- বিশেষ আয়োজন
- রাজনৈতিক ট্র্যাজেডির নতুন অঙ্ক
রাজনৈতিক ট্র্যাজেডির নতুন অঙ্ক

১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান
নাটকের নতুন অঙ্কটি যে এমনভাবে শুরু হবে, তা সম্ভবত কেউ ভাবতে পারে নি। পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন, এ খবর বেশ কয়েকদিন ধরেই প্রচার করা হচ্ছিল। সে- সময়েও টেলিভিশনের ব্যাপক প্রচলন ঘটেনি। রেডিও খুলেই কয়েক ঘন্টা পর পর আমরা খবর শুনি। সেদিনও সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠেই আমি রেডিওর নব ঘুরাচ্ছিলাম। হঠাৎ কর্কশ কণ্ঠস্বর কানে এল। সেই কর্কশ কন্ঠের লোকটির নাম নামও শুনলাম। মেজর ডালিম। সেই ডালিম বাবার জানিয়ে দিচ্ছে, রক্ত হিম করা সেই খবর, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’
খবরটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে বোধ হয় কণ্ঠ থেকে একটি আর্ত চিৎকার রেরিয়ে এসেছিল। বাড়ির সকলেই ‘কি হয়েছে, কী হয়েছে’ বলে আমার পাশে এসে জড়ো হলো। আমার পাশের ঘরের বাসিন্দা (এবং আমার শুভাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়) তারিণীপ্রসন্ন দে বললেন, ‘তুমি এখনই বাসা ছেড়ে চলে যাও।... মনে হচ্ছে খুব শিগগিরই ধর-পাকড় শুরু হয়ে যাবে। বাসায় থাকা তোমার জন্য মোটেই নিরাপদ নয়।’
আমার পরিবারের সকল সদস্যেরই একই কথা। সবাই আমাকে ঠেলে-ঠুলে প্রায় তখনই বাইরে পাঠিয়ে দিল। আমাদের পাড়াতেই আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু কবি আশুতোষ পালের বাসায় গিয়ে উঠলাম। আশুবাবু নিতান্তই ‘অরাজনৈতিক’ মানুষ। তাই তাঁর বাসায় থাকা হয়তো অনেকটাই নিরাপদ।
আশুবাবুর বাসার একটি নির্জন কামরায় একমাত্র সাথী আমার এক ব্যান্ডের ট্রানজিস্টরটি। আশুবাবু একটু পরপর বাইরে যান, আর ফিরে এসে আমাকে শহরের খবরাখবর জানান। যদিও রেডিওর খবরে শোনা যাচ্ছে যে সারাদেশে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে, তবু ময়মনসিংহ শহরে রাস্তায় লোকজনের আনাগোনা বন্ধ হয় নি, প্রায় সব দোকানপাঠই খোলা। রাস্তায় পুলিশ বা মিলিটারিরও আনাগোনা নেই।
সকাল আটটার মধ্যেই জানা গেল যে সামরিক বাহিনী দেশের সর্বময় ক্ষমতা দখল করেছে, তবে নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিটি সামরিক বাহিনীর কেউ নন। তাঁর নাম খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। আগের দিন পর্যন্ত তাঁকে আমরা জানতাম বাংলাদেশ সরকারের ‘বাণিজ্য ও বৈদেশিক মন্ত্রী’ বলে। আজ সকালেই শুনি সেই ‘খোন্দকার’ই বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। আশুবাবু আমার কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে বললেন, ‘খোন্দকার নয়, খুনকার।’
আশুবাবুর সাথে আমিও একমত হই। আমি বলি ‘পরে হয়তো বঙ্গবন্ধু হত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ সব খবরই জানা যাবে, তবে এই মুহূর্তে আমরা ধরে নিতে পারি যে, মোশতাকই আসল খুনি।’
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার অনেক পরে সে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অনেক কথাই জানা গেছে, এ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে, স্বঘোষিত খুনিদের জবানবন্দিও আমরা পেয়েছি। তবু তাৎক্ষণিকভাবে সেদিন যে আমরা খোন্দকার মোশতাককেই ‘আসল খুনি’ বলে ধারণা করে নিয়েছিলাম, সে-ধারণা যে মোটেই ভুল ছিল না, সে কথা তো নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে।
‘যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ই স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে ব্যর্থ হয়েছিলেন’ কেবল তাঁরাই যদি বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরে ‘মন্ত্রিসভা ও রাষ্ট্রপতির আসনে বসে’ থাকতেন, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট অনুসারী বলে যাঁরা পরিচিত তাঁদের কাউকে যদি খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় দেখা না যেতো, তাহলে দেশের জনগণের কাছে অবশ্যই একটি ভিন্নবার্তা পৌঁছাত, এবং সেই বার্তায় জনগণ যে-রকম সাড়া দিত তাতে বাংলাদেশের ইতিহাস নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে যেতো। কিন্তু তেমনটি হলো না, হতে পারলো না। পনেরোই আগস্টের সকালে বেতারে ডালিমের ঘোষণা শুনে আকষ্মিকতার ধাক্কায় সারা দেশের মানুষ ঘুরে এসে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরটি প্রায় কেউই বিশ্বাস করছে না। অনেকেরই ধারণা, কোনো একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী বাংলাদেশের বেতারকেন্দ্রটি দখল করে নিয়েছে মাত্র, বেতার থেকে যা বলা হচ্ছে তা একেবারেই অবিশ্বাস্য।’
‘সবাই নিশ্চয়ই এ-রকম ভাবছে না’, আমি বলি।
আশুবাবু বললেন, ‘না, সবাই এ-রকম ভাবছে না বটে। তবে একটা ক্যু হয়ে গেছে বলে যারা বিশ্বাস করছে, তারাও মনে করে বিষয়টি একেবারে আন-চ্যালেঞ্জড্ যাবে না। বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা কি বসে থাকবে ? রক্ষীবাহিনী আছে না ? ... নতুন বাজারে দোকানে বসে কয়েকজনকে তো-এ রকমও বলাবলি করতে শুনলাম যে বেদখল হয়ে যাওয়া রেডিও স্টেশনটি শিগ্গিরই রক্ষীবাহিনীর হাতে এসে যাবে। তখনই সব বিষয় পরিস্কার জানা যাবে।’
সন্ধ্যার আগেই সব ‘পরিস্কার’ হয়ে গেল। কারো মনেই বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকলো না। বিশেষ করে রেডিওতে যখন মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানের বিবরণে সকল মন্ত্রীরই কণ্ঠস্বর শোনা গেল, তখন দেশের সকল মানুষের মধ্যেই অন্যরকম ভাবনার সঞ্চার ঘটলো।
সেই রাতে যদিও আমি নিজের বাসায় ফিরে না গিয়ে আশুবাবুর বাসাতেই ছিলাম। তবু সকালের মতো নিজেকে আর গোপন করে রাখি নি। সান্ধ্য আড্ডায় অনেকের সঙ্গেই কথাবার্তা হলো। সকাল বেলায় তাঁরা এ ধরনের আকষ্মিকতার ধাক্কা খেয়েছিলেন, সন্ধ্যায় খেলেন অন্যধরনের ধাক্কা। সকালে যাঁরা আশা করেছিলেন যে বঙ্গবন্ধুর সকল অনুসারী ও রক্ষীবাহিনীর উদ্যোগে দেশজুড়ে প্রচণ্ড প্রতিবাদ প্রতিরোধের সৃষ্টি হবে, সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্যদেরই মোশতাকের মন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণের রেকর্ডকৃত অনুষ্ঠান শুনে তাঁরা পুরোপুরি আশাহত হয়ে গেলেন। শুধু আশাহত নয়, ক্ষুব্ধও। কী করে এমনটি হতে পারলো?
ক্যু’দেতাকে সমর্থন জানিয়ে প্রদত্ত ভাষণে মোশতাক বললেন, ‘সকলেই এই শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন চাইছিল। কিন্তু প্রচলিত নিয়েমে পরিবর্তন সম্ভব ছিল না বলেই সরকার পরিবর্তনে সেনাবাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়। ঐতিহাসিক প্রয়োজনে সেনাবাহিনী জনগণের জন্য সুযোগের স্বর্ণদ্বার খুলে দিয়েছে।’
সেই সন্ধ্যায় আমরা যারা কবি আশুতোষ পালের বাসায় আড্ডায় বসে এই মোশতাক-বচনামৃত শ্রবণ করছিলাম বুঝে নিয়েছিলাম যে ‘জনগণের জন্য নয়’, ‘সুযোগের স্বর্ণদ্বার খুলে’ গিয়েছে মোশতাকের মতো পাকিস্তান-প্রেমিকদের জন্য। বুঝে ফেলেছিলাম যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নাটকের এই নতুন অঙ্কে নিহত পাকিস্তানের ভূতই মঞ্চ দখল করে রাখবে। পনেরোই আগস্টের রাতেই বিবিসি থেকে শোনা গেল যে বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ বলে ঘোষণা করা হতে পারে। সে-রাতেই নতুন বাংলাদেশ সরকারকে পাকিস্তান স্বীকৃতিদানের জন্য ‘ইসলামিক কনফারেন্স’ ও তৃতীয় বিশ্বের চল্লিশটি জাতিকে অনুরোধ জানান। যে সৌদি আরব স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাড়ে তিন বছরেও স্বীকৃতি জানায় নি, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরদিনই সেই সৌদি আরবের সানন্দ স্বীকৃতি এসে যায়।
পনেরোই আগস্টে জুম্মার নামাজের আগেই মোশতাক প্রেসিডেন্ট রূপে শপথ গ্রহণ করেন, এবং জুম্মার নামাজের জন্য দুপুরে তিন ঘন্টার জন্য কারফিউ উঠিয়ে নেন। উদ্দেশ্য : দেশে ও বিদেশে নিজের একটা ধার্মিক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা, দেশের পাকিন্তানপন্থীদের কাছে এবং বিদেশে পাকিন্তান ও পাকিন্তান-সমর্থক রাষ্ট্রগুলোর কাছে নতুন এক ‘ধর্মতন্ত্রী’ রাষ্ট্রের বার্তা পৌঁছিয়ে দেয়া। এই বার্তা প্রেরণের মধ্য দিয়ে সেদিন থেকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই বাংলাদেশের খোলশের ভেতর পাকিস্তানের শাঁস পুরে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।
যতীন সরকার: লেখক, গবেষক, অধ্যাপক
মন্তব্য করুন