সীমান্তবর্তী জেলা শহর সুনামগঞ্জের লাখো মানুষকে অকাল বন্যা বা অতি বন্যার কষ্ট থেকে বাঁচাতে শহর সংরক্ষণ প্রকল্প জরুরি। এখন যে ড্রেজিং হচ্ছে তা অপরিকল্পিত। মাটি কোথায় ফেলা হবে, তার কোনো পরিকল্পনা নেই। কোন নদী কতটুকু খনন হবে, সেটিও স্পষ্ট করা হয়নি।  এক্ষেত্রে হাওরকে সুরক্ষিত রেখে প্রকৃতিবান্ধব উন্নয়ন প্রয়োজন। গত ১০ জুন সুনামগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরিতে সমকালের আয়োজনে ‘হাওরে আগাম বন্যা রোধে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিলে আলোচকরা এ অভিমত ব্যক্ত করেন


এম এ মান্নান এমপি আমরা ভাটির মানুষ, জলাভূমির মানুষ, আপাতত সমন্বয় করে আমাদের বাঁচতে হবে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেভাবে টিকেছিলেন, তা থেকেই শিক্ষা নিতে হবে। প্রকৃতির জায়গা প্রকৃতিকে দিয়ে, আমাদেরকে আমাদের জায়গায় থাকতে হবে। বন্যা আবহমানকালের বিষয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা এসবের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকেছিলেন। ওই সময় শিক্ষাদীক্ষায়ও অনগ্রসর ছিলাম আমরা। দশ গ্রাম খুঁজলেও অষ্টম শ্রেণি পাস লোক পাওয়া যেত না। বিদ্যুৎ ছিল না। খাবার পানি হিসেবে খাল ও নদীর পানি খেতে হয়েছে। কলেরাসহ বিভিন্ন রোগে মরতে হয়েছে। এমনই ছিল আমাদের জীবন। সেই জায়গা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এসেছে, টেকনিক্যাল কলেজে এসেছে, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট হবে। আমাদের সাক্ষরতা একসময় ছিল শূন্যের কোঠায়। এখন আমাদের সাক্ষরতা বেড়েছে, কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা বেড়েছে। বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ গেছে। হাওর অঞ্চলে বন্যা মোকাবিলায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বোঝাপড়া দরকার, বিবাদ করে সমস্যার সমাধান হবে না। হাওরে আর সড়ক নির্মাণ নয়, নিম্নাঞ্চলেও সড়ক হবে না। শেখ হাসিনা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মন্ত্রণালয় এটি বাস্তবায়ন করছে। আমরা ডুবো আর উড়াল সড়ক নির্মাণ করব। গাছ, মাছ, পশু, পাখি যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকেও আমাদের নজর রয়েছে। আমাদের সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে হবে।

আবু সাঈদ খান সমকাল সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। এরই অংশ হিসেবে হাওর, চরাঞ্চল, সমুদ্র উপকূল এলাকায় গোলটেবিল বৈঠক হয়েছে। যারা ভুক্তভোগী, তাদের কাছ থেকে সরাসরি সমস্যাগুলো জানার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা সমকালের মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে। সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চল আমাদের মুগ্ধ করে। এখানে এসে দুঃসংবাদও পেলাম। এখানে পাখির কলতান কমেছে। পাখিরা উড়ে গেছে। এজন্যই আমরা প্রকৃতি ও হাওরবান্ধব উন্নয়ন চাই। এমন উন্নয়ন কাম্য নয়, যে উন্নয়নের কারণে পাখিরা উড়ে যায়, মাছের বংশবিস্তার রোধ হয়, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যায়। প্রতি বছর অকাল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়, বাঁধ ভেঙে যায়। এ নিয়ে লেখালেখি হয়। এতে বড় ধরনের পরিবর্তন হয় না। এখানটায় গলদ রয়েছে। সেগুলো চিহ্নিত হওয়া উচিত। আমরা কিন্তু প্রকৃতিবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ করছি না, যে কারণে সংকট তৈরি হচ্ছে। এখানে যে লোকায়ত জ্ঞান আছে, তার সঙ্গে গবেষণালব্ধ জ্ঞানের সমন্বয় দরকার। বংশানুক্রমিকভাবে মানুষের যে অভিজ্ঞতা, তা উপেক্ষা করা যাবে না। কীভাবে জাতীয় সম্পদ রক্ষিত হতে পারে, এ ব্যাপারে নাগরিক আলোচনা হতে পারে।

পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ্‌ এমপি মূল প্রবন্ধে অকাল বন্যা ঠেকাতে দেওয়া প্রস্তাবনাকে যথার্থ মনে করছি, সুরমা-কুশিয়ারার উৎসস্থল বা অমলসিদ থেকে ভৈরব পর্যন্ত নদীকে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় নিতে হবে। এখন যে ড্রেজিং হচ্ছে, তা অপরিকল্পিত। মাটি কোথায় ফেলা হবে তার কোনো পরিকল্পনা নেই। কোন নদী কতটুকু খনন হবে, তা স্পষ্ট করা হয় না। সাধারণ মানুষ হাইড্রোলিক চার্ট বোঝে না। ফলে নদী কতটুকু খনন হওয়ার কথা, কতটুকু হচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলের পানিপ্রবাহের খালগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের নামে গ্রামের গোপাটগুলোতে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। যেখানে পানির প্রবাহ আছে, সেখানে অপরিকল্পিতভাবে কালভার্ট ছাড়া সড়ক হচ্ছে। এ ছাড়া হাওরের পানি ধারণের বিলেও এখন পানি থাকে না। উন্নয়ন স্কিমে জলাশয় ইজারা নিয়ে জলাশয় খনন করা হয় না। সুনামগঞ্জ শহর রক্ষা করতে শহর রক্ষা বাঁধের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাহলে শহরের মানুষ নিরাপদ বোধ করবে।

অ্যাডভোকেট শামীমা আক্তার খানম এমপি পানির প্রবাহ ও নদীর গভীরতা বাড়ানোর জন্য কার্যকর নদী খনন হচ্ছে কিনা, তা আমাদের জানতে হবে। দেখা যায়, ১৬ কিলোমিটার নদী খননের প্রয়োজন, সেখানে চার-পাঁচ কিলোমিটার খনন করেই কাজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশ বিধ্বংসী সব ধরনের কাজ বন্ধ করতে হবে। হাওর অঞ্চলে বাজারের পাশে নদীর পাড়ে পলিথিনের স্তূপ পড়ে। এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। যাচাই-বাছাই না করে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ দেওয়ার কারণে পাঁচ বছর পর হাওরে বাঁধ দেওয়ার মাটিও পাওয়া যাবে না। বাঁধ নির্মাণ পরিকল্পনা গ্রহণে আরও সচেতন হতে হবে। তাহিরপুরের যাদুকাটা নদীতে রাতের আঁধারে বোমা মেশিন চলে। চার বছর তা বন্ধ ছিল, এখন আবার এটি চালু হয়েছে। ফলে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী হাওর অঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জে প্রায় প্রতি বছর বন্যা হয়ে থাকে। এই বন্যার পানি যেন মানুষের জন্য ক্ষতিকর না হয়, সেদিকটায় খেয়াল রাখতে হবে। এখান থেকে পানি মেঘনা হয়ে সাগরে পড়ছে। মেঘনা যাওয়ার যে পথগুলো আছে, সেগুলো এখন ভরে গেছে। সেটি প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট, যে কারণেই হোক, সেটিকে যদি আমরা ক্লিয়ার করতে পারি, তাহলে হাওরে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক থাকবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। আমরা যদি সচেতন হই এবং নদীর যে স্বাভাবিক প্রবাহ আছে, তা বন্ধ না করি তাহলে অকাল বন্যা থেকে হাওর অঞ্চল রক্ষা পাবে।


মো. এহ্‌সান শাহ জেলায় ১৩৭টি হাওর রয়েছে। এখানে পৌনে দুই লাখ হেক্টর জমি রয়েছে, এর মধ্যে এক লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়। পর্যটক ও মানুষের সহজ চলাচলের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রী যেভাবে চিন্তা করেছেন, সেভাবে ইকোসিস্টেম ঠিক রেখে হাওর অঞ্চলে উন্নয়ন হবে বলে প্রত্যাশা করি। ইকোসিস্টেম ঠিক রেখে নদী খনন ও হাওরে পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে।


নাদের বখ্‌ত সুনামগঞ্জের লাখো মানুষকে অকাল বন্যা বা অতি বন্যার কষ্ট থেকে বাঁচাতে শহর সংরক্ষণ প্রকল্প জরুরি। নদীর পানি ৭ দশমিক ৮ মিটার হলেই শহরের ঘরবাড়িতে পানি ওঠে। অথচ এই সুরমা পাড়েরই শহর সিলেটে নদীর পানি ১০ মিটারের ওপর দিয়ে গেলেও শহরবাসী সমস্যায় পড়েন না। অকাল বন্যার কবল থেকে ফসল রক্ষার বিজ্ঞানসম্মত স্থায়ী সমাধানের পথ বের করতে হবে। দুবাইয়ে সাগরকে নিয়ন্ত্রণ করে যদি শহর বানানো যায়, তাহলে এখানেও নিশ্চয়ই এ ধরনের বৈজ্ঞানিক সমাধান আছে। সুনামগঞ্জ শহরে প্রোটেকশন ওয়াল দরকার, যা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে করা সম্ভব। এখনও তা হয়নি। বসে থাকলে চলবে না। শহরে পাঁচটি খাল বিলীন হয়ে গেছে, যা ৪০-৪৫ ফুট প্রশস্ত ছিল। সেগুলো চিহ্নিত করে উদ্ধার করা জরুরি। প্রশাসন দখল হয়ে যাওয়া খাল চিহ্নিত করে দিলে আমরা তা উদ্ধার করে দিতে পারব। সামান্য বৃষ্টি হলেই শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পানি বের করার জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা অপ্রতুল। ড্রেনগুলো যে পরিমাণ প্রশস্ত ও গভীর হওয়ার কথা, তা নেই। এলজিইডির কাছে যদি ১২ ফুট প্রস্থের ড্রেন প্রস্তাব করি, পাওয়া যায় আড়াই ফুটের, যা দিয়ে অকাল বন্যার পানি নিষ্কাশন হয় না।

করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বছর বছর নদী খনন করে কারও পকেট ভারী হোক, তা চাই না। নদী খননে অনিয়মের পেছনে থাকা রাঘববোয়ালদের চিহ্নিত করতে হবে। নিয়মনীতি অনুযায়ী নদী খনন করতে হবে। হাওরে স্থাপনা নির্মাণে পরিকল্পনা ও নীতিমালা দরকার। পানি সহনীয় ধান আবিষ্কার করতে হবে। বজ্রপাতের ভয়ে কৃষক হাওরে যেতে চান না। বজ্রপাত থেকে কৃষকদের বাঁচাতে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় হাওর থেকে গাছ, মাছ উজাড় হচ্ছে। সেগুলো প্রতিহত করতে হবে। অসাধু পিআইসি ব্যবসায়ীদের রুখতে হবে। পিআইসি গঠনে গণশুনানি চেয়ারম্যান বা ইউএনওর কক্ষে যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিবেশবান্ধব পর্যটন দরকার।


কুমার সৌরভ আমাদের ঋতু বৈচিত্র্যের বাংলাদেশে মৌসুমি বন্যা একটি অতি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রবণতা। সমস্যা হয় যখন স্বাভাবিক বন্যার বদলে অগ্রিম অকাল বন্যা বা অতি বন্যা হয় তখন। গত বছরের সুনামগঞ্জে জুন মাসে অতি বন্যা এবং ২০১৭ সালে অগ্রিম অকাল বন্যার ভয়াবহ রূপ দেখা গেছে। ২০১৭ সালে শতভাগ বোরো ফসল মাঠেই ডুবে গিয়েছিল। সুনামগঞ্জের প্রধান ফসল বোরো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে অগ্রিম অকাল বন্যার কারণে। হাওরে নির্মিত ফসল রক্ষা বাঁধগুলো মাঝারি বা বড় আকারের অকাল বন্যা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। বোরো ফসলের জন্য মে মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত হাওরকে বন্যার ঝুঁকিমুক্ত রাখতে হয়। প্রধানত উজানের ভারত অংশে এবং অভ্যন্তরীণ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে হাওরে জলাবদ্ধতা তৈরি হয় এবং নদীর কূল উপচে হাওরে পানি ঢুকে ফসল নষ্ট করে। উজান থেকে নেমে আসা পানি যেসব ছড়া, নদী দিয়ে প্রবাহিত হয় সেসব অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে। হাওর মধ্যস্থ প্রাকৃতিক খাল, নালা ও জলাশয় ভরাট হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে ছোট-বড় প্রায় ২৩টি নদনদী প্রবাহিত হয়েছে। অকাল বা অতি বন্যার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এই নদনদীগুলোকে রক্ষাকবচে পরিণত করা গেলে স্থায়ী সমাধানের পথ উন্মুক্ত হবে। হাওর অধ্যুষিত সাত জেলার মধ্যে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা সবচেয়ে বেশি। সুনামগঞ্জে মোট হাওর এলাকার শতকরা ২৫ ভাগ পড়েছে। দেশের মোট উৎপাদিত ধানের শতকরা ১০ ভাগের জোগান আসে হাওর অঞ্চল থেকে। কেবল বোরো ধানকে বিবেচনায় নিলে হাওর অঞ্চলে উৎপাদন হয় শতকরা ২০ ভাগ। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে হাওরের বিশাল অবদান রয়েছে। শাহজাহান কবির বন্যা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ব্রিটিশরা যখন শাসন করার জন্য ভারতবর্ষে এসেছিল, তখন আসাম থেকে বন উজাড় করার যে ধারা সৃষ্টি করেছিল তা ব্রিটিশদের চলে যাওয়ার পরও অব্যাহত রয়েছে। বন উজাড় হওয়ার কারণে পাহাড়ে বৃষ্টিপাত হলে অতিরিক্ত পলি, বালু এসে আমাদের নদীগুলো ভরাট হচ্ছে, নাব্য হারাচ্ছে। হাওরে বন্যা সমস্যার সমাধানে পাউবোর কাজ ফলপ্রসূ হচ্ছে না। অপরিকল্পিতভাবে সড়ক, বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। ২১টি পয়েন্ট দিয়ে পানি প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেগুলো দূর করতে হবে। ভারতে নানা প্রকল্প রয়েছে। আন্তর্জাতিক রীতি অনুসারে পানির হিস্যা পাওয়ার বিষয়টি সংকটের দিকে যাচ্ছে। পাউবোর অপরিকল্পিত প্রকল্প বাদ দিতে হবে।


স্বপন কুমার দাস রায় আগে দেখেছি, হাওরে পানি চলে এলে টিনের কৌটা বাজিয়ে বাঁধের কাজ করার জন্য লোকজনকে ডাকা হতো। পরদিন ঠিকই সবাই মিলে বাঁধ নির্মাণ করত এবং নির্বিঘ্নে ফসল ঘরে তুলত। বন্যা আটকানো সম্ভব নয়। নিরাপদে বাঁচার চিন্তা করতে হবে। পাউবোর কাজ কাগজে-কলমে হচ্ছে। পিআইসির মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে কৃষিজমি নষ্ট করা হচ্ছে। কাগজে-কলমে বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করতে হবে।



 আনিসুল হক নাব্য কমে নদীগুলো পানির ধারণক্ষমতা হারিয়েছে। নদী খননের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতা রয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নদী খনন করে তা রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমান সরকারের সময়েই অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ ও সড়কের কাজ করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে বেশি। প্রতি বছরই বাঁধের কাজে ঝুঁকি বাড়ছে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দ্রুত নদী খনন করতে হবে।



নিগার সুলতানা কেয়া আমরা শুধু অপরিকল্পিত বাঁধ নিয়ে কথা বলি। হাওরে অপরিকল্পিত বাড়িও দেখা যায়। অপরিকল্পিত রাস্তাঘাটও হয়। পরিকল্পিত কালভার্ট হয় না। অপরিকল্পিত বাড়ি নির্মাণ ও রাস্তার কারণে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। একই সমস্যা পৌর শহরেও রয়েছে। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলার কারণে ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকার্যকর হচ্ছে। ড্রেন ভরাট হচ্ছে। বন্যার সময় দ্রুত পানি বৃদ্ধি পায়, সেই পানি দেরিতে নামে। এ জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নীতিমালা ছাড়া বাড়িঘর নির্মাণ বন্ধ করতে হবে।



অ্যাডভোকেট এনাম আহমেদ সীমান্তের ওপারের ভারতীয় সীমানার পাহাড়ে গাছ কেটে উজাড় করে দেওয়া হচ্ছে। বন্যা ঠেকাতে গেলে প্রতিবেশী দেশগুলোকে লাগবেই। ভারত সরকার আন্তর্জাতিক ফান্ড থেকে কয়েক লাখ গাছ লাগাতে পারে। গত বছর আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছিলেন, বন্যায় সুনামগঞ্জ, সিলেট ভেসে যাবে। হতে পারে তারা তা প্রশাসনকে অবগত করেননি অথবা প্রশাসন অবগত হয়েও তা প্রচার করেনি। সুনামগঞ্জ দুর্যোগপূর্ণ এলাকা হিসেবে এখানে একটি আবহাওয়া অফিস স্থাপন জরুরি। বন্যার খবর আগে জানা গেলে মানুষ প্রস্তুতি নিতে পারবে। সুরমা নদীর পাড়ে জলিলপুর পর্যন্ত মাত্র ১০ কিলোমিটার বাঁধ দিলে একদিকে যেমন ওয়াকওয়ে হবে, অন্যদিকে বানের পানির প্রথম ধাক্কাও ফেরানো যাবে। শহরের খালগুলো উদ্ধার করতে হবে। হাওর খনন করে পানি মজুতের ব্যবস্থা করতে হবে।

আব্দুল অদুদ ইসলামপুর থেকে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ পর্যন্ত একটি খাল আছে, যা গভীরভাবে খনন করা গেলে দেখার হাওরে বাঁধ দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এতে মাছের প্রজননও বৃদ্ধি পাবে। প্রতিটি বাঁধে স্লুইসগেট করা গেলে সুনামগঞ্জ অকাল ও অতি বন্যা থেকে রক্ষা পাবে।



মোস্তফা ইকবাল আজাদ জেলায় প্রায় সোয়া দুই লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। সুনামগঞ্জের ফসল কীভাবে রক্ষা করা যায়, সে বিষয়কে সামনে রেখে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। প্রয়োজনে কিছু কিছু জায়গায় স্লুইসগেট করা হলে বাঁধগুলো রক্ষা পাবে। শুধু বাঁধ নির্মাণ করলেই হবে না, এর সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।



সুখেন্দু সেন ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৮ বার অকাল বন্যায় ফসলহানি হয়েছে। ২০১৭ সালের অকাল বন্যায় ফসলহানির পর বাঁধের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তখন হাওরে কৃষকের বিলাপ দেখেছি। ঢাকায় বসে পরিকল্পনা না করে বাঁধের কাছে এসে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এবার বাঁধের কারণে নয়; কপাল জোরে ফসল রক্ষা হয়েছে। ২০১৭ তে বাঁধের কাজে অনিয়ম হয়েছিল। সেই সময় থেকেই হাওর বাঁচাওসহ এই অঞ্চলে দাবি আদায়ের নানা আঞ্চলিক সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বাঁধে হাওরের ক্ষতি হচ্ছে।



মামুন হাওলাদার সুনামগঞ্জ জেলায় প্রতিবছর একই স্থানে ডুবন্ত বাঁধ মেরামত/পুনর্নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করার ফলে বর্তমানে হাওরের অধিকাংশ স্থানেই মাটির সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে এবং বাঁধ নির্মাণে প্রতিবছর ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অচিরেই এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব না হলে হাওর অঞ্চলে মাটির সংকটের কারণে বাঁধ পুনর্নির্মাণ/মেরামত কাজ বাধাগ্রস্ত হবে, যা আগাম বন্যায় হাওরের বোরো ফসল ঝুঁকির মুখে পড়বে। ফলে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে কমিটির মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। সুনামগঞ্জ জেলাধীন বিভিন্ন নদীর নাব্য বাড়ানোর মাধ্যমে হাওরের নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে নদীগুলোর খননকাজ বাস্তবায়নে ‘সুনামগঞ্জ জেলার হাওর অঞ্চলের আগাম বন্যা হতে বোরো ধান রক্ষার্থে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প দাখিল করা হয়। বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশন হতে ফিজিবিলিটি স্টাডিকরণপূর্বক ডিপিপি পুনর্গঠনের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আইডব্লিউএমআই সিইজিআইএস কর্তৃক ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। স্টাডি প্রতিবেদনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, জনসাধারণের মতামত গ্রহণের নিমিত্তে সুনামগঞ্জ জেলায় একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, জনসাধারণের মতামত গ্রহণ করে স্টাডি প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হলে প্রতিবেদনটি আরও পূর্ণাঙ্গ ও ফলপ্রসূ হতো। সেলিম আহমদ হাওর অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণ একটি অস্থায়ী সমাধান। এসব বাঁধ অকাল বন্যার পানি ঠেকাতে যথেষ্ট নয়। হাওরে কৃষির বিকল্প হিসেবে মৎস্য সম্পদ রয়েছে। তেমনি আরও বিকল্প পেশার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। হাওরে যেমন সমস্যা রয়েছে, তেমনি সম্ভাবনাও রয়েছে। সম্ভাবনাগুলোকে শনাক্ত করে কাজে লাগাতে হবে। ‘জল যার জলা তার’ আইন থাকলেও মধ্যস্বত্বভোগীরা মৎস্য সম্পদকে ভোগ করছে আইনের সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে। হাওরে আফাল (বড় ঢেউ) হলে বাড়িঘর বিলীন হয়ে যায়। হাওরের গ্রামগুলো রক্ষায় একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে।


শুভঙ্কর তালুকদার মান্না বোরো ফসল হারালে মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। কীভাবে স্বল্প সময়ে ফসল ঘরে তোলা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। বাঁধ নির্মাণে সততা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিতে হবে। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি না করে হাওর রক্ষা বাঁধের প্রকল্প বাস্তবায়নে কমিটিতে প্রকৃত কৃষকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।




অ্যাডভোকেট শামছুল আবেদীন বন্যা ঠেকানোর কথা বলে লুটপাট হচ্ছে। বাঁধ নির্মাণে যা খরচ হয়, তার চেয়ে রক্ষণাবেক্ষণে আরও বেশি টাকা খরচ হয়। অকাল বন্যা ঠেকাতে দেওয়া বালির বাঁধগুলো খুব বেশি উপকারে আসে না। বাঁধগুলো হরিলুটের ব্যবসা ছাড়া কিছুই নয়। হাওরের ধান ও মাছ রক্ষা করতে হলে নদীতে নাব্য ফিরিয়ে আনতে হবে।


খলিল রহমান গত বছরের বন্যায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে সুনামগঞ্জ শহর। ১৫-২০ বছর আগে একটি প্রকল্পের কথা শুনেছিলাম, সুনামগঞ্জ শহরকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে সুরমার তীর সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এখন সে আলোচনা বন্ধ। এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। না হলে ভাঙনের ফলে আমাদের পেছাতে পেছাতে শান্তিগঞ্জে চলে যেতে হতে পারে।




কাসমীর রেজা আমরা মাঝ নদীতে সড়ক নির্মাণ করে দিচ্ছি। তাহিরপুরের কালাগাঙ, পাটলাই নদীর ওপর সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। নদীকে খণ্ডিত করা হয়েছে ওখানে। মানুষের গলায় ছুরি চালানো যে রকম, নদীতে সড়ক নির্মাণও সে রকমই। নদীকে যদি জীবন্ত সত্তা মনে করা হয়, তাহলে এ কাজ নদীকে হত্যার শামিল বলে মনে করি। এ জন্য পানিশমেন্ট হওয়া উচিত। সিএনআরএস নামের সংস্থা এই কাজ করেছে। কালাগাঙের বাঁধ তারা দিয়েছে। এসব বাঁধ অপসারণ করতে হবে। পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। যত নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে, সব বাঁধ কেটে দিতে হবে। নদী খনন করে নদীতে মাটি ফেলা হচ্ছে। একটি নদীকে তিনটি নদীতে রূপান্তর করা হচ্ছে।



সুপারিশ 

* হাওর এলাকায় আর কোনো নতুন সড়ক তৈরি না করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণার বাস্তবায়ন দরকার।

* প্রকৃতিবান্ধব উন্নয়নে হাওরের লোকায়ত জ্ঞানের সঙ্গে গবেষণালব্ধ জ্ঞানের সমন্বয় করতে হবে।

* ভারত সীমান্তবর্তী হাওর অঞ্চলে অর্থাৎ পাহাড়ের পাদদেশ অঞ্চলে গভীর করে দীর্ঘ খাল খনন করতে হবে, যা কোনো না কোনো নদীর সঙ্গে সংযুক্ত হবে।

* সুরমা, কুশিয়ারার উৎসস্থল বা অমলসিদ থেকে ভৈরব পর্যন্ত নদীকে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় নিতে হবে।

*  হাওরে ২১টি পয়েন্ট দিয়ে পানি প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সেগুলো দূর করতে হবে।

* ইকোসিস্টেম ঠিক রেখে নদী খনন ও হাওরে পানির ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রতিটি নদনদীকে পুনরুজ্জীবিত, সচল ও গভীর করা আবশ্যক।

* হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডকে কার্যকর ভূমিকায় আনা।


প্রধান অতিথি এম এ মান্নান এমপি মন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সভাপতি আবু সাঈদ খান উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল আলোচক পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ্‌ এমপি বিরোধীদলীয় হুইপ, জাতীয় সংসদ সভাপতি-জাতীয় পার্টি, সুনামগঞ্জ শামীমা আক্তার খানম এমপি সংরক্ষিত আসন (সুনামগঞ্জ-মৌলভীবাজার) দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জেলা প্রশাসক, সুনামগঞ্জ মো. এহসান শাহ্‌ পুলিশ সুপার, সুনামগঞ্জ নাদের বখ্‌ত মেয়র, সুনামগঞ্জ পৌরসভা করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল চেয়ারম্যান তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ, সুনামগঞ্জ শাজাহান কবির সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটি স্বপন কুমার দাস রায় বিশিষ্ট আইনজীবী আনিসুল হক জেলা সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জাতীয়তাবাদী কৃষক দল নিগার সুলতানা কেয়া মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সদর উপজেলা পরিষদ, সুনামগঞ্জ অ্যাডভোকেট এনাম আহমদ সভাপতি, সুনামগঞ্জ জেলা সিপিবি আব্দুল অদুদ চেয়ারম্যান, লক্ষ্মণশ্রী ইউনিয়ন পরিষদ মোস্তফা ইকবাল আজাদ কৃষিবিদ সুখেন্দু সেন সহসভাপতি হাওর বাঁচাও আন্দোলন, কেন্দ্রীয় কমিটি মামুন হাওলাদার নির্বাহী প্রকৌশলী, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সুনামগঞ্জ সেলিম আহমদ রাজনীতিবিদ শুভঙ্কর তালুকদার মান্না সভাপতি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি অ্যাডভোকেট শামছুল আবেদীন সাধারণ সম্পাদক, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, সুনামগঞ্জ খলিল রহমান সাধারণ সম্পাদক, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরি, সুনামগঞ্জ কাসমীর রেজা পরিবেশ ও উন্নয়নকর্মী মূল প্রবন্ধ কুমার সৌরভ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন মুকিত রহমানী ব্যুরোপ্রধান, সমকাল, সিলেট ব্যুরো শিক্ষাবিদ পরিমল কান্তি দে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ মুনমুন চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক, মুক্তিসংগ্রাম স্মৃতি ট্রাস্ট মুজিবুর রহমান সদস্য, জেলা পরিষদ, সুনামগঞ্জ জাহানারা বেগম নারী উদ্যোক্তা অ্যাডভোকেট মাহবুবুল হাসান শাহীন সভাপতি, সমকাল সুহৃদ সমাবেশ, সুনামগঞ্জ সাদত মান্নান অভি সমাজকর্মী সঞ্চালনা পঙ্কজ কান্তি দে জেলা প্রতিনিধি, সমকাল, সুনামগঞ্জ