ঠিকানা শব্দের মূল

বাংলায় যে ঠিকানা শব্দটি আছে, সেই শব্দের মূলে রয়েছে ঠিক শব্দটি। এই ঠিক শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ স্থিত থেকে। এই স্থিত যখন ক্রমে ‘ঠিক’ হয়েছে, এই ‘ঠিক’ থেকে ‘ঠিকানা’ শব্দের উৎপত্তি। এবং ঠিকানা মানেই হচ্ছে, যেখানে স্থিতি আছে। এবং এখনো আমরা শহরের যেখানেই বাস করি না কেন— আমরা যদিও বাংলাদেশের মানুষ সবাই— জিজ্ঞেস করি, দেশের বাড়ি কোথায়।
দেশ তো বাংলাদেশ। তাহলে দেশের বাড়ি কী? ওই যে দেশ ছিল, আমার বাড়ি ছিল বা এখনো আছে, সেটাই হলো আমার আসল ঠিকানা। যে কারণে এটাকে দেশের বাড়ি বলা হয়ে থাকে। গ্রামের শস্যক্ষেতের মাটির আল ছেড়ে আমরা শহরের পাকা রাস্তায় পা রেখেছি তা বেশিদিন আগের কথা নয়। গ্রামীন লোকসমাজের সঙ্গে আমাদের বাহ্যিক বিচ্ছেদ ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু সমাজের ঐতিহ্যিক সংস্কারগুলো কিন্তু আমাদের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে।
এবং দেশের বাড়ির প্রতি যে একটা বিশেষ আকর্ষণ, সেটা বোঝা যায়, বিভিন্ন পর্ব উপলক্ষে যখন বিভিন্ন শহর থেকে মানুষ গ্রামের বাড়ি ধাওয়া করে, তখনকার যে ভিড়, সেটি দেখে বোঝা যায়, সেখানে না থাকলেও, আমার ঠিকানা আসলে ওটাই। এ একটি দৃশ্য অনুধাবন করলেই ঠিকানা কথাটির প্রকৃত বাস্তবতা উপলব্ধি করা যায়।
হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ হিসাবে আমি কিছু কথা বলছি। হিন্দুরা, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে, আমাদের দেশ থেকে অনেকেই দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। ধর্মের নামে দেশ ভাগ করে তার কষ্টটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আমরা না গেলেও, আমাদের অনেক আত্মীয় স্বজন তখন দেশত্যাগ করে ভারতে চলে গেছেন। দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল।
সেখানে থাকতে শুরু করার অনেক দিন পার হয়ে যাওয়ার পরও তারা মনে করতেন— আমাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণোর কেন্দুয়ার চন্দপাড়া গ্রামেই। আসলে ঠিকানা কী। মানুষের মনে ঠিকানার বোধ কিভাবে তৈরি হয়। পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করতে থাকা আমার আত্মীয় স্বজনদের মন পড়লে হয়ত ঠিকানা শব্দের প্রকৃত অনুভব আরো গাঢ় হয়।
সেই মানুষগুলোর সঙ্গে আস্তে আস্তে আমাদের যোগাযোগ কমে এসেছিল। অথচ আমরা একই জায়গা, একই ঠিকানায় বসবাস করতাম। কিন্তু পাকিস্তান আমাদের বিচ্ছিন্ন করেছিল। ঠিকানা থেকে বিচ্যূত করেছিল।  
সম্প্রদায়চেতনা বা জাতিচেতনা যাই বলি না কেন, ভেতরে ভেতরে যদি শ্রেণি চেতনা দিয়ে তা জারিত না হয়, তবে কোনো আন্দোলন ইতিহাসে ঢেউ তুলতে পারে বলে আমি মনে করি না। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের ইতিহাস শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। আমরা দেখেছি, শ্রেণিসংগ্রাম এ দেশে বারংবার বিকৃত সাম্প্রদায়িকতার পথ ধরেছে। চল্লিশের দশকে এটি হিন্দু-মুসলমান বিরোধে রূপ পেয়ে মানুষের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিকে পর্যন্ত ভোঁতা করে তুলেছিল।

ঠিকানা প্রসঙ্গে সমাজ ও শারীরবিদ্যা

ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ বলেছেন, একটি সর্বৈব নিখুঁত সমাজ, একটি সর্বৈব নিখুঁত রাষ্ট্র কেবল কল্পনাতেই থাকা সম্ভব। অনুক্রমিক ইতিহাসের প্রতিটি অংশ মূলত প্রবহমান অন্তর্বর্তীকালীন অংশ এবং প্রত্যেকটিই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। যে সময় ও কারণ থেকে তার উৎপত্তি, সেই সময় ও কারণের বিবেচনায় তার যুক্তিসংগত।
ঠিকানা বদলের পরিসর কিন্তু এখন আরো বেড়েছে। কখনো কাজের সূত্রে, কখনো অস্তিত্বের সংকটে মানুষ এখন এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে ছুটেছে। এবং প্রয়োজনে সেখানেও অনেকে স্থায়ীও হতে চাইছে। এরপরও, সেই নব্য স্থায়ী মানুষটির সঙ্গে যখনই কোনো দেশি মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, বা বিদেশির কাছ থেকে জিজ্ঞাসিত হয়, সে বলে, আমার বাড়ি তো ওই অমুক জেলার ওই খানে। ঠিকানার বোধ তার ভেতর এভাবে কাজ করে। কখনো প্রজন্মান্তরে তা বদলেও যায়।
আমি এদেশে আছি, কিন্তু আমরা ছেলে বিদেশে পড়াশোনা করতে গেছে। এরপর সেখানে স্থিত হয়ে গেছে। তার ঠিকানা বদল হয়ে গেছে। হলেও, যখনই তাকে কোনো ইউরোপীয় মানুষ ঠিকানা জিজ্ঞেস করেন, তিনি তার দেশের বাড়ির কথা তাদের জানান।
মানুষ যখন বিদেশের মাটিতে এক টুকরো দেশ তৈরি করে নেয়, তখনো ঠিকানার প্রতি মানুষের যে আকর্ষণ তা ব্যক্ত হয়। ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের পূর্বভাগে ব্রিকলেন। ব্রিকলেনকে বলা হয় বাংলা টাউন। যদিও দেশ থেকে তা বহু দূরে, সেখানে বসবাসকারী মানুষদের মনে ঠিকানার বোধ সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। ঠিকানা কখনো ভোলা যায় না।  
তবে সেসব জায়গায় যারা কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করছেন, তাদের ঠিকানার বোধ, সেখানে জন্ম নেওয়া সন্তানদের আর বাবা মায়ের ঠিকানাবোধ কি একই? বর্তমানে মানুষ নানান ভাবে দেশান্তরী হচ্ছে। এক পরিবারের মানুষ বিভিন্ন দেশে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করছে।  
এসব ঘটনার দ্বারা ঠিকানা পরিবর্তনও এমনভাবে ঘটে গেছে যে, আজকের দিনে এসে আমরা ঠিকানার কথা আর আগের মতো বলতে পারি না।
ঠিকানা শব্দটার ভেতর ঠিক শব্দটার উল্লেখ আছে। ঠিক মানে স্থিত। আমরা বলি ঠিক কথা। ঠিক কথা মানে স্থিত আছে যে কথাটা। যে কথার এদিক সেদিক নড়চড় হবে না, মিথ্যা নয় যে কথা। — ও ঠিক কথা বলেছে, লোকে বলে।
আর কারো কারো কথা সম্বন্ধে বলে— ওর কথার কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। এই ঠিক শব্দের পাশে ঠিকানা শব্দটা; এ কিন্তু আলাদা তাৎপর্য বহন করে। এটিও স্পষ্ট করে ঠিকানার বোধ।
ঠিকানা নিয়ে আলাপে ভাষাতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞানকে নিয়ে আসতে হবে। যা আজকের জন্যে ঠিক, তা চিরকালের জন্যে অপরবর্তিত, অপরিবর্ধিত থেকে যাবে তা নাও হতে পারে। মানুষের ঠিকানা তাই কালের পরিক্রমায় বদলায়। যেভাবে অস্তিত্ব ও মৈত্রীর প্রয়োজনে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন প্রবাহের মধ্য দিয়ে  ‘ঠিক’ তার অস্তিত্ব বজায় রাখে।
প্রকৃতি ও প্রকৃতি উদ্ভুত মানুষের ক্রমশ বিকশিত হওয়ার একটি ধারা আছে, ধারাবাহিকতার নিয়ম আছে। এই নিয়মটিকেই আমি নিয়তি বলতে চাই। এই নিয়তিরই অপর নাম প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা, আর এই দ্বান্দ্বিকতা সামাজিক নিয়তির মূল কথা। আমাদের ঠিকানা বদল এই সামাজিক নিয়তি বহির্ভূত কিছু নয়।
ঠিকানার প্রশ্নে শারীরবিদ্যাও কি আসে না? ঠিকানার ছাপ মানুষের চেহারায় থেকে যায়। দূর দেশে পথচলতি দেখায় কোনো স্বদেশী বা প্রতিবেশী-দেশীকে কথা না বলেই মুখ দেখে চেনা যায়। পৃথিবীর আরেক প্রান্তে স্বদেশীর মতো মুখ নিয়ে যিনি চলছেন, তাকে দেখলে মন চঞ্চল হয়, এবং জিজ্ঞেস করি, আপনি কি বাঙালি? আপনি কি ভারতীয়? মিলে যায়, এবং তখন এই ঠিকানা একটা নতুন বন্ধনের পথ খুলে দেয়।
আবার ঠিকানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে, বংশানুক্রম ও কালক্রমে বদলে যেতে থাকে দেহমন, মুখাবয়ব, ভাষা। পুরনো আত্মীয়তার মাঝখানে দেয়াল উঠে নতুন আত্মীয়তার সেতু তৈরি হচ্ছে, এমনও ঘটে, ঘটছে, ঘটবে, সন্দেহ নেই।

বিষয় : প্রচ্ছদ যতীন সরকার

মন্তব্য করুন