- বিশেষ আয়োজন
- আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থায় অনেক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কাজ করে
সাক্ষাৎকার: ড. আহসান এইচ মনসুর
আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থায় অনেক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কাজ করে

ড. আহসান এইচ মনসুর পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক। তিনি ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ থেকে অবসর গ্রহণের আগে তিনি সংস্থাটিতে আড়াই দশকের বেশি কর্মরত ছিলেন। আইএমএফে দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলোতে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮২ সালে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও লন্ডন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৭ সালে কানাডার ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর ১৯৭৬ সালে একই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
সমকাল: বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার পদধ্বনির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় বাজেট নিয়ে আপনার কোনো দুশ্চিন্তা আছে?
আহসান এইচ মনসুর: না, বাজেট নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। এজন্য যে, বাজেট একটি সামগ্রিক দলিল। এখানে ঋণের সুদ, বেতন-ভাতা, ভর্তুকি, সামাজিক সুরক্ষা ব্যয় নিয়ে পরিকল্পনা করতে হয়। বাজেট দিয়ে বড় কোনো পরিবর্তন আনা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না। সবচেয়ে বড় কথা আয়ের দিক থেকে তেমন কোনো বৃদ্ধি হয় না। ফলে রাজস্ব যদি ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তাহলে দেখা যাবে ব্যয়ের খাতগুলোতে এর চেয়ে বেশি বৃদ্ধি হয়। ফলে প্রতিবছরই আমাদের ‘ফিসকাল স্পেস’ কমে যাচ্ছে। বাজেটে ব্যয়ের স্বাধীনতা বা বিবেচনামূলক ব্যয়ের সুযোগ ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। তাই বাজেটে বড় কোনো পরিবর্তনের পরিকল্পনা সরকার করতে পারবে না। গতানুগতিক বাজেটই হবে।
সমকাল: আমরা জানতে পেরেছি ৬.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজেট আসছে। এর প্রধান চ্যালেঞ্জ কী দেখছেন?
আহসান এইচ মনসুর: প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো– অর্থনৈতিক পটভূমি ভালো নয়। গত দুই বছর করোনার কারণে আমাদের প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরও কম হবে। কারণ, আমদানি অনেক কমে গেছে। ডলার সংকট চলছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথাই যদি ধরি, এ খাতে প্রকৃত ভর্তুকি হলো ৭১ হাজার কোটি টাকা। সরকার দিয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। তাহলে ব্যবধান প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। এটি দিয়ে পরের বছর ব্যয় সংকুলান করতে হবে। ফলে এ বছর ঘাটতি বাজেট দাঁড়াতে পারে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
সমকাল: ঘাটতি বাজেটের অর্থ আসবে কোথা থেকে?
আহসান এইচ মনসুর: সরকার এ ঘাটতি অর্থায়নের জোগান দেবে তিন জায়গা থেকে। এর মধ্যে বিদেশ থেকে ১ লাখ কোটি টাকা, ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা, আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হতে পারে বলে জেনেছি। আগামী বাজেটে ঋণের সুদ, ভর্তুকি, বেতন-ভাতা, সামাজিক নিরাপত্তা বাবদ প্রায় সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা যেতে পারে। রাজস্ব থেকে আসতে পারে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ৬০ বা ৭০ হাজার কোটি টাকা। বাকি টাকা কোথা থেকে আসবে? অন্যান্য খাতের কী হবে?
সমকাল: রাজস্ব আদায়ে আমরা পিছিয়ে গেলাম কেন?
আহসান এইচ মনসুর: আমাদের এখানে অর্থনীতির আকার বাড়ছে; কিন্তু রাজস্ব বাড়ছে না সেই হারে। ফলে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত, যেটি আমরা অর্থনীতিতে হাইলাইট করি সবসময়, তা বাড়ছে না। ২০১০, ২০১১ সালের দিকে দেখা গেছে, আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত ছিল প্রায় ১১ শতাংশ। এখন সেটি কমতে কমতে সাড়ে ৭ শতাংশে এসেছে। উন্নত দেশগুলোতে এটি হয় ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে তা হয় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। ভারতে এটি ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। নেপালে ২২ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা সবার চেয়ে কম। এমনকি শ্রীলঙ্কার চেয়েও কম। এমন অবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়।
সমকাল: এর মূল কারণ কী?
আহসান এইচ মনসুর: আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থা করা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। তা আর পরিবর্তন হয়নি। একটি অর্থনীতি যেটি হয়তো ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার, সেটি এখন হয়ে গেছে ৪৫০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ১০ বিলিয়ন ডলারের জন্য যে কর প্রশাসন করা হয়েছিল, আমরা সেটিরই শুধু পরিসর বাড়াচ্ছি। আমাদের পুরো রাজস্ব ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করতে হবে। গোটা রাজস্ব ব্যবস্থায় অনেক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কাজ করে। তাদের যদি ম্যানেজ করতে না পারি, যেটি সরকার এখনও পর্যন্ত পারেনি, তাহলে এ ব্যবস্থা বদলানো যাবে না। ২০১২ সালে উন্নত ভ্যাট আইন হয়েছিল। সংসদে পাস হওয়ার পর ২০১৭ সালে সেটি পরিবর্তন করে বাস্তবায়ন করা হয়। যেটি বাস্তবায়ন করাই উচিত হয়নি, সেটি করা হয়েছে। ফলে রাজস্ব বাড়েনি। সময়ের সঙ্গে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে হবে, সেটি আমরা করিনি।
সমকাল: কর আরোপের ক্ষেত্রে কি মধ্যবিত্তকে বেশি নিশানা করা হয়?
আহসান এইচ মনসুর: বাংলাদেশে সম্পদ আহরণ হয় দুইভাবে। প্রধানত হয় জমি থেকে। শহরাঞ্চলের জমি। যেমন- পূর্বাচলে হাজার হাজার একর জমি পড়ে আছে। এগুলো সবই স্পেকুলেশন হচ্ছে। সরকারের কাছ থেকে প্রতি কাঠা দুয়েক লাখ টাকা করে কিনেছে, এখন বিক্রি করছে কোটি টাকায়। দাম বাড়ছে। এটা করমুক্ত বৈধ আয়। এর মালিক কারা? ধনিক শ্রেণি। কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনারা উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে কী করেন? তারা বলবে, আমরা জমি কিনি; কারণ আমাদের পরিসর আরও বাড়াতে হবে। করমুক্ত থাকায় এটি খুবই লাভজনক। এভাবে বড় অঙ্কের সম্পদ আহরণ করা হয়। আরেকটি ক্ষেত্র হলো– অবৈধ উপায়ে অর্থ আয়। তারাও জমি, অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়ে তা ব্যয় করে। এটি আবার ঘোষিত উপায়ে কালো টাকা সাদা করার পথ। তৃতীয় ক্ষেত্র হলো– বিদেশে অর্থ পাচার। যখন দেখা গেল দেশে অনেক জমি, ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে, আর আস্থা পাওয়া যাচ্ছে না; তখন তারা এ টাকা বিদেশে পাচার করে দেয়।
সমকাল: ধনিক শ্রেণি যতটা করের আওতায় আসার দরকার ছিল, আমাদের কাঠামো সেটি করেনি?
আহসান এইচ মনসুর: আমাদের আয়ের উৎসটাই অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এটি ধনিক শ্রেণির প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। কাজেই আমাদের সাদা টাকা গুণে লাভ হবে না। সাদা টাকা থেকে রাজস্ব কম আসে। দুর্নীতি বেশি হলে রাজস্ব কম হবে। কারণ সেটি কালো টাকা। এটি রাজস্বের আওতায় আসে না।
সমকাল: মাইক্রো ইকোনমিক সূচকের পরিমাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে কিছুটা, কিংবা বেশ কিছুটা, অস্থিতিশীল অবস্থায় আছে। দ্রুত স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বাজেটে কী ধরনের আগ্রাসী পদক্ষেপ গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে?
আহসান এইচ মনসুর: বাজেটের মাধ্যমে খুব বেশি সুযোগ নেই। অর্থনৈতিক দলিল হিসেবে বাজেটে একটি রূপরেখা থাকে। তবে বাজেট বক্তৃতা বা যে লিখিত বক্তব্য থাকে, সেখানে সুস্পষ্ট কিছু ঘোষণা আমরা পেতে চাই। আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যার মূলে মূল্যস্ফীতি। এ নিয়ে একটা সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকতে হবে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এটি সত্য। তবে এটিই পুরো গল্প নয়। যুদ্ধের কারণে সবারই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। করোনার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। অন্যরা তো তা মোকাবিলা করছে। আমরা পারছি না।
সমকাল: পারছি না কেন?
আহসান এইচ মনসুর: কারণ আমরা এমন কোনো পলিসি বা নীতি গ্রহণ করতে পারিনি। অন্যান্য দেশ সুদহার বাড়িয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত বাড়াইনি। সুদহার বাড়ালে আমাদের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বাধা দেবে। সরকারের বক্তব্য সুদহার বাড়িয়ে লাভ নেই। অথচ বিশ্বের সব বড় অর্থনীতির দেশই সুদহার বাড়িয়েছে। আমাদের এখানে সুদহার নির্দিষ্ট করে দেওয়া ৯ শতাংশ। ফলে অন্য খাতে কিছু করলেও আসে যায় না। এটি তো অপরিবর্তিত। এটিকে বাড়তে দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে কেউ যদি বছর দেড়েক আগে বাড়ি কিনতো ব্যাংক ঋণ নিয়ে, তাকে ২.৭ শতাংশ সুদ দিতে হতো; এখন কেউ বাড়ি কিনলে ৭ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ সুদ হিসেবে দিতে হবে। এটি কোনো জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত না। জনগণ এটি নিয়ে খুশি না। কিন্তু এটি করতে হয়েছে। আমরা সেটি করিনি।
সমকাল: গত এক বছরে ডলারের দাম ৮০ থেকে ১০৮ টাকায় পৌঁছে গেছে।
আহসান এইচ মনসুর: সরকার আগের ১২ বছর বিনিময় হার পরিবর্তন করেনি। এর ফলে চাপ তৈরি হয়েছে। এক লাফে তা বাড়াতে হয়েছে।
সমকাল: এতদিন বাড়ানো হলো না কেন?
আহসান এইচ মনসুর: এর পেছনেও এক ধরনের রাজনীতি কাজ করে। বিনিময় হার ধরে রাখলে মূল্যস্ফীতি হার কম হয়। দ্বিতীয়ত, ডলারের আয় বাড়ে। দেখা গেল, ডলার আয়ে আমরা ভারতের চেয়ে এগিয়ে গেলাম। এভাবেই এটি সম্ভব হয়েছে। এটি এখন আর নেই। কারণ আমরা তো একবারে ২৫ শতাংশ কমে গিয়েছি। এটি কৃত্রিমভাবে করা হয়েছিল, যা টেকসই হয় না। আমরা ওই নীতি গ্রহণ করায় আজ এক লাফে বিনিময় হার বেড়ে গেল। আমরা যদি ধীরে ধীরে বাড়াতাম, তাহলে আমরা এই জায়গাতেই আসতাম; কিন্তু সহনীয়ভাবে। হঠাৎ করে বিনিময় হার বেড়ে যাওয়াতে জিনিসপত্রের দাম ভীষণভাবে বেড়ে যাচ্ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
সমকাল: সুদহার অপরিবর্তিত রাখায় কি মধ্যবিত্তরা সুবিধা পাচ্ছে?
আহসান এইচ মনসুর: মধ্যবিত্তরা কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। ব্যাংকে যারা টাকা জমা রাখছেন, তাদের সুবিধা হচ্ছে না। ব্যাংক যে হারে সুদ দিচ্ছে, আর মূল্যস্ফীতির যে হার, তাতে ব্যাংকে জমা রাখা টাকা আসলে কমে যাচ্ছে।
সমকাল: তাহলে এ সুদহারে লাভ হচ্ছে কাদের?
আহসান এইচ মনসুর: ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা যারা ধার করছে তাদের লাভ হচ্ছে। জমি ও ঋণ– দুই ক্ষেত্রেই লাভবান হচ্ছে ধনিক শ্রেণি। তাঁরা যে টাকা ব্যাংক থেকে নিচ্ছেন, ফেরত দিচ্ছেন তার চেয়ে কম। কারণ মূল্যস্ফীতির হার সুদহারের চেয়ে বেশি।
সমকাল: আমাদের কোনো প্রকল্পই সময়মতো ও নির্দিষ্ট বাজেটে শেষ হয় না।
আহসান এইচ মনসুর: বাজেট বাস্তবায়নে অনেক ব্যর্থতা রয়েছে। একটি কৃতিত্ব আমি সরকার ও অর্থ বিভাগকে দিতে চাই– তারা বাজেট ব্যয় খুব ভালো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেহেতু রাজস্ব ঘাটতি হয়, তারা ব্যয় কমিয়ে ফেলে। এর মধ্য দিয়ে বাজেটকে একটা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রাখা হয়। যে কারণে এতদিন সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ভালো ছিল। তাদের বাজেট ব্যয়ের নিয়ন্ত্রণ ভালো; তবে ব্যবস্থাপনা ভালো না। এর মানে হলো– বাজেটে যে পরিমাণই বরাদ্দ থাকুক না কেন, সেই সেবা জনগণ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে কিনা, তা দেখভাল করা।
সমকাল: কর ব্যবস্থাপনার জন্য আপনার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব কি?
আহসান এইচ মনসুর: সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তো এক জায়গায় হবে না; কয়েক জায়গায়। প্রথমে হচ্ছে, ম্যাক্রো স্ট্যাবিলিটি আনতে হবে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। সুদহার বাড়াতে হবে, ডলারকে স্ট্যাবল করতে হবে। ফিজিক্যাল বাজেটকে সংযত রাখতে হবে, যেটি সরকার করছে। কিন্তু বাকিগুলো করছে না। মধ্যমেয়াদিভাবে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন রাজস্ব নীতিতে কিছু মৌলিক পরিবর্তন করতে হবে। যেখানে সম্পদ জমা হচ্ছে, যেমন ভূমিতে, সেটিকে করের আওতায় আনতে হবে।
সমকাল: এক্ষেত্রে নাগরিকদের দায়িত্ব কী? আমাদের নাগরিকরা তো করের আওতা থেকে পালিয়ে থাকতে চায়।
আহসান এইচ মনসুর: সব করদাতাই কর ফাঁকি দিতে চায়। কর ফাঁকি বা ট্যাক্স অ্যাভয়েড করা একটি হিউম্যান নেচার। কর আদায় করাটা হচ্ছে একটি প্রক্রিয়াগত সমাধান। তুমি ফাঁকি দিবা, কিন্তু আমি জানি, তুমি ফাঁকি কতখানি দিতে পারবা। একটি কথা আছে যে, ট্যাক্সদাতা থাকবে ডালে ডালে, সরকার থাকবে পাতায় পাতায়। তা না হলে পারবা না। সমস্যাটা হচ্ছে, আমাদের কর প্রশাসন সেই ১৯৪৭-এর আগের প্রশাসনের মতোই রয়ে গেছে। মাঝখান দিয়ে দুর্নীতি বেড়েছে। তাদের ক্ষমতাও বেড়েছে, মানুষকে হয়রানিও করছে; কিন্তু কর আদায় হচ্ছে না। এই সমস্যার সমাধান বিশ্বের অনেক দেশই করেছে। আমাদেরও করতে হবে।
সমকাল: কীভাবে করা যায়?
আহসান এইচ মনসুর: আমাদের এখানে পারসোনাল টাচ হয়ে যায়। হ্যান্ডশেক হয়। হ্যান্ডশেকের হ্যান্ড থাকবে না। সব হবে কাগজপত্রে। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন হয়, আমি ওয়াশিংটন থাকলাম, আমার ট্যাক্স রিটার্নটা যাবে মন্টানাতে। দুই-আড়াই হাজার মাইল দূরে। ক্যালিফোর্নিয়ারটা আসবে রোড আইল্যান্ডে। তিন হাজার সাড়ে তিন হাজার মাইল দূরে। বাংলাদেশের ভূগোল সেই তুলনায় ছোট। ঠিক আছে, রংপুরেরটা টেকনাফে দিয়ে দাও, খুলনারটা সুনামগঞ্জে দিয়ে দাও। দেখি, কীভাবে সাক্ষাৎ করে!
সমকাল: এ আলোচনাগুলো বাজেট পাশের সময় সংসদে হতে পারে না?
আহসান এইচ মনসুর: সংসদে আলাপ করতে পারে। কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, যদি দক্ষতা অর্জন করতে না পারি, বেসরকারি খাতে দেওয়াই সমীচীন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সাংসদরা নিজেদের ভেতর কলহে ব্যস্ত। তাঁদের একমাত্র অ্যাজেন্ডা নির্বাচন, যেটি নিয়ে তাঁরা আলাপ করেন।
সমকাল: ইলেকশন সুষ্ঠু না হলে তো সংসদ হয় না, সংসদে আলাপও হয় না।
আহসান এইচ মনসুর: আমি কখনোই দেখি না সংসদে দুর্নীতি ইস্যুটিকে বড় করে তুলেছে। কেন হয় না? কারণ দু’পক্ষই দুর্নীতি করে। কে কাকে দুষবে। পার্থক্য এটুকু, একদল গদিতে আছে, আরেক দল নেই।
সমকাল: শেষ প্রশ্ন করি, তাহলে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা কি অধরাই থেকে যাবে?
আহসান এইচ মনসুর: মানুষের কাছে দায়বদ্ধতা থাকবে যখন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোয় যা আছে, তখন কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে। গণতন্ত্রে যাঁরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তাঁদের দায়বদ্ধতা থাকতে হবে সাধারণ মানুষের প্রতি, জবাবদিহি থাকবে। সরকারি আমলারাও এই দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির আওতায়। নইলে আজকের জনপ্রতিনিধি পরের বছর জিতবে কী করে নির্বাচনে? অর্থাৎ কল্যাণ রাষ্ট্রের শর্ত একটিই। সুরক্ষিত গণতন্ত্র।
সমকাল: দীর্ঘ সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আহসান এইচ মনসুর: সমকালকেও ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন