ঢাকা বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

বঙ্গবন্ধু ও অন্নদাশঙ্কর

বঙ্গবন্ধু ও অন্নদাশঙ্কর

ছবি: নাসির আল মামুন

দাউদ হায়দার

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর পেয়ে অন্নদাশঙ্করের শিশুর মতো কান্না। দিনমান খাননি। সন্ধ্যায় চেষ্টা করলুম খাওয়াতে। পরদিন লিখলেন ‘কাঁদো, প্রিয় দেশ’

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখছেন : “এই দেশ আমার প্রিয় দেশ। এই দেশের মানুষ আমার প্রিয় মানুষ। এই দেশে ও এদের সঙ্গে আমার অর্ধেক যৌবন অতিবাহিত হয়েছে। এই দেশে আমার তিনটি সন্তানের জন্মভূমি। জন্মভূমিকে বলা হয়েছে স্বর্গের চেয়েও গরীয়সী। আমি এই দেশের প্রতি এক প্রকার নাড়ির টান অনুভব করি। এই দেশের মানুষের সঙ্গে আমার আত্মীয়তার ডোর পঞ্চাশ বছরেও ছিন্ন হয়নি। একাত্তর সালের মাঝামাঝি একদিন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এসে বললেন, ‘খবর পাওয়া যাচ্ছে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে জেলখানায় হত্যা করবে। আমরা গড়ের মাঠে প্রতিবাদ সভা ডেকেছি। আপনাকেও যেতে হবে।’
নির্দিষ্ট দিনে গড়ের মাঠের গিয়ে দেখি লোকের ভিড়ে প্রবেশপথ বন্ধ। বাড়ি ফিরে আসি। অগত্যা আমার বক্তব্যকে আমি কবিতায় রূপ দিই।
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ রক্তগঙ্গা
অশ্রুগঙ্গা বহমান
তবু নাহি ভয় হবে হবে জয়
জয় মুজিবুর রহমান
...বাংলাদেশ শব্দটিতে একটা জাদুশক্তি ছিল। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিটিও ছিল একটা মন্ত্রশক্তি। জাদুশক্তি ও মন্ত্রশক্তি না থাকলে নিছক শাস্ত্রশক্তি জন্ম হতে পারতো না।’’ (মৈত্রেয়ী দেবী সম্পাদিত ‘নবজাতক’ সাহিত্যপত্রে সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় প্রকাশিত।)
অন্নদাশঙ্কর রায় কেন লিখেছেন বাংলাদেশের প্রতি নাড়ির টান?
হওয়ার কথা নয়। হয়েছে চাকরিসূত্রে।
জন্ম ১৫ মার্চ ১৯০৪ সনে, ওড়িশার দেশীয় রাজ্য ঢেঙ্কানালে। ওড়িশাবাসীরা বলে : ‘ওডিযাবাঙালি।’ এই বাঙালির সাহিত্য শুরু ওড়িয়া ভাষাতেই। কবিতা দিয়ে শুরু (‘সবুজগোষ্ঠী’ নামে একটি দল ছিল। ওড়িয়া আধুনিক সাহিত্যের প্রবর্তক। দলে পাঁচজন খ্যাতিমান। অন্নদাশঙ্কর অন্যতম)।
ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে (আইসিএস) প্রথম হয়ে বিলেতে দুই বছর ট্রেনিং। ফিরে মুর্শিদাবাদে পোস্টিং।
আমাদের জানা আছে, অন্নদাশঙ্কর রায়ের চাকরি জীবনের বেশিরভাগ সময়ই পূর্ব বঙ্গে কাটিয়েছেন। শুরু নওগাঁ থেকে। (এখানে অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী লীলা রায়ের বাংলা শিক্ষার শিক্ষক ছিলেন ‘হারামণি’ খ্যাত অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন)।
নওগাঁ থেকে রাজশাহীর সদরে। কুষ্টিয়া, ঢাকা, চট্টগ্রাম (চট্টগ্রামের কৈবর্ত্যধামে তাঁর দ্বিতীয়পুত্র চিত্রকাম-এর অকাল মৃত্যুতে একটি সমাধি আছে। চট্টগ্রামে শাসনকার্যে থাকাকালীন সাহিত্যিক অধ্যাপক আবুল ফজলের সঙ্গে আরও বেশি বন্ধুতা। অন্নদাশঙ্কর রায়ের অনুরোধেই আবুল ফজল চট্টগ্রামীণ ভাষায় একটি গল্প লেখেন।
চট্টগ্রামেই সাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরীর পিতা আশুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে অন্নদাশঙ্করের ঘনিষ্ঠতা। ভারতভাগের ঠিক আগে শেষ পোস্টিং ময়মনসিংহে। লেখেন বহুল পঠিত : খুখু ও খোকা।
 তেলের শিশি ভাঙলো বলে
খুকুর ’পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো
তার বেলা?
কবিতার সূত্রপাত এই, ছোট কন্যা খুকু [তৃপ্তি রায়], বয়স আড়াই, বারান্দায় খেলছিলেন। অন্নদাশঙ্কর তেল মেখে স্নান করেন। সকালে। বারান্দায় ছিল তেলের শিশি। মা লীলা রায় বলেন, বাবাকে তেলের শিশি এগিয়ে দিতে। দেবার সময় হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায়। মায়ের রাগারাগি। অন্নদাশঙ্কর তেলহীন স্নান সেরে গাড়িতে অফিসে যাওয়ার সময় প্রথম স্তবক খসড়া করেন। পরে বিস্তারিত। বাড়ি ফিরে।
কবিতা প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায়। এই কবিতা পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই (অন্নদাশঙ্কর সঠিক তারিখ বলতে পারেননি) কবিসাহিত্যিক শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে সংগঠন করেন। সহায়ক সংগঠন, সঙ্গে কবিসাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র, সাহিত্যিক মনোজ বসু প্রমুখ। উদ্দেশ্য জনমত গঠন। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু ছাড়াও উদ্বাস্তু কবিশিল্পীসাহিত্যিকদের আশ্রয় এবং সাহায্য। রবীন্দ্রসংগীত গায়ক দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র আরও অনেকে সঙ্গী।
তাজউদ্দীন আহমদ একদিন সকালে অন্নদাশঙ্কর রায়ের যোধপুর পার্কের বাড়িতে হাজির। বলেন, ‘আর্থিক সাহায্য দরকার।’ পরের সপ্তাহে অন্নদাশঙ্কররা পথে নেমে মিছিল, অর্থের আবেদনও। মোটা অংক (কত, বলেননি) যা পেয়েছিলেন (সোনার অলংকারও) সবই দান তাজউদ্দীনকে।
অন্নদাশঙ্কর জানান : ‘মিছিলে বঙ্গবন্ধুর ছবি অনেকের বুকে ছিল। আমারও। আমার বিশ্বাস ছিল আমাদের সংগ্রাম বৃথা যাবে না। যায় নি। বঙ্গবন্ধু আমার ভেতরে আত্মিকতায় আপন।’
বঙ্গবন্ধুর সাদর আমন্ত্রণেই ভারতীয় কবিশিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীর দল নিয়ে অন্নদাশঙ্কর বাংলাদেশে গিয়েছেন। দু’বার। তিনিই দলনেতা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ, নানা বিষয়ে আলোচনা। বঙ্গবন্ধু বলেন : ‘আপনার কবিতা আবু সাঈদ চৌধুরীর (বাংলাদেশে প্রথম প্রেসিডেন্ট) মুখস্থ।’ (শেখ হাসিনার আমলেও গিয়েছেন। শেখ রেহানা এসে একবার দেখা করেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর পেয়ে অন্নদাশঙ্করের শিশুর মতো কান্না। দিনমান খান নি। সন্ধ্যায় চেষ্টা করলুম খাওয়াতে। পরদিন লিখলেন ‘কাঁদো, প্রিয় দেশ।’ পৌঁছে দিলুম ‘দেশ’-এ। ছাপা হলো না। লেখা পাঠানো হলো ইন্দিরা গান্ধীকে। তিন বিনয়সহ লিখলেন (ভারতে তখন এমারজেন্সি) কেন ছাপা যাবে না। সঙ্গত নয় লেখা প্রকাশিত। পরে)।’ অন্যায্য যুক্তি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যত লেখা লিখেছেন (কবিতা/প্রবন্ধ) অন্নদাশঙ্কর, বাংলাদেশের আর কেউ নয় (তখন)। লেখকবন্ধু মফিদুল হক সাহিত্য প্রকাশ থেকে অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘আমার ভালোবাসার দেশ’ প্রকাশিত করেছেন। পাঠক পাবেন তাঁর ভালোবাসার বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু। মহত্ত্বের মহত্ত্ব।

দাউদ হায়দার: কবি

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×