আমরা ছিলাম ছয় ভাইবোন। আমাদের পারিবারিক বন্ধনটা বেশ দৃঢ় ছিল। সবাই সবার ঘনিষ্ঠ ছিলাম। ভাইবোনদের ভেতর নেতা ছিলেন আমাদের বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ। নানারকম পরিকল্পনা থাকত তাঁর মাথায়। আমরা তাঁর নেতৃত্বে সেই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতাম।

যখন ছোট ছিলাম, আমাদের একটা বড় দুঃখ ছিল– ঈদটা একসময় শেষ হয়ে যাবে!  ঈদের রাতে ঘুমানোর সময় সবার বুক ভেঙে যেত, ঈদ শেষ। কথাটা মনে হতেই ছোটবেলায় কেন এত কষ্ট হতো আজও ভেবে পাই না। এমন নয় যে আমরা সচ্ছল পরিবার ছিলাম, ঈদে অনেক কিছু পেতাম। আমাদের পরিবারটিকে তখন মধ্যবিত্ত কে জানে, হয়তো নিম্নমধ্যবিত্তই বলা যায়। কোনো ঈদে কেউ কাপড় পেয়েছি, কোনো ঈদে কেউ পাইনি। তবু খুব আনন্দ হতো। কেন হতো জানি না।

ঈদের আনন্দ শেষ হয়ে গেল– এই ভেবে আমাদের ভীষণ কষ্ট হতো বলে হুমায়ূন আহমেদ এর দায়িত্ব নিয়ে নিলেন, ঈদের আনন্দ যেন সহজে শেষ না হয়। ক’দিন খুব করে রিহার্সালের পর ঈদের রাতে এক বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন হতো আমাদের বাড়িতে। নাচ, গান, জারিগান, কবিতা আবৃত্তি, নাটক কিছুই বাদ পড়ত না। নির্দেশনায় সব সময় হুমায়ূন আহমেদ। মঞ্চ বানানো হতো, রঙিন কাপড় টাঙিয়ে সব সাজানো হতো। শুরু হতো অনুষ্ঠান। সেখানে যে শুধু আমাদের পরিবারের সদস্যরাই আসত তা নয়, গোটা এলাকার লোকজন বাচ্চাকাচ্চাসহ চলে আসত। অনেক রাত পর্যন্ত চলত অনুষ্ঠান। ভীষণ আনন্দ হতো! এভাবে ঈদ শেষ হয়ে যাওয়ার কষ্ট আমাদের অনেকটা লাঘব হয়েছিল। রোজার ঈদ বা কোরবানির ঈদের দিন পার হয়ে রাত নামলেই যে বুকে মোচড় দিত সেটা আর হতো না। কারণ তখন আর রাত নামলেই ঈদ শেষ নয়।

হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে অনেকের অনেক কৌতূহল তাই এখানে বলে রাখি– সে কিন্তু খুব ভালো অভিনয় করতে পারত। তার অভিনয় আর কেউ দেখেনি, আমরা দেখেছি। আগেই বলেছি ঈদের রাতে আমাদের ওই আনন্দ অনুষ্ঠানের নির্দেশনা দিতেন হুমায়ূন আহমেদ, ভবিষ্যতেও যে দেবেন সেটা তখনই বোঝা গিয়েছিল।

বাহাত্তর বা তিয়াত্তর সালের কোরবানি ঈদের একটা স্মৃতি মনে আছে। আমরা একটা ছাগল কোরবানি দিয়ে চামড়া ছাড়াতে গিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়েছিলাম। এ ব্যাপারে আমাদের কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিল না। কোনো অভিজ্ঞ লোককে ভাড়া করার সামর্থ্য ছিল না আমাদের। অথবা হয়তো আমরা সেটা চাইনি, সব সময়ই নতুন কিছু চেষ্টা করতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই– সেটা ছাগলের চামড়া ছাড়ানোও হতে পারে। তিন ভাই মিলে সব করেছিলাম। মনে আছে ভালো চাকু ছিল না বলে ব্লেড দিয়ে কাজ উদ্ধার করা হয়েছিল!

বাংলাদেশের নানান জায়গায় আমরা বিভিন্ন সময়ে ছিলাম বলে অনেক জেলায় ঈদ করার অভিজ্ঞতা আছে আমাদের। বান্দরবানের ঈদের কথা মনে পড়ে। এখন বান্দরবানে গেলে আমরা অনেক বাঙালি দেখতে পাই, মনে হয় আজকাল বাঙালিই যেন বেশি। আমরা যখন ছিলাম তখন মূলত পাহাড়িরাই ছিল। বান্দরবানে আমি যে স্কুলে পড়েছি সেখানে আমি, আমার বোন আর পাশের বাসার একটা মেয়ে– এই তিনজন ছিলাম বাঙালি। বাকি সবাই ছিল হয় মারমা না হয় চাকমা না হয় ম্রো কিংবা অন্য কোনো আদিবাসী বাচ্চা। ঈদ উদযাপনে সবার সেখানে একটা মিলিত অংশগ্রহণ ছিল।

এবার একজন অদ্ভুত মানুষের কথা বলি। একজন মুসলমান বাঙালি ছিল সেখানে,  যখন যে ধর্মের উৎসব হতো, লোকটা সেই ধর্ম গ্রহণ করে ফেলত। তারপর অংশ নিত সেই উৎসবে। আমার মনে আছে, একদিন ঈদের জামাতে আমরা বসে আছি, তাকে নিয়ে আসা হলো। যেহেতু ঈদ এসেছে, অন্য ধর্মে বিচরণ শেষে সে আবার মুসলমান হবে। ঈদের জামাতের আগে তওবা করিয়ে ইমাম সাহেব তাকে আবার ইসলাম ধর্মে নিয়ে এলেন। তখন মানুষের টলারেন্স অন্যরকম ছিল। এখন যদি কেউ এমন করে বিভিন্ন ধর্মে বিচরণ করে ঘুরে বেড়ায় তার জন্য সমাজ অনেক কঠিন হয়ে যাবে। টলারেন্স এখন অনেক কম।

এখনকার শিশু-কিশোররা একটা ব্যাপার করে কিনা আমার জানা নেই– বিভিন্ন ধর্মের বন্ধুদের উৎসবে যোগ দেওয়া। আমার একটা বই আছে, ‘চার বন্ধু’। একেবারে ছোট বাচ্চাদের জন্য লেখা। আইডিয়াটা হচ্ছে– চার বন্ধু, তাদের চার ধর্ম। যদিও আমি বইয়ের কোথাও লিখি নাই তারা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিষ্টান। শুধু লিখেছি প্রত্যেকের আলাদা উৎসব রয়েছে এবং তারা একে অপরের উৎসবে যোগ দেয়। তারা নিজেরা আলোচনা করে, ‘আমরা হচ্ছি পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান। কারণ, অন্য সবার যেখানে শুধু একটা করে উৎসব, সেখানে আমাদের চারটা!’

এই আইডিয়া দিতে চেয়েছিলাম– তোমার কাছে শুধু তোমারটাই উৎসব না, অন্যেরটাও তোমার উৎসব। ঈদটা আমার কাছে চিরকাল এমনই ছিল, আজও আছে। এখন যারা বড় হচ্ছে, তারা উৎসবগুলো এভাবে পালন করবে কিনা, সেটাই বড় কথা। তারা কি একে অন্যের উৎসবে যোগ দিচ্ছে?

ঈদের বাইরেও আরও অনেক ধর্মীয় উৎসব ছিল আমাদের। যেমন– শবেবরাত। একটা দারুণ আকর্ষণ ছিল, হালুয়া খাওয়া হবে, বাজি ফোটানো হবে। এখন শুনি এসব করা যাবে না। মিলাদও একটা আনন্দের জায়গা ছিল। এক পর্যায়ে সবাই দাঁড়িয়ে ইয়া নবী সালাম-আলাইকা বলতাম (কিয়াম)। আমরা ছোটরা অপেক্ষা করে থাকতাম কখন সবাই দাঁড়াবে। এখন এসব নেই। মিলাদের পর লাড্ডু কিংবা জিলাপি ছিল মূল আকর্ষণ, সেটাও নেই। বড়দের কথা আলাদা কিন্তু ছোটদের যে আনন্দের জায়গা ছিল, সেগুলো আজ আর নেই। তাদের আনন্দের বিষয়গুলো সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

একসময় ধর্মীয় বহুত্ববাদের ব্যাপারটা, অনেক ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের ব্যাপারটা অনেকটা সহজাত ছিল। এখন বিভাজন অনেক বেশি হয়ে গেছে মনে হয়। সবাই এখন এককভাবে নিজ ধর্মটাকেই বেশি দেখছে। উৎসব নেই, আছে শুধু অনুশাসন!
    
সামাজিক বিবর্তনের নানারূপ
আমরা সেই প্রজন্ম, যারা একাত্তর দেখেছে। একটা দেশ সবচেয়ে কঠিন যে অবস্থা পার করতে পারে, আমরা সেটা পার করে এসেছি। সুতরাং আমরা অল্পতে কাতর হই না। চোখের সামনে যা দেখেছি তা থেকে বলতে পারি, এত বড় আত্মত্যাগ আর কোনো জাতিকে করতে হয়েছে কিনা আমার জানা নাই। এত বড় আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া দেশটা যেভাবে দাঁড়ানোর কথা ছিল যদি সেভাবে দাঁড়াতে না দেখি তখন হতাশ হই না, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করি। কিন্তু যখন দেখি কিছু মানুষ আমাদের সেই আত্মত্যাগকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, তখন কষ্ট পাই না বরং ভয়ানক ক্রোধ হয়। আমি অনেক কিছু সহ্য করতে পারলেও এ বিচ্যুতি সহ্য করতে পারি না।
এর বাইরে সামাজিক পরিবর্তন যা হয়েছে, হয়ে যাচ্ছে, সেটা প্রাকৃতিক। তা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

প্রযুক্তির কথায় যদি আসি, এর কিছু কিছু দিক আমাদের ক্ষতি করেছে। যেহেতু আমি শিক্ষক, অতীত আর বর্তমানের শিক্ষার্থীদের গুণগত মানে একটা পার্থক্য আমার চোখে পড়েছে। এখন ওদের মনোযোগের পরিধি বা অ্যাটেনশন স্প্যান অনেক কম। যন্ত্রের ওপর খুব বেশি নির্ভরতাসহ ওরা অহেতুক সময় নষ্ট করার অনেক সুযোগ পায়। ফেসবুকসহ এ রকম সামাজিক মাধ্যমের কিছু ভালো দিক থাকলেও থাকতে পারে, আমার জানা নেই, কিন্তু সার্বিক বিচারে এই প্ল্যাটফর্মগুলো মানুষকে ব্যস্ত রেখে, আত্মতুষ্টি দিয়ে, আনন্দের একটা মিথ্যা অনুভূতি দিয়ে আসলে নিজেদের জন্য পয়সা কামাই করতেই তৈরি হয়েছে। এই ফাঁদে পা দিয়েছি আমরা। শুধু আমরাই না, সারা পৃথিবীর সব মানুষ। ১৭ জুন আমি একটা কনফারেন্সের মতো অনুষ্ঠানে ছিলাম। ইন্টারন্যাশনাল পেডিয়াট্রিক নিউরোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এসেছিলেন। পাশাপাশি বসেছিলাম দু’জন। ভদ্রমহিলার সঙ্গে তখন বেশ খানিকটা আলাপ হলো। তিনি জানালেন, সারা পৃথিবীতে অটিজমের হার অনেক বেড়ে গেছে। এর অন্য অনেক কারণ থাকলেও একটা কারণ নিশ্চিত, সেটি হলো স্মার্টফোনের প্রতি শিশুদের আসক্তি। এই ব্যাপারটা আমাকে আতঙ্কিত করে।

আমার সঙ্গে একটা বিশেষ বয়সী তরুণ-তরুণীর দেখা হলে তারা অনেক সময় আমাকে ধন্যবাদ জানায়। বলে, ‘আমাদের শৈশবটা আপনি আনন্দময় করেছিলেন। আপনার বই পড়ে আমরা বড় হয়েছি।’ এটা শুধু ওই একটা বয়সের তরুণ-তরুণীই বলে, ওদের পরের প্রজন্মের কেউ আর বলে না। ব্যাপারটা ভয় জাগায়। আমি টের পাই নতুন প্রজন্ম বই পড়ছে না, বই পড়া কমে যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে!

আমরা মানুষ, আমরা অ্যাবস্ট্র্যাকশন করতে পারি, যেটা নেই সেটা কল্পনা করতে পারি। এটা আর কেউ পারে না– [অবশ্য আজকালকার এআই (Artificial Intelligence) পারে কিনা আমি জানি  না!] যা-ই হোক, এই অ্যাবস্ট্র্যাকশনের খুব বড় প্রতিফলন হচ্ছে বই পড়া। বইয়ে কাগজের ওপর কিছু কিছু অক্ষর থাকে শুধু, আর কিছু না। অথচ এই কিছু অক্ষর দিয়েই বিস্ময়কর পুরো একটা জগৎ আমাদের মাথার ভেতর তৈরি হয়ে যায়। লেখক যেটা বলেছে সেটা বুঝতে পারি, যেটা বলেন নাই শুধু ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেটাও বুঝতে পারি। আবার কখনও লেখক হয়তো কিছু একটা লেখেননি, বোঝাননি, কিন্তু আমাদের মনে হয় তিনি বুঝিয়েছেন। এটা অত্যন্ত সফিসটিকেটেড, সূক্ষ্ম সুচারু একটা কাজ। এর কোনো তুলনা নেই। সেই কাজটা একটা প্রজন্ম করছে না, দেখে আমি ভয় পেয়ে যাই।   
    
স্বাধীনতা-উত্তর সময় ও ‘ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ’
আমি ভালো অভিনয় পারি না। আনিসুল হকের একটা নাটকে আমাকে একবার পর্দায় দেখা গিয়েছিল, কিন্তু ওখানে আমি নিজের ভূমিকাতেই অভিনয় করেছিলাম। নিজের ভূমিকায় থাকলে তো আর অভিনয় হলো না। তবে হ্যাঁ– নাটক আমি করেছি। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, সেলিম আল দীনের নাটক করেছি আমরা। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ছিলেন নাটকের পরিচালক। ওই সময়টা ভীষণ মধুর একটা সময় ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রেনেসাঁ বলতে যা বোঝায়, তাই শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন থেকে একেবারে রাতারাতি সব বন্ধ হয়ে যায়।

হ্যাঁ, এ দেশে সমস্যা ছিল। খাদ্যাভাব ছিল, মানুষ না খেয়ে ছিল, মারাও গিয়েছিল সব সত্যি। তবে অনেক সৃজনশীল কর্মকাণ্ডও হতো, যেগুলো ১৫ আগস্টের পর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
নাটকের কথায় ফিরি। আমি নাটক করেছিলাম এবং লিখেছিলামও। সায়েন্স ফিকশন নাটক। সে নাটক আমার নির্দেশনায় মঞ্চস্থও হয়েছিল। সালটা নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না, ১৯৭৪ সাল হতে পারে। নাটকের নাম– ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ। আনাতেলি দনিপ্রেভেবের লেখা গল্প, বাংলাদেশের পটভূমিতে নাট্যরূপ দিয়েছিলাম। ম্যাক্সওয়েল সমীকরণকে বাংলাদেশের প্রথম সায়েন্স ফিকশন নাটক বলা যেতে পারে।      
 

শৈশবে লেখা সায়েন্স ফিকশন
আমাদের বাসায় বই পড়া আর লেখার ব্যাপারটা খুব সহজ ছিল। কেউ ভাবত না যে লেখা একটা কঠিন ব্যাপার আর শুধু বিশেষ কিছু মানুষই লিখতে পারে। বাবা উৎসাহ দিতেন, তাই সবাই কিছু না কিছু লিখত। বাবা সবাইকে লিখার জন্য ডায়েরি দিতেন। ডায়েরি কীভাবে লিখতে হয় আমি জানতাম না। আমি হুমায়ূন আহমেদের ডায়েরি থেকে নকল করে আমার ডায়েরি লিখতাম, সে খুব বিরক্ত হতো তখন!  
আমি যখন আমার প্রথম সায়েন্স ফিকশন লিখি তখন বোধ হয় ক্লাস থ্রিতে পড়ি। তখন অবশ্য সায়েন্স ফিকশন কাকে বলে জানতাম না, এখন বুঝতে পারি সেটা সায়েন্স ফিকশন ছিল। গল্পটা আজ আর পুরো মনে নেই। যেটুকু মনে আছে– ক’জন বাচ্চা মিলে লোহালক্কড় আর টিন জুড়ে দিয়ে একটা রকেট তৈরি করেছে। সেই রকেটে করে তারা অন্য একটা গ্রহে গিয়েছে। গল্পের বৈজ্ঞানিক অংশটা হচ্ছে এ রকম : অন্য গ্রহে গিয়ে তারা বুঝতে পারছিল না সেখানে শ্বাস নেওয়া যাবে কিনা। তখন তারা একটি মোমবাতি জ্বালাল। দেখল মোমবাতিটা জ্বলছে। বুঝতে পারল ওখানে অক্সিজেন আছে। তারপর সবাই হেলমেট খুলে শ্বাস নেয়। তখন আমি জানতাম না শুধু লিখলেই হয়, আমার ধারণা ছিল গল্পের কাহিনির সঙ্গে ছবিও আঁকতে হয়। তাই গল্পের জন্য কিছু ছবিও এঁকেছিলাম।

রোবটের অবসাদ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
[কপোট্রনিক সুখ-দুঃখের শেষে রোবটদের আত্মহনন বিষয়ে]
রোবট কি অবসাদগ্রস্ত হতে পারে? পৃথিবীতে মানুষের সভ্যতার ইতিহাস যদি কেউ পড়ে তাহলে কিছু বিষয় দেখতে পাবে। মানুষের সভ্যতার বয়স খুব বেশি নয়। শুরু থেকে এ পর্যন্ত সাধারণ কিছু বিষয়ে মিল লক্ষণীয়। যে জাতি অনেক দুঃখকষ্টে ছিল, তাদের ভেতর থেকে সভ্যতা সেভাবে আসেনি। তারা টিকে থাকা নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল। আবার যারা খুব বিত্তশালী হয়ে উঠেছিল, বিলাসী আর অলস জীবনের কারণে তাদেরও সভ্যতার বিকাশ থেমে যায়। কেবল মাঝামাঝি পর্যায়ের ছিল যারা, যাদের মধ্যে অভাব ছিল, স্বস্তি ছিল, সংগ্রাম ছিল আবার স্থিতিও ছিল, দেখতে পাই তাদের ভেতর সৃজনশীলতা অনেক বেশি আত্মপ্রকাশ করেছে। সভ্যতার জন্ম দিয়েছে সেইসব সমাজ বা জাতির মানুষেরাই।

এ কথা আমি এখন জানি, কিন্তু যখন কপোট্রনিক সুখদুঃখে অবসাদগ্রস্ত রোবটদের আত্মহননের কথা লিখছিলাম তখনও জানতাম না। আমার বয়স তখন আর কত! তবে আমি কল্পনা করে নিয়েছিলাম, একটা সমাজে যা যা থাকা প্রয়োজন তার প্রায় সবকিছু যদি থাকে, তখন সেই সমাজ ক্রমশ থমকে যায়। জায়গা করে নেয় অবসাদ। এটা ঠিক যে রোবট যন্ত্র, আর যন্ত্র হিসেবে সে নিজেও ক্ষয়ের ভেতর দিয়ে যায়। তবে যেটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল আমার গল্পে তা হলো মানুষকে পরাস্ত করে নিজেরা অতি উচ্চ সভ্যতা গড়ার পর তাদের সামনে অস্তিত্বের আর কোনো বড় চ্যালেঞ্জ ছিল না। বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ যেখানে নেই সেখানে আর কোনো আনন্দ নেই।

এখনকার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থার দিকে যদি তাকাই, দেখি, ওরা নিজ থেকে কিছু করছে না। ওদের যে ডাটা দেওয়া হচ্ছে সেই অনুপাতে একটা তৈরি সিস্টেমের অধীনে তারা কাজ করছে, ওরা টুলসের মতোন। তবে আমি জানি না গোপন কোনো গবেষণা হচ্ছে কিনা, যেখানে ওদের কোনো কাজ দিয়ে বলা হচ্ছে– নিজেদের মতো করো। জানতে পারলে ভালো হতো। যদি তেমন হয় তো ব্যাপারটা ভয়ের হয়ে উঠতেই পারে।

কিছুদিন আগে এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে একজন আমেরিকান প্রযুক্তিবিদ একটা কথা বলে ফেলেছিলেন, পরে অবশ্য কথাটা ফিরিয়েও নিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন– একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ ড্রোনকে কোথাও পাঠানো হয়েছে, এবং যে কাজ দিয়ে পাঠানো হয়েছিল ড্রোন সেটা না করেই ফিরে এসেছে। কারণ ড্রোনটার মনে হয়েছে কাজটা তার করা ঠিক হবে না, সে এসে তার উৎক্ষেপণ কেন্দ্রটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে! পরে অবশ্য সেই ব্যক্তি আর প্রতিষ্ঠান পুরো ব্যাপারটা অস্বীকার করেছে, কিন্তু একটা বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে সবার সামনে বলা বক্তব্য, এর মাঝে কি কোনো সত্যতা নেই? মনে হয় আমাদের হয়তো ভাবার বিষয় আছে। যদি সত্যিই এমন কিছু ঘটে আমাদের একটু দুশ্চিন্তা হতেই পারে!
    
একমুহূর্তের ভালোবাসা ও সহস্র বছরের ভালোবাসা
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ফর হুম দ্য বেল টোলসের কথা মনে পড়ে। রবার্ট গর্ডন সেখানে মারিয়াকে বিদায় দেওয়ার সময় কিছু কথা বলেছিল, আমার মনে দাগ কেটে আছে। বইটা আমার এত প্রিয় যে আমি আর দ্বিতীয়বার পড়িনি। যদি আগের মতো ভালো না লাগে! হ্যাঁ– একমুহূর্তের ভালোবাসা আর হাজার বছরের ভালোবাসা একই– কোনো না কোনো পথে আমি বিশ্বাস করি এ কথা। কাউকে ভালোবাসার একটা মুহূর্ত তাকে আজীবন ভালোবাসার সমান হতে পারে। কোনো ঘটনার স্থায়িত্ব দীর্ঘ হলে সেটা মহৎ আর ছোট হলে মহৎ না, আমার তা মনে হয় না।

আমেরিকায় রেখে আসা প্রিয় শিক্ষক, বন্ধু
আমার প্রিয় শিক্ষকদের একজন এরিক এডেলবার্গার। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আমার সুপারভাইজার ছিলেন, খুবই বড় বৈজ্ঞানিক! তাঁর বয়স নিশ্চয়ই এখন নব্বইয়ের কাছাকাছি, এখনও সমানে কাজ করে চলেছেন। কিছুদিন আগে দেখলাম তিনি কয়েক মিলিয়ন ডলারের একটা বরাদ্দ পেয়েছেন তার গবেষণার জন্য! তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পারার অভিজ্ঞতা আমার সব সময় মনে থাকবে। একটা মানুষ যে এত কাজের মানুষ হতে পারে তাঁকে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না। তিনিও আমাকে যথেষ্ট পছন্দ করতেন। আরেকজনের কথা মনে পড়ে খুব, তিনি হারবার্ট হেনরিকসন। তাঁর সঙ্গে যখন পরিচয় তখন আমার বয়স ত্রিশও হয়নি বোধ হয়। তাঁর বয়স তখন ষাটের ওপর। বয়সের এতটা ব্যবধানের পরও তাঁর সঙ্গে আমার ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। প্রকৌশলী ছিলেন তিনি। আমি যখন কোনো এক্সপেরিমেন্ট করতাম, তার ডিজাইনগুলো করার সময় তিনি আমাকে সাহায্য করতেন। তিনি আমাকে লেখালেখি সম্পর্কে একটা সুন্দর কথা বলেছিলেন যেটা আমি সব সময় মনে রেখেছি! কথাটা হচ্ছে ‘Do not ruin a good story with facts’ সত্যি কথা বলে একটা মজার গল্প নষ্ট করবে না। আমার কোনো একটা বই তাঁকে উৎসর্গ করার সময় এ কথা উল্লেখ করেছিলাম আমি। 
আমি জানি না হারবার্ট এখনও বেঁচে আছেন কিনা। হয়তো আছেন, হয়তো নেই। আমার সেরা বন্ধুদের একজন হিসেবে তিনি সব সময় আমার হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।


অ্যাবস্ট্র্যাকশন ও ইচ্ছার স্বাধীনতা
অস্তিত্ববাদ বলছে আমাদের নিয়ে প্রকৃতির বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমরা নিজেরাই আমাদের জন্য উদ্দেশ্য নির্ধারণ করি। নিজেদের জন্য উদ্দেশ্য নির্ধারণ করার কথা বললে ইচ্ছার স্বাধীনতার প্রসঙ্গ চলে আসে। আমাদের কি ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে? আমার বিশ্বাস করতে ভালো লাগে ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে। চারপাশের প্রকৃতি সচেতন বা অবচেতনে অনেক ঝোঁক তৈরি করতে পারে কোনো ব্যক্তির ওপর। যে ঝোঁকগুলোর ওপর নির্ভর করে সে কোনো প্রভাবিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে; যা দেখে ধারণা হতে পারে তার বোধহয় ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই। আবার বিবর্তনে মানুষ লাখো বছরে আজকের রূপ পেয়েছে। সুতরাং তার কোনো পছন্দ-অপছন্দ অতীতে টিকে থাকার সংগ্রাম দিয়েও প্রভাবিত হতে পারে।

কিন্তু আমি একটা কথা আগেও বলেছি, এখনও বলছি, মানুষ একমাত্র প্রাণী যে অ্যাবস্ট্র্যাকশন করতে পারে। যা নেই তা কল্পনা করতে পারে। আর যে মুহূর্তে মানুষ এই ক্ষমতা অর্জন করেছে, সেই মুহূর্তে কিন্তু সবকিছু বদলে গেছে। যখন আমি অ্যাবস্ট্র্যাকশন করতে পারতাম না, আমার জিনের ভেতর যা আছে– ভয়, ক্ষুধা, ভালোবাসা– সেটাই আমাকে নানান দিকে চাহিদা অনুযায়ী নিয়ে যেত। কিন্তু আমার ক্ষমতায় অ্যাবস্ট্র্যাকশন যুক্ত হওয়ার পর হিসেব যখন বদলে গেল তখন আমি হঠাৎ করে মুক্ত হয়ে গেলাম। এখন কিন্তু আমি আর আগের জায়গায় নেই। আমার ধারণা, কখনও যদি অ্যাবস্ট্র্যাকশনের ক্ষমতা মানুষের নষ্ট হয়ে যায় তো আবার সে ফিরে যাবে আগের জায়গায়। যেখানে হয়তো ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকবে না।

লেখার আনন্দ, গল্প ভাবনা
মানুষের মস্তিষ্ক গল্পের জন্য পাগল হয়ে থাকে। আমি সবাইকে বলি, তোমরা যদি আমার কথা বিশ্বাস না করো, একদিন কোনো বন্ধুকে নিয়ে বাসে উঠে বাসের সব লোককে শুনিয়ে জোরে জোরে বলো, ‘জানিস, আজকে কী হয়েছে?’ দেখবে বাসের প্রতিটা লোক কানটা খাড়া করে ফেলবে কী হয়েছে শোনার জন্য! যে মানুষকে চিনে না, জানে না, তার কোনো কিছুতে কিছু আসে যায় না, এর পরেও তার কী হয়েছে জানতে চাইবে! একটা গল্পের জন্য সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, এটা মানুষের একটা মৌলিক ব্যাপার।

আমি যখন একটা গল্প তৈরি করি, অন্যরকম একটা আনন্দ হয়। আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময়গুলোর একটা হলো– গল্প লেখার আগে আমি যখন তার স্ট্রাকচারটা তৈরি করি। তবে মানুষের মস্তিষ্ক তো ব্যাখ্যা করার অতীত। যখন সত্যিই লিখতে শুরু করি তখন আরও অনেক কিছু চলে আসে, যা আমি চিন্তাও করিনি। লেখার সময় আমার ব্রেইন আমাকে সেই নতুন জিনিসটা উপহার দেয়, যেটা আমি তৈরি করিনি, আমার ভেতরের অন্য একজন করেছে। সেও আমি, তবু যেন আমি না। তখন গল্পটা আরও অন্যরকম হয়।

ছোটদের লেখা, বড়দের লেখা
আমাদের দেশে ছোটদের জন্য মানসম্পন্ন লেখা খুব কম হয়। যাঁরা বড় লেখক, যাঁদের লেখার ক্ষমতা অনেক বেশি, তাঁরা ছোটদের জন্য তেমন লেখেন না। ইংরেজি ভাষায় বাচ্চাদের সব রকম বয়সের জন্য লেখা আছে, পড়তে এত ভালো লাগে! আমাদের নেই। কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন, কিন্তু দুর্বল চেষ্টা। বাচ্চাদের বাচ্চা হিসেবে ধরে নিয়ে লিখছেন অনেকে। ছোট বাচ্চারা কিন্তু ছোট নয়। আমি নিজে যখন ছোট ছিলাম, আমি সব বুঝতাম। এখনও ছোট বাচ্চারা সবই বোঝে। কাজেই তাদেরকে ‘ছেলেমানুষ’ কল্পনা করে লাভ নেই। কেউ যদি তাদের ছেলেমানুষ কল্পনা করে লেখে তাহলে তাদের কাছে কখনও পৌঁছাতে পারবে না। আমাকে ছোট বাচ্চারা অনেকবার বলেছে, ‘আপনি বড়দের জন্য লিখবেন না। শুধু আমাদের জন্য লিখবেন।’ হয়তো এজন্যই আমি ওদের জন্য লিখি। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছা করে বড়দের জন্য লিখতে। একটা লেখা শুরু করেছি। দেখি কতদূর যেতে পারি, ভবিষ্যতে হয়তো আরও লিখব।
    
মহামারির দীক্ষা, মানুষের ভবিষ্যতের পথ
মহামারি মানুষের ভবিষ্যতের পথ অনেকটা বদলে দিয়েছে। শুরুতে একটা ছোট দিক বদলের কথা বলি– যেটা ইতিবাচক। মানুষ বুঝেছে, মুখোমুখি হওয়াটা কত গুরুত্বপূর্ণ! আমি মনে করি একজন মানুষ আমার সামনাসামনি আছেন, এটা একটা অসাধারণ ব্যাপার। মানুষের মুখোমুখি বসা, তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা, কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এটা মহামারি আমাদের জানিয়েছে। হয়তো আমরা ভুল দিকে যাচ্ছিলাম, মহামারির সংকট আমাদের ঠিক জায়গায় এনে দিয়েছে।

আমি কখনোই জুম-মিটিং সহ্য করতে পারতাম না, এখনও পারি না। অনেকে বলেন, জুম মিটিং হওয়ায় অনেক ভালো হয়েছে, এখন সহজে অনেক কাজ করে ফেলা যায়। আমি কিন্তু উল্টোটা মনে করি। মহামারিতে আমি যেহেতু এ মনোভাবের ভেতর দিয়ে গিয়েছি, আমি মোটামুটি নিশ্চিত আরও অনেকেই এর ভেতর দিয়ে গেছেন। এই দিকটা চোখে পড়ায় মানুষ হয়তো আগের চেয়ে আরও বেশি মানবিক হয়েছে আমি মনে করি।
মহামারিতে আমি আমার অনেক আপন মানুষকে হারিয়েছি। একজনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। যিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। মানুষ যখন বড় হয় তখন পরস্পরের ‘পরিচিত’ হয়, ‘বন্ধু’ আর হয় না। আমি যার কথা বলছি তিনি কিন্তু আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। মানুষটি প্রফেসর গাজী সালাউদ্দিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কভিডে আক্রান্ত হয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যান। এটা আমার জন্য একটা বড় আঘাত ছিল। আমি জানতাম এমন হতে পারে, আমি জানি মানুষ এভাবে চলে যায়, এর পরও কিছু বিষয় মন কখনও মানতে পারে না।
প্রফেসর গাজী সালাউদ্দিন আক্রান্ত হওয়ার পর একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছিল। তার মেয়ে ঢাকায় থাকত। এক রাতে মেয়েটা স্বপ্ন দেখল তার বাবা ভালো নেই। ঘুম ভেঙেই বাবাকে ফোন দিয়ে বলল, ‘বাবা তোমার কী হয়েছে?’ প্রফেসর গাজী সালাউদ্দিন বললেন, ‘মা, আমার জ্বর উঠেছে।’ মেয়ে সাথে সাথে চট্টগ্রামে গিয়ে বাবাকে নিয়ে এলো ঢাকায়। চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। কিন্তু মাত্র এক সপ্তাহে সব ওলটপালট করে দিয়ে প্রফেসর গাজী সালাউদ্দিন চলে গেলেন। মহামারির এটা আরেকটা দীক্ষা– আমরা বুঝেছি মানুষ কতটা ভালনারেবল।

শুনি যুদ্ধের পদধ্বনি
আমার মনে হয় আমাদের সামনে আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ আছে। এখন ড্রেস রিহার্সাল হচ্ছে। তবে সামনের যুদ্ধটা মানুষে-মানুষে মুখোমুখি যুদ্ধ নাও হতে পারে। মানুষ তো অনেক মূল্যবান। যুদ্ধের জন্য রোবট তৈরি হচ্ছে, ড্রোন তো আরও অনেক আগেই তৈরি হয়েছে, বহুদিন থেকে ড্রোন গিয়ে মানুষ মেরে আসছে।

আজকাল মানুষকে ঘিরে আমার একটা হতাশা কাজ করে। আমার একটা ধারণা ছিল, যত দিন যাবে মানুষ আরও উদার হবে, মুক্ত হবে। কিন্তু উল্টোটা ঘটছে। কেউ যদি ইতিহাস পড়ে, দেখবে ব্রিটিশরা কলোনি করে পৃথিবীতে মানুষকে কী নির্যাতনই না করেছে! আফ্রিকা থেকে কালো মানুষদের ধরে নিয়ে দাস হিসেবে আমেরিকায় বিক্রি করেছে। এই যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ আমেরিকা, তার ভিত্তিটা তৈরি করেছে ক্রীতদাসদের দিয়ে। এখনও আমেরিকার কিছু সাদা মানুষ আছে, যাদের ভেতর দাসপ্রথা নিয়ে কোনো অপরাধবোধ নেই। স্বার্থ, লোভের কারণে আবার যদি কখনও একই সুযোগ আসে, হয়তো তারা একই অপরাধ আবারও করবে, অন্যভাবে করবে।

কেউ যদি ইতিহাস পড়ে তাহলে দেখতে পাবে মানুষের ভেতর মৌলিক স্তরে কিছু বড় সমস্যা আছে। আমার কোনো কারণে একটা ধারণা হয়েছিল যে যত দিন যাবে হয়তো সমস্যাটা কেটে যাবে।  কেন এমন ধারণা হয়েছিল জানি না। নোয়াহ হারারি তাঁর স্যাপিয়েন্স বইয়ে দাবি করেছেন যে যুদ্ধে আজকাল আর মানুষ সেভাবে মারা যায় না, যেভাবে আগে যেত। আমি কিন্তু তা দেখি না। মানুষ সংখ্যার দিক দিয়ে সেভাবে হয়তো মারা যায় না, কিন্তু নিষ্ঠুরতা আগের চেয়ে অনেক গুণ বেড়েছে। আগে চোখের আড়ালে মারত, কাজটা সহজ ছিল, এখন চোখের সামনেই মারছে কোনো সংকোচ নেই। বিভাজনটা আরও অনেক বেড়ে গেছে। এই যে গ্রিসের উপকূলে প্রায় সাড়ে সাতশ মানুষের জাহাজ ডুবে গেছে, অথচ মনে হচ্ছে কারও কিছু আসে যায় না। ওরা শরণার্থী, ওদের আসতে দেওয়া যাবে না। পানিতে ডুবে মরে যাচ্ছে, মরে যাক, সমস্যা কী। মানুষের মাঝে বিভাজনবোধ এত করুণ স্তরে পৌঁছেছে। ভেবেছিলাম মানুষ এসব দূর করে ফেলবে। পারেনি। তবে এটাই আমার শেষ কথা নয়। আমাদের প্রজন্ম একাত্তর দেখেছে। আমরা দেখেছি, ভয়ানক নিষ্ঠুর সময়ে মানুষের ভেতর আশ্চর্য একটা ভালোবাসা, অবিশ্বাস্য একটা মাধুর্য জন্ম নিতে পারে। এটা মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ। আমি বলছি আমাদের সামনে আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ আছে, কিন্তু মনে মনে মানুষের এই গুণের ওপর আমি গভীর আস্থা না রেখে পারি না। 

গ্রন্থনা: হামিম কামাল