
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ
দৃষ্টি যত দূর যায়, শুধু হাওরের নীল জল। মাঝে মাঝে সবুজের হাতছানি। খণ্ড খণ্ড হিজল-করচের বন জল ভেদ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আপন মহিমায়। একটু বাউরি বাতাস খেলে গেলে, এখানে ঢেউ ওঠে ছলাৎছল, ছলাৎছল। খানিকটা যদি তীরের দেখা পেয়েও যাই, তার কিনার ঘেঁষে অনায়াসে পাওয়া যাবে ডুবন্ত ঘাসের গালিচা। কয়েকটা লম্বা ঘাসের মাথা যদি মুখ তুলে দাঁড়িয়ে থাকে; তবে সেগুলোতে নিশ্চিত মজমা জমবে ফড়িংয়ের। না, কল্পলোকের কোনো স্বর্গরাজ্যের বর্ণনা নয়। প্রতি বর্ষায় আকাশ আর দিগন্ত এখানে পুবাল বাতাসের সঙ্গে দোস্তি পেতে সুন্দরের খেলায় মেতে ওঠে। দিনে সূর্যের আলোয় জল যদি চকচক করে হীরার দ্যুতিতে, রাতের ভরাট পূর্ণিমায় তা রূপ নেয় তরল সোনায়। সে জন্যেই তো স্থানীয় মানুষ আদর করে এ হাওর অংশের নাম দিয়েছেন ‘চন্দ্র সোনার থাল’।
চন্দ্র সোনার থাল নাম শুনে ভ্রমণপ্রিয় অনেকে অবাক হয়ে ভাবতে পারেন, এত জায়গা ঘুরেছি কিন্তু এমন হাওরের নাম তো শুনিনি! সত্যি, সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার ঘুলুয়া রাজাপুরে এ জায়গাটি অনেকের অজানা। তাতে কি, যারা ইতিহাসপ্রিয় তাদের কেউ কেউ ঠিকই খুঁজে বের করেছেন এ স্মৃতিময় স্থান। কারণ এ হাওরের সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে এমন এক ব্যক্তিত্বের স্মৃতি, যিনি আপন মহিমায় নিজেকে করে তুলেছেন আকাশের চেয়ে বড়। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
হাওরের এই অংশকে আঞ্চলিকভাবে অনেকে হাঁসার বিল নামেও ডাকে। নাম যাই হোক সৌন্দর্য আর গুণে সে অনন্য। হাওরের ঢেউ ভেঙে এখানকার সুখাইড় দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের দিকে এগিয়ে গেলে যে কারও নজর কাড়বে চারপাশে জল অথচ উঁচু ভিটার ওপর অবস্থিত এক গম্বুজবিশিষ্ট ছোট্ট একটি মসজিদ। তার ঠিক পেছনে টিনের একচালা ঘর। কৌতূহলী কেউ এগিয়ে গেলেই বুঝতে পারবেন এটি যেনতেন ঘর নয়। এ হলো ইতিহাসের নীরব সাক্ষী ‘মহারাজ মিয়া বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’।
অনেকে হয়তো ভাবছেন– এই মসজিদ ও একচালা ঘরের সঙ্গে কী এমন স্মৃতি জড়িয়ে থাকতে পারে বঙ্গবন্ধুর! আসলে এই ঘর হলো ধর্মপাশা হাওরাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সাবেক চেয়ারম্যান মনসব রাজা চৌধুরী ওরফে মহারাজ মিয়ার বাড়ি। আওয়ামী লীগ নেতা মহারাজ মিয়া ছিলেন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ধর্মপাশা রাজাপুর থেকে নির্বাচিত লোকাল বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে অন্যতম। নির্বাচনী কাজে ১৯৭০ সালের ৯ অক্টোবর ধানকুনিয়া হাওর পাড়ি দিয়ে সুখাইড় দক্ষিণ রাজাপুর
গ্রামে প্রচারের জন্য তাঁর বাড়িতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সাড়ে তিন ঘণ্টা ওই টিনের চালার বাড়িতে অবস্থান করেন। তিনি মধ্যাহ্নভোজের পর আলাপ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর সঙ্গে। সবার সঙ্গে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ওই বাড়িতে ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সে সময়কার সভাপতি এম এ সামাদ।
সুনামগঞ্জে মোট আটবারের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সেটি ছিল চতুর্থ সফর। এসব সফরে দুর্গম অঞ্চল ঘুরে বঙ্গবন্ধু গঠন করেছিলেন মহকুমা আওয়ামী লীগ ইউনিট। দিরাই, আজমিরীগঞ্জ, শাল্লা, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জসহ ভাটি অঞ্চলে লোকমুখে বঙ্গবন্ধুর সেসব উঠানসভা, জনসভার কথা আজও চালু আছে। বঙ্গবন্ধুর সুখাইড় দক্ষিণ রাজাপুর সফরের কথা উল্লেখ আছে কল্লোল তালুকদারের লেখা ‘সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন রাজনীতি’ বইতে।
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত সেসব স্থান কেউ সংরক্ষণ না করলেও ব্যতিক্রম মহারাজ মিয়ার বাড়িটি। আজও সেই একচালা ঘর ও মসজিদ একইরকম রেখেছেন মহারাজা চৌধুরীর ছেলে সুখাইড় রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও ধর্মপাশা যুবলীগের সহসভাপতি আমানুর রাজা চৌধুরী। নিজ অর্থায়নে ছোট পরিসরেই ওই ঘরে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘মহারাজা মিয়া বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’। তাই চন্দ্র সোনার থাল হাওরে কেউ ভ্রমণে এলে, একবার হলেও ঢুঁ মেরে যান এখানে।
আমানুর রাজা চৌধুরী জানান, স্বাধীনতার কিছু বছর পর এক বর্ষায় ঢেউয়ের আঘাতে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মসজিদ রক্ষায় তিনি বাড়ির চারপাশে ছোট দেয়াল তুলেছেন। এছাড়া একই রকম রেখে দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক করা সেই একচালা ঘরটি। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি ও রাজনীতিক এ জাদুঘর পরিদর্শন করেছেন। তিনি চান সরকার উদ্যোগ নিয়ে এখানে যেন একটি বড় জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে।
মন্তব্য করুন