- বিশেষ আয়োজন
- বাঙালি সত্তার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু
বাঙালি সত্তার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু

শিল্পী: আহমেদ শামসুদ্দোহা
একটা জাতির জীবনেও এমন সময় আসে– হয়তো বা অল্প সময়ের জন্যই– যখন একটি জাতির কাঙ্ক্ষিত সত্তা কোনো এক মানুষের কণ্ঠে কথা বলে ওঠে
যে কোনো বাংলাভাষী মানুষের কাছে এটি একটি গর্বের জিনিস যে, পৃথিবীতে এমন একটি দেশ আছে, যেখানে শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষ বাংলাকে তাদের মাতৃভাষা ও আত্মপ্রকাশের ভাষা বলে ভালোবাসেন এবং সম্মান করেন। এই দেশ আছে বলে রাষ্ট্রসংঘের ইতিহাসে একদিন এক জননায়ক বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেন। এবং শুধু সেখানেই নয়, ১৯৫২ সালে চীনে অনুষ্ঠিত ‘এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে’ও তিনি প্রথম মানুষ, যিনি বাংলায় বক্তৃতা করেন।১ এই দেশ আছে বলেই বাংলা ভাষা আজ সারা পৃথিবীতে যে স্বীকৃতি পায়, তা অন্যথায় কোনোদিন পেত না।
একটা জাতির জীবনেও এমন সময় আসে– হয়তো বা অল্প সময়ের জন্যই– যখন একটি জাতির কাঙ্ক্ষিত সত্তা কোনো এক মানুষের কণ্ঠে কথা বলে ওঠে। যাদের কণ্ঠে এভাবে কোনো জাতির ইচ্ছা ধ্বনিত হয়ে ওঠে তারা মহাপ্রাণ, বিরল মানুষ। কোনো এক সময়ে গান্ধীজি ছিলেন এই রকম মানুষ, নেলসন ম্যান্ডেলাও তাই, আর আমাদের জীবৎকালে দেখলাম বঙ্গবন্ধুকে। যেসব ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমরা বাঙালি হিসেবে ন্যায্যত আত্মসম্মান অনুভব করি, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে এ রকম একটি মুহূর্ত ছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। পূর্বের রেসকোর্স (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী) ময়দানে প্রদত্ত ৭ মার্চের তাঁর সেই বিখ্যাত ও তাৎপর্যময় বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু যখন বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তখন যে সমস্ত মুক্তিকামী বাংলাদেশি মানুষ তাঁর কণ্ঠে কথা বলে উঠেছিল এ কথা কে অস্বীকার করবে? স্মরণে রাখতে হয় যে কীভাবে এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান পরিচিতির ঊর্ধ্বে এক সামগ্রিক জাতিসত্তার কথা বলেছিলেন, ‘কিন্তু, হুঁশিয়ার, আমাদের মধ্যে শত্রু ঢুকেছে। ছদ্মবেশে তারা আত্মকলহের সৃষ্টি করতে চায়। বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।’২
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তরুণ গবেষক নাজমুল সুলতান এই বক্তৃতাটিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ‘ground zero’ বলে বর্ণনা করেছেন।৩ বক্তৃতাটির পর দিন ‘দৈনিক পাকিস্তান’ লিখেছিল: ‘মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়ছে জনসমুদ্রের উত্তাল কণ্ঠ। স্লোগানের ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়ছে। লক্ষ কণ্ঠে এক আওয়াজ। হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে পূর্ব বাংলার মানচিত্র অঙ্কিত সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের পতাকা।’৩ পরবর্তীকালে কথাসাহিত্যিক শাহদুজ্জামান তাঁর ক্রাচের কর্নেল গ্রন্থে ভাষণটির সেই ম্যাজিক মুহূর্তটি ধরে রেখেছেন এভাবে : ‘মাত্র ১৯ মিনিটের একটি ভাষণ দেন শেখ মুজিব। তাঁর সুবিদিত কণ্ঠনৈপুণ্যে আর উপস্থাপনায় এই ঐতিহাসিক ভাষণ হয়ে যায় এ দেশের মানুষের যৌথ স্মৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ... লক্ষ লক্ষ মানুষ তখন তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে তাক করা একটি তর্জনীর দিকে। শেখ মুজিবের তর্জনী। ঐ তর্জনীই তখন সংবিধান। ঐ তর্জনী যা করতে বলবে তাই করবে মানুষ।’৪ এই বক্তৃতা মানুষকে উদ্দীপিত করার ক্ষমতা আজ পঞ্চাশ বছর বাদেও হ্রাস পায়নি। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রারম্ভেই যেমন আছে জওহরলাল েহরুর বিখ্যাত ‘tryst with destiny’ ভাষণটি, বাংলাদেশের বাঙালির মুক্তির সাধনার শুরুও এই ভাষণে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ভাষণের কাছে ফিরে আসবে বাঙালির ঐ কাঙ্ক্ষিত সত্তার সন্ধানে। যেমন ধরুন ২০ নভেম্বর ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে দেখছি ড. কাজী এরতেজা হাসান এই ভাষণের প্রসঙ্গে লিখেছেন, “[বঙ্গবন্ধু] নতুন প্রজন্মকে শিখিয়েছেন কীভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়, অন্যের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হয়। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবিকতা আর অসাম্প্রদায়িকতার এক মহাকাব্যিক রচনা এই ঐতিহাসিক ভাষণ। এই ভাষণের গল্প শুনেছি প্রথমে বাবা-মায়ের কাছে, তারপর শুনেছি স্কুলে পড়ার সময় ক্যাসেটে। ভাষণটি উজ্জীবিত করে, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়।”৫ এবং এই স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুধু বাঙালিকে দেখায় না, সর্বকালের সকল স্বাধীনতাকামী মানুষকেই উদ্বুদ্ধ করে। তাই অবাক হই না শুনে যে এই ভাষণ ‘আজ ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’।৬
বঙ্গবন্ধুর চিন্তার ইতিহাসে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ও সংখ্যাগুরুত্ববাদবিরোধী যেসব মূল্যবোধ দেখা যায়, তার দুটি লক্ষণ একাত্তরের সংগ্রামের মূলধারার প্রতীকী ইতিহাসের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিকে খুব স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এবং এই দুটি লক্ষণই, আমি বলব, সংখ্যাগুরুবাদের দোষ থেকে মুক্ত। বরং দুটি লক্ষণই এক বৃহত্তর সত্তার সন্ধানমুখী কোনো মানসিকতার কথা বলে।
প্রথম লক্ষণটি দেখা যাবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের ইতিহাস স্মরণ করলে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ৭ আগস্ট ১৯০৫ সালে কলকাতার টাউন হলে গানটি গীত হয়েছিল। সেই আন্দোলনে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। আবার গানটির সঙ্গে গগন হরকরার সূত্রে– সেই গগন হরকরা যাঁর গান ‘আমি কোথায় পাবো তারে’র সুরে গানটি রচিত হয়েছিল– কুষ্টিয়া অঞ্চলের সঙ্গেও একটা যোগাযোগ ছিল।৭ এই বিষয়ে শ্রদ্ধেয়া সন্জীদা খাতুনের স্মৃতিকথা প্রণিধানযোগ্য:
১৯৫৭ সালের প্রথমার্ধে ঢাকাতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতাসুদ্ধু প্রাদেশিক নেতাদের এক বৈঠক হয়েছিল।... সেই সন্ধ্যায় শেখ মুজিবর রহমান আমাকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে অনুরোধ করেন। এর তাৎপর্য তখন বুঝিনি, এখন বুঝতে পারি। ...আঞ্চলিক স্বাধীনতার জন্য উত্তাল আন্দোলনের সময়ে বঙ্গবন্ধু সব সময়ে জাহিদুর রহিমকে এই গান গাইবার জন্য খবর পাঠাতেন। রেসকোর্সের ময়দানে তাঁর সভাতে জাহিদ যে কতবার ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়েছে! ...দেশের সর্বজনের অন্তর থেকে উৎসারিত এই গান তাই হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।৮
বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিসংগ্রামে এই গানটির গ্রহণযোগ্যতার ইতিহাস ভাবলে মনে হয় এই সংগ্রাম শুধু যে ধর্মগন্ধি সাম্প্রদায়িকতার বিরোধাচারী তাই নয়, সে যেন পূর্বের ব্রিটিশবিরোধী হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে কথোপকথনরত!
আমার দ্বিতীয় বক্তব্য হলো এই যে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সংখ্যাগুরুর দৈনন্দিন অবস্থান থেকে সরে গিয়ে এক বৃহত্তর বাঙালির জাতির কল্পনার সবচেয়ে বড় নিদর্শন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।৯ জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয় ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি, কিন্তু এর উদ্ভব আরও আগে। পতাকাটির সাংকেতিক দিকটি ভাবুন। বাংলাদেশে মুসলমান সম্প্রদায় সংখ্যাগুরু, কিন্তু রাষ্ট্রীয় এই প্রতীকে মুসলমানিত্ব কিছু নাই। গাড় সবুজ রং বাংলাদেশ সুজলা, সুফলা জমির প্রতীক, আর মাঝের বৃত্ত সূর্যের ও তার লাল রং শহীদের যে খুন ঝরিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই খুনের। অভ্যাসগত সংখ্যাগুরুবাদ মানুষের স্বাভাবিক ব্যাবহার, যাকে বলে ডিফল্ট অপশন। কিন্তু ম্যাপে সেটা নাই। বিশ্বের ইতিহাসে এইটা এক কম আশ্চর্য ব্যাপার না।
বাংলাভাষী এক জনগোষ্ঠীর জীবনে এই যে বাংলাদেশ হওয়ার মতো একটা অবস্থা ইতিহাস করে দিয়েছে, সেটা সমস্ত বাঙালির সৌভাগ্য। কিন্তু বাংলাদেশের পতাকায় কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর কথা কিছু নেই। উর্বরা দেশ, সূর্য, আর শহীদের রক্তের উল্লেখ আছে। এই পতাকার মধ্যে যেন একটা আমন্ত্রণ আছে যে, সত্য, এই দেশের বেশির ভাগ মানুষ বাংলাভাষী, কিন্তু বাংলা যার মাতৃভাষা না, অথচ যিনি বাংলাদেশের নাগরিক, তিনিও তো বাংলাদেশি। যতদূর জানি, এখন বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকেও এই সত্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের পতাকায় এই আমন্ত্রণ– এই যে বাংলাদেশি বলতে শুধু যে বাংলাভাষী বোঝায় না, তার চেয়ে বড় কিছু বোঝায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঝরানো শহীদের রক্তে যে অন্যান্য জনগোষ্ঠীরও অবদান আছে– এ যেন রাষ্ট্রীয় প্রতীকে বাঙালির এক প্রসারণশীল সত্তার কাছেই আবেদন রাখে।
সেই জন্য এই পতাকাটিকে আমার আশ্চর্যভাবে উদার ও দরাজ লাগে। আমাদের অভ্যাসগত আরামের যে সংখ্যাগুরুবাদ, বাংলাদেশের পতাকা যেন তার ঊর্ধ্বে থেকে বাঙালির কাঙ্ক্ষিত সত্তার আরও কোনো বৃহত্তর দিগন্তের প্রতি আমাদের নিরন্তর আহ্বান করে চলেছে।
দীপেশ চক্রবর্তী : ইতিহাসবিদ, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের লরেন্স এ কিম্পটন ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস প্রফেসর
সূত্র
১. আখতার হুসেন সম্পাঃ জনকের মুখঃ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ছোটগল্প (ঢাকাঃ কথাপ্রকাশ, ২০১৫, পৃ ১১
২. মযহারুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (ঢাকাঃ বাংলা একাডেমী, ১৯৭৪), পৃ ৭৪৫
৩. Nazmul S. Sultan, “Independence, Freedom, Liberation: The Promise of Bangladesh’s Founding,” Economic and Political Weekly, Special issue on 50 years of the liberation of Bangladesh, vol. LVI, No. 44, October 30, 2021, p..43। এই প্রসঙ্গে আরও দ্রষ্টব্য ঐ সংখ্যায় প্রকাশিত নুসরাত সাবিনা চৌধুরী ও টমাস নিউবোল্ডের প্রবন্ধ।
৪. মযহারুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, পৃ ৭৪০-এ উদ্ধৃত।
৫. শাহদুজ্জামান, ক্রাচের কর্নেল (ঢাকাঃ মাওলা ব্রাদারস, ২০১৮; ২০০৯), পৃ ৮০
৬. https://www.kalerkantho.com/online/miscellaneous/2020/03/07/882932
৭. কামাল চৌধুরী, বাঙালির বঙ্গবন্ধু (ঢাকাঃ জার্নিম্যান বুকস, ২০১৮), পৃঃ ২৭
দ্রঃ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, গীতবিতানঃ কালানুক্রমিক সূচী (কলকাতাঃ টেগোর রিসার্চ ইন্সিটিউট, বাংলা সং ১৩৯৯), পৃঃ ১৫৪
৮. সন্জীদা খাতুন, প্রবন্ধ-সংগ্রহ, সম্পাঃ আবুল হাসনাত (ঢাকাঃ নবযুগ প্রকাশনী, ২০১০), পৃ ২২৭-২২৮
৯. এই চিন্তায় আমার ছাত্র তৈমুর রেজার সঙ্গে আলোচনার কাছে
আমি ঋণী।
মন্তব্য করুন