ঢাকা বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

যেমন আছে শারদীয় দুর্গোৎসবের উৎপত্তিস্থল

যেমন আছে শারদীয় দুর্গোৎসবের উৎপত্তিস্থল

ফাইল ছবি

সৌরভ হাবিব

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:০২ | আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৪ | ২০:৩৩

আদিতে দেবী দুর্গার পূজা হতো বসন্তকালে, যা ‘বাসন্তী পূজা’ নামেও পরিচিত। এখন প্রায় সব স্থানেই পূজা হয় শরৎকালে, যাকে বলে শারদীয় দুর্গাপূজা। হিন্দুশাস্ত্র মতে, রাবণ বসন্তকালে চৈত্র মাসে দেবী পার্বতীকে (দুর্গার আরেক নাম) পূজা করে সন্তুষ্ট করলে দেবী তাঁকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন; কিন্তু যদি সে দেবীর পূজামন্ত্রে শ্রীশ্রী চণ্ডীতে কোনোরূপ ত্রুটি করে, তবে দেবী তাঁকে ত্যাগ করবেন। এই কারণে রামচন্দ্রের সব অস্ত্র রাবণের ওপর বিফল হয়ে যায়। তখন ব্রহ্মা রামচন্দ্রকে শরৎকালে দেবী পার্বতীর পূজা করতে বলেন। কারণ দেবী এই সময় মর্ত্যে তাঁর পিতৃগৃহে আসেন। রাম আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন কল্পারম্ভ করেছিলেন। সন্ধ্যায় বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস করেন। মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও সন্ধিপূজার পরেও দুর্গার আবির্ভাব না ঘটায় রাম মোট ১০৮টি নীল পদ্ম দিয়ে মহানবমী পূজার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু না পাওয়ায় নিজের চোখ দেবীর পায়ে নিবেদন করতে চান। তখনই দেবী দুর্গা তুষ্ট হয়ে আশীর্বাদ করেন। তারপরই রাম দশাননকে বধ করেন। কিন্তু অনেকে আবার মনে করেন, এই সময়ই দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। তাই এই সময়ই দুর্গাপূজা করা হয়।
তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ রায় কীর্তিবাসের কাছ থেকে রামের শারদীয় পূজার বর্ণনা শুনে আশ্বিন মাসে অকালবোধনের মাধ্যমে দুর্গাপূজা করার সিদ্ধান্ত নেন। বাংলা ৮৮৭ সালে (১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দ) রাজশাহীর তাহেরপুরে প্রথম দুর্গাপূজা চালু করেন তিনি। সেই থেকে শরৎকালের দুর্গাপূজা তাহেরপুর থেকে ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতবর্ষে। 
ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা কংস নারায়ণ রায় উত্তরাধিকারসূত্রে তাহেরপুর রাজ্যের রাজা হন। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ভারতের মুর্শিদাবাদ নিয়ে গঠন করা হয়েছিল তাহেরপুর রাজ্য। রাজা কংস নারায়ণ বিখ্যাত হওয়ার জন্য অশ্বমেধযজ্ঞ করতে চান। অর্থাৎ তিনি ঘোড়া ছেড়ে দেবেন। ঘোড়া যে পর্যন্ত যাবে, ততদূর হবে তাঁর রাজ্য। কিন্তু রাজপণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী তাঁকে পরামর্শ দেন যে, কলিকালে অশ্বমেধযজ্ঞ সম্ভব নয়। এতে যুদ্ধ বেধে যাবে। তবে তিনি চাইলে অকালবোধনের মাধ্যমে শারদীয় দুর্গোৎসব করতে পারেন। এই উৎসব মানুষের মাঝে কেউ করেননি। তবে দেবতাদের মধ্যে রাম অকালবোধন করে দুর্গাপূজা করেছিলেন রাবণকে পরাজিত করতে। রমেশ শাস্ত্রীর পরামর্শ কংস নারায়ণের পছন্দ হয়। শুরু করেন শারদীয় দুর্গোৎসবের আয়োজন। প্রথম পূজায় তিনি ব্যয় করেছিলেন ৯ লাখ ১ টাকা। মাসব্যাপী যাত্রা, সার্কাস, পালাগানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়েছিল ওই উৎসবে। দেবীর সব গহনা ছিল স্বর্ণ ও মণিমুক্তা দিয়ে তৈরি। ওই উৎসবের পর থেকেই বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে শারদীয় দুর্গোৎসব। সেই থেকে এই মন্দিরটিকে দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এরপর ধীরে ধীরে পুরো উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে দেবী দুর্গার শারদীয় পূজা। বাঙালি হিন্দুর কাছে দুর্গোৎসব হয়ে ওঠে সার্বজনীন।
মাসব্যাপী চলা ওই উৎসবে পৌরহিত্যের দায়িত্ব পালন করেছিলেন রাজপণ্ডিত বাবু রমেশ শাস্ত্রী। এরপর প্রতিবছর দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানের জন্য তিনি রাজবাড়ীর প্রধান ফটকের পাশেই গড়ে তোলেন স্থায়ী মন্দির। রাজপ্রথা বাতিল হওয়ার আগ পর্যন্ত সে মন্দিরে পূজা-অর্চনা করতেন সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। জেলার বাইরে থেকে লোকজন আসতেন সেখানে। কিন্তু ১৯৬৭ সালে রাজা কংস নারায়ণের রাজবাড়ী দখল করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে কলেজ। দখল করা হয় রাজবাড়ী-ঘেঁষা উপমহাদেশের প্রথম দুর্গা মন্দিরটি। 
তবে ২০১২ সাল থেকে আবারও সেখানে পূজা হচ্ছে। ২০১৮ সালে তৎকালীন স্থানীয় এমপি ২৫ লাখ টাকায় একটি অষ্টধাতুর প্রতিমা দেন। সেই প্রতিমায় প্রতিবছর এখন পূজা হয়। 
স্থানীয়রা জানান, ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে পূজা-অর্চনা হলেও দেবীর আবির্ভাবের স্থান হিসেবে এখনও জাতীয় স্বীকৃতি পায়নি মন্দিরটি। এ ছাড়া সংস্কারের অভাবে জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়ে আছে ঐতিহাসিক এই মন্দিরগুলো। স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বলছেন, সংস্কারের অভাবে মন্দিরগুলো দীর্ঘদিন ধরে যেমন জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে, তেমনি সরকারের সুদৃষ্টির অভাবে জাতীয় স্বীকৃতি পায়নি।
সরেজমিন দেখা যায় রাজা কংস নারায়ণের আমলের চারটি পুরোনো মন্দির। এর মধ্যে একটি কিছুটা সংস্কার করা হলেও অপর তিনটির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। খসে খসে পড়ছে ভবনের ইট ও ছাদের পলেস্তারা। সংস্কার করা মন্দিরটির বেদিতে বসানো আছে ২৫ মণ ওজনের অষ্টধাতুর তৈরি দেবী দুর্গার প্রতিমা। মন্দির প্রাঙ্গণেই একটি মন্দির কমপ্লেক্স নির্মাণ শুরু হয়েছে। তবে অজানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে সে কাজও বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রচলনে মন্দিরটি ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দর্শনার্থীরা এখানে তীর্থ ভ্রমণে আসেন। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ থেকেও তীর্থযাত্রীরা মন্দিরটি পরিদর্শনে আসেন। তবে মন্দিরটিকে এখনও তীর্থস্থান হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। মন্দিরটি সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ করে তীর্থস্থান ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি এলাকাবাসীর।
মন্দিরের পুরোহিত গোপাল চক্রবর্তী বলেন, ‘আগে দুর্গাপূজার প্রচলন থাকলেও তা সার্বজনীন বা বারোয়ারি ছিল না। রাজা কংস নারায়ণই সর্বপ্রথম উন্মুক্তভাবে মর্ত্যলোকে দেবী দুর্গার পূজা করেন। ঐতিহাসিক এ মন্দিরটিতে বর্তমানে প্রায় ২৫ মণ ওজনের অষ্টধাতুর প্রতিমা আছে। আর দেবী যেহেতু নিত্যপূজনীয়, তাই এই প্রতিমা বিসর্জনও হয় না।’
বাগমারা উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি সত্যজিৎ রায় বলেন, ‘ভারতবর্ষের মধ্যে সর্বপ্রথম এই মন্দিরেই দুর্গাপূজার প্রচলন হয়। কলকাতার আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকেও প্রতিবছর পূজার সময় এই ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে এই মন্দিরটি ইতিহাসের অংশ। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, মন্দিরটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি দুর্গাপূজার আবির্ভাবস্থল হিসেবে মন্দিরটির রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতিও এখনও দেয়নি সরকার। আমরা প্রশাসনকে বারবার অবগত করার পরও কোনো ফল পাইনি। মন্দিরটির ব্যাপারে আমরা প্রশাসন ও সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সরকার অসীম কুমার বলেন, ‘এই মন্দিরের স্বীকৃতি রাজশাহী জেলার ব্যান্ডবুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জাতীয় স্বীকৃতির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হবে।’

সৌরভ হাবিব: সমকালের রাজশাহী ব্যুরোপ্রধান

আরও পড়ুন

×