
আনিসুজ্জামান : ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭- ১৪ মে ২০২০
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমার শিক্ষক ছিলেন। তিনি শিক্ষক হিসেবে ছিলেন দায়িত্বশীল। শিক্ষার্থীদের প্রতি ছিল তাঁর অত্যন্ত সদয় দৃষ্টি। তিনি শ্রেণিকক্ষে পাঠ্যবিষয় খুবই সুন্দর ও সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন। অতিরিক্ত কথা বলতেন না। তাঁর যাঁরা ছাত্রছাত্রী ছিলেন প্রত্যেকেই এটা স্বীকার করবেন। ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পরও কোনো শিক্ষার্থীর সামনে তাঁর প্রসঙ্গে কথা উঠলে প্রশংসা করেন। তাঁর গবেষণাকর্মের দিকে নজর দিলেও দেখা যাবে অত্যন্ত নিখুঁত এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।
তিনি নিজেও মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএ পাস করেছিলেন। পরে কিছুদিন বাংলা একাডেমিতে একটি গবেষণা কাজ করার পরে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। অল্প বয়সেই তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। লেখালেখির প্রথম দিকে তিনি কিছু কবিতা, গান, গল্প লিখলেও পরে গবেষণার পাশাপাশি প্রবন্ধ রচনাকেই বেছে নিয়েছিলেন নিজের পছন্দের ক্ষেত্র হিসেবে। সেই সময়ে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ তাঁকে লেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ও পরিচিতি এনে দিতে সহায়ক ভূমিকে রেখেছিল। ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ রচনার ফলে এই অঞ্চলের মুসলিমদের সাহিত্যিক হিসেবে ভূমিকা মনোযোগ আকর্ষণ করে। গবেষণা কাজের পাশাপাশি তাঁর সম্পাদিত বিভিন্ন বই নানা সময়ে আমাদের চাহিদা মিটিয়েছে। তাঁর সম্পাদিত বেশকিছু স্মারকগ্রন্থ সুনাম কুড়িয়েছে। তাঁর নিজের লেখা গ্রন্থের মধ্যে ‘মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র’, ‘স্বরূপের সন্ধানে’, ‘পুরনো বাংলা গদ্য’ বাংলা ভাষার সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হবে। আবার সংখ্যায় অল্প হলেও তিনি বিদেশি সাহিত্যের কিছু অনুবাদ করেছেন। অনেকেই আক্ষেপ করে বলে থাকেন, তিনি গবেষণা কাজে আরও সময় দিলে কিংবা নিয়োজিত থাকলে আমাদের দেশ গবেষণায় আরও সমৃদ্ধ হতে পারত।
আনিসুজ্জামান শিক্ষক হিসেবেও ছিলেন অনুকরণীয়। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাঁর নিজস্ব বোঝাপড়া ছিল। ইউরোপীয় শিক্ষার প্রভাব আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে পড়লেও বাংলা বিভাগের ওপর খুব বেশি পড়েনি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সবসময়ই বাংলা বিভাগের আলাদা গুরুত্ব ছিল। সেটি এখনও পরিমাণে অল্প হলেও রয়েছে। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে অগ্রভাগে থাকা ও বর্তমানে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রদর্শন করে যাচ্ছে। আমরা যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে চাই তাহলে এর জন্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। এই ধারণাটি আনিসুজ্জামান বেশ জোরালোভাবেই সামনে এনেছিলেন।
তিনি পেশায় শিক্ষক হলেও শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন দেশের বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামের সঙ্গে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর মতামত ও অবস্থান স্পষ্ট করে তুলে ধরতেন। তিনি নিজের কর্মপরিধিকে প্রসারিত করেছিলেন সব ধরনের প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে। বিশেষ করে, তিনি গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকায় সম্পৃক্ত ছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে। মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। সত্তরের দশকে রবীন্দ্রবিরোধী প্রচারণার বিপরীতে ছিল তাঁর সোচ্চার অবস্থান। নিজের কর্মক্ষমতার ওপর ছিল তাঁর অবিচল আস্থা। সেভাবেই তিনি সারাজীবন কাজ করেছেন।
দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল। এটা আমরা দেখতে পাই সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। সেই সময়ে তিনি নিজের পরিবার নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন। তারপর সেই সময়ে যে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল, তার সঙ্গে কাজ শুরু করেছিলেন। বিশেষ করে, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে পরামর্শ করে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ শুরু করেন। আবার দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলাদেশের সংবিধান রচনা হওয়ার পরে তাঁর বাংলা অনুবাদের কাজে নিয়োজিত হয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, জাতির ও দেশের প্রয়োজনে সবসময়ই তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন।
নতুন স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে শেখ মুজিবুর রহমান যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন তিনি আনিসুজ্জামানকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে যোগদানের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি সেই পদে না গিয়ে তাঁর শিক্ষকতা পেশায় ফিরে গিয়েছিলেন। তিনি শিক্ষা সচিবের পদ গ্রহণে সম্মত হননি।
আমার যতদূর মনে পড়ে, ১৯৭৫-এ যখন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন, সেই সময়ে তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ঠিক পরের দিনই দেশে ফিরেছিলেন। তারপর থেকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নিয়েই ছিলেন। আমৃত্যু তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নিয়ে ছিলেন। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সফলতা আওয়ামী লীগ এবং দলটির প্রধান শেখ হাসিনার পক্ষে গিয়েছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি তার পেছনেও আনিসুজ্জামানের ভূমিকা রয়েছে। আমি যতবার বিষয়টি লক্ষ্য করেছি, এটি দেখতে পেয়েছি। সামরিক শাসনের কালে কিংবা বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টি যখন যে ক্ষমতায় ছিল তারা যেভাবে দেশ পরিচালনা করেছে আনিসুজ্জামান তা সমর্থন করতেন না। সামরিক শাসনকালে যেসব বিধিবিধান জারি করা হতো তিনি তা সমর্থন করতেন না।
শেখ হাসিনার বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা এবং আওয়ামী লীগের শাসনে বাংলাদেশ থাকার পেছনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আমার ধারণা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনিসুজ্জামান দ্বারা উপকৃত হচ্ছেন– এমন একটি ধারণা তাদের উভয়ের মধ্যেই পরীক্ষিত ছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা এখনও সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক হতে পারেনি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের উপলব্ধি ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি সুস্থধারায় এগিয়ে নিতে হবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমার একজন শুভানুধ্যায়ী ছিলেন। আমি বিভিন্ন সময়ে তাঁর দ্বারা উপকৃত হয়েছি। তিনি বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনা বিষয়ে যে ধারণা পোষণ করতেন আমিও সেসবের সঙ্গে একমত। আমি উপলব্ধি করে আসছি যে, ব্রিটিশশাসিত বাংলায় একটি রেনেসাঁস ঘটেছিল। সেই রেনেসাঁস ইউরোপীয় রেনেসাঁসের প্রভাবে হয়েছিল। তাছাড়া আমাদের গোটা বাঙালির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখব, শ্রীচৈতন্যের যে চিন্তা ছিল তার প্রভাবেও বাংলায় রেনেসাঁসের মতো ঘটনা ঘটেছিল। সেই সময়ের বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি, একমাত্র রেনেসাঁসের প্রভাব থাকলেই সেই ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়। শ্রীচৈতন্যের কালে বা তাঁর মৃত্যুর পরে বাংলায় একটি রেনেসাঁ দেখা গিয়েছিল এখন আমরা বলতে পারি।
আনিসুজ্জামান তাঁর নিজের গবেষণায় এবং চিন্তায় বাংলার এইসব বিষয় যেভাবে এনেছেন তা যদি আমরা দেখতে শুরু করি তাহলে তাঁর প্রতি যথার্থ বিচার ও সম্মান দেখানো হবে বলে আমার বিশ্বাস। তাঁর মৃত্যু দিনে তাঁকে আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক
মন্তব্য করুন