুন্দর’, ‘ধোঁকা’, ‘ধনী গরিবের প্রেম’, ‘ক্ষমতার গরম’, ‘মনের সাথে যুদ্ধ’, ‘মা আমার স্বর্গ’, ‘উল্টাপাল্টা’, ‘জীবনের চেয়ে দামী’, ‘বিয়ের প্রস্তাব’, ‘তোমাকেই খুঁজছি’, ‘আকাশছোঁয়া ভালোবাসা’, ‘পিতা মাতার আমানত’, ‘কে আমি’, ‘শ্রমিক নেতা’, ‘ভুল সবই ভুল’, ‘শুভ বিবাহ’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘ভালোবাসার লাল গোলাপ’, ‘চিরদিন আমি তোমার’, ‘জমিদার’, ‘আমার স্বপ্ন’, ‘মা আমার জান’, ‘মায়ের চোখ’, ‘আমার মা আমার অহংকার’, ‘আমার স্বপ্ন আমার সংসার’, ‘পরাণ যায় জ্বলিয়ারে’, ‘ওরা আমাকে ভালো হতে দিল না’, ‘মায়ের জন্য পাগল’, ‘গরিবের মন অনেক বড়’, ‘মাটির ঠিকানা’, ‘বন্ধু তুমি আমার’, ‘অস্ত্র ছাড়ো কলম ধর’, ‘আই লাভ ইউ’, ‘রাজা সূর্য খাঁ’, ‘ছায়া-ছবি’, ‘জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার’, ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’, ‘টু বি কন্টিনিউড...’, ছবিতে দর্শক আমাকে দেখেছেন। কাজ শেষ করেছি ‘আহারে জীবন’ ছবির। এ ছাড়া ‘জ্যাম’, ‘গাঙচিল’ নামে দুটি সিনেমা নির্মাণাধীন রয়েছে।

আমার নায়কেরা

রিয়াজের সঙ্গে ‘এ জীবন তোমার আমার’ ছবিতে জুটি হয়ে আমার সিনেমায় অভিষেক হয়। তাঁর সঙ্গে জুটিটি দর্শক গ্রহণ করে। পরে নির্মাতারা আমাদের একের পর এক ছবিতে চুক্তিবদ্ধ করতে থাকেন। এরপর ‘নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি’, ‘মনের মাঝে তুমি’, ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’, ‘হৃদয়ের কথা’, ‘শাস্তি’, ‘খবরদার’, ‘শ্বশুর জামাই’, ‘টক ঝাল মিষ্টি’সহ আমার আরও অনেক ছবির নায়ক ছিলেন রিয়াজ। মান্না ভাইয়ের সঙ্গে ১৮টি ছবিতে অভিনয় করেছি। চলচ্চিত্র অঙ্গনে যে সময়ে এসেছি, সে সময় মান্না ভাই ছিলেন এক নম্বর নায়ক। অভিনয়ের সুবাদে আমি তাঁকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি। প্রথমে তাঁর সঙ্গে একটু ভয়ে ভয়ে কাজ করতাম। পরে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। শুটিংয়ে আড্ডা, গল্প হতো। টেলিভিশনের এক আলাপচারিতার অনুষ্ঠানে উপস্থাপক মান্না ভাইকে যে কোনো একজন পছন্দের নায়িকার নাম বলতে বললে– উত্তরে তিনি আমার নাম বলেছিলেন। এটা আমার জন্য বড় পাওয়া। চলচ্চিত্র ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। চলচ্চিত্রের প্রতি এত ভালোবাসা আমি কারও মধ্যে দেখিনি। ‘সুলতান’ থেকে ‘পিতা মাতার আমানত’ সব ছবিতে দর্শক প্রশংসা পেয়েছি। তিনি আমাদের মাঝে নেই, তাঁকে খুব মনে পড়ে। এছাড়া শাকিব খান, ফেরদৌস, রুবেল, আমিন খান, অমিত হাসান, বাপ্পারাজ, শাকিল খান, কাজী মারুফ, ইমন এবং সিজারের বিপরীতে অভিনয় করেছি।

বড় পর্দা থেকে ছোট পর্দায়...

চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের শুরু থেকে আমি পর্দা বিভাজনে বিশ্বাসী নই। বড় পর্দা বা ছোট পর্দা যেটাই হোক, দর্শক ভালো কাজটিই মনে রাখেন। অভিনয় কেমন হলো, চরিত্রের গভীরতা ছিল কিনা, গল্পে ভিন্নতার ছাপ আছে কিনা– এ প্রশ্নগুলোই দর্শকের কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায়। সিনেমার শিল্পী শুধু সিনেমাতেই কাজ করবে– একজন পেশাদার শিল্পীর এই মনোভাব থাকা উচিত নয়। যে জন্য সিনেমাতে অভিনয়ের পাশাপাশি টিভি নাটকেও অভিনয় করেছি পুরোদমে। ১৯৯৯ সালে রেজানুর রহমানের পরিচালনায় ‘তুমি যে আমার কবিতা’ নাটকে অভিনয় করি। এতে আমার সহশিল্পী ছিলেন শহীদুজ্জামান সেলিম। এরপর রাইসুল ইসলাম আসাদের বিপরীতে বরেণ্য নির্মাতা সুভাষ দত্তের পরিচালনায় একটি টেলিছবিতে অভিনয় করি। এরপর ‘ল্যাবরেটরি’, ‘এখনও ভালোবাসি’, ‘ওই খানে যেও নাকো তুমি’, ‘উল্টো ধনুক’, ‘নীলিমার প্রান্তে দাঁড়িয়ে’, ‘অমানিশা’, ‘ফিরে যাওয়া হলো না’, ‘প্রেম অথবা দুঃস্বপ্নের রাত দিন’, ‘লাভ অ্যান্ড কোং’, ‘হ্যালো ৯১১’, ‘লাভ ইমার্জেন্সি’, ‘রোদ্দুরে পেয়েছি’, ‘ম্যানিকুইন’, ‘গোপনে’সহ ছোট পর্দার জন্য আরও অভিনয় করেছি।

ভোজনরসিক ও রাঁধুনি

যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। মিডিয়ায় রাঁধুনি ও ভোজনরসিক হিসেবেও আমার আলাদা পরিচিতি আছে। সত্যি কথা বলতে, কিছু প্রচলিত রান্নার সঙ্গে চিকেন স্টেক, চিকেন সিজলার পাশাপাশি ডেজার্ট আইটেম ভালো রান্না করতে পারি। যারা আমার হাতের রান্না খেয়েছেন, তাঁরা সবাই আমার প্রশংসা করেছেন। সুযোগ পেলেই টিভি চ্যানেলে রান্নাবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখে নিত্যনতুন রেসিপির সঙ্গে পরিচিত হই। দেশের বাইরে গেলে সামাজিক মাধ্যমে নিজের ছবি কম দিই, খাবারের ছবিই দিই বেশি। নাইজেলা লসন, ইভান রেমন আর ভারতের সঞ্জীব কাপুর আমার খুব প্রিয় শেফ। সঞ্জীব কাপুরের অনেক রেসিপি টেলিভিশনে দেখে বাসায় রান্নার চেষ্টা করি। একেবারে ছোটবেলা থেকে তাঁর রেসিপি দেখি। টমি মিয়া, সিদ্দিকা কবীর আপার রান্নার অনুষ্ঠান আমার খুব পছন্দের।

মন ছুটে যায় বৃদ্ধাশ্রমে

ক্যারিয়ারের শুরু থেকে নানা ধরনের সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার চেষ্টা করেছি। সময়-সুযোগ পেলেই ছুটে যাই বৃদ্ধাশ্রমে। মনে পড়ে বেশ আগে সাধারণ একটা বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে কয়েকজনের বয়স একশ’র বেশি। এ রকম অসহায় মানুষ দেখলে মনটা ভারি হয়ে ওঠে। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মানুষদের জন্য একবেলা খাবারও দিয়েছি। আমাকে কাছে পেয়ে তাঁরাও আনন্দে মেতে ওঠেন।

এক নজরে এই আমি

নাম: দিলারা হানিফ
ডাক নাম: রিতা
চলচ্চিত্রের নাম: পূর্ণিমা
জন্ম তারিখ: ১১ জুলাই, ১৯৮৪
জন্মস্থান: ঢাকা
বাবা: মরহুম মো. হানিফ
মা: সুফিয়া বেগম
ভাইবোন: একমাত্র বোন দিলরুবা হানিফ
স্বামী: আশফাকুর রহমান রবিন
সন্তান: আরশিয়া উমাইজা
শখ: গান শোনা
ভালো লাগে: প্রশংসিত হলে
খারাপ লাগে: স্বার্থপরতা দেখলে
আনন্দের স্মৃতি: মেয়ের সঙ্গে থাকা
বেদনার স্মৃতি: বাবার মৃত্যু
প্রথম ছবি: এ জীবন তোমার আমার
প্রথম নাটক: তুমি যে আমার কবিতা
অভিনীত মোট চলচ্চিত্র: ৮০টি
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার : ২০১০
অবসর কাটে: ছবি দেখে
প্রিয় লেখক: হুমায়ূন আহমেদ
কোন ধরনের ছবি পছন্দের: কমেডি ছবি
প্রিয় উপহার: পারফিউম
জীবন যেমন: জীবন মানে যন্ত্রণা, নয় ফুলের বিছানা
বন্ধুদের আড্ডায় প্রিয় প্রসঙ্গ: জীবনযাপন
নিজের অভিনীত প্রিয় চরিত্র: ‘চন্দরা’
এক দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলে: রাস্তাঘাটের জ্যাম কমিয়ে দেব
প্রেমে পড়েছি: অনেকবার
কোন সময়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ: সবসময়
নিজের সম্পর্কে একটি অপ্রকাশিত তথ্য: যা এখনও বলতে চাই না

গ্রন্থনা : এমদাদুল হক মিলটন