শরৎ সাহার বাড়ির শতবর্ষী পূজা
ফাইল ছবি
হাসানউজ্জামান
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:০৮ | আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৪ | ২০:৩২
ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা এলাকার শরৎ সাহার বাড়ির দুর্গাপূজার কথা জানে না এমন মানুষ অন্তত ফরিদপুরে বিরল। ২০২০ সাল পর্যন্ত এ বাড়ির পূজাই ছিল ভক্তদের পাশাপাশি সাধারণ দর্শনার্থীর কাছেও প্রধান আকর্ষণ। প্রায় শতবর্ষের পুরোনো এই পূজা ইদানীং কিছুটা আকর্ষণ হারালেও জেলা ও আশপাশের মানুষ শহরে পূজা দেখতে
এলে শরৎ সাহার বাড়িতে একবার না গিয়ে পারে না।
জানা যায়, ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে শরৎ সাহার বাড়ির দুর্গাপূজার সূচনা। তার পর থেকে স্বাধীনতা লাভের আগ পর্যন্ত মহাসমারোহেই ওই বাড়িতে পূজা হতো। ঐতিহ্যবাহী এ পূজাকে আধুনিকতার ছোঁয়া এনে দেন ওই পরিবারেরই জামাই এসবি নায়েক।
কথা হয় ওই পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি ৮০ বছর বয়সী অর্পণা রানী সাহার সঙ্গে। তিনি আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন শরৎ সাহার বাড়ির দুর্গাপূজার ইতিহাস। ওই বাড়ির বড়মা নামে সুপরিচিত অর্পণা রানী জানান, শরৎ চন্দ্র সাহা ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান। তারা ছিলেন পাঁচ ভাই। শরৎ সাহা তাঁর বড় শ্বশুর। মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী এই পূজাতে এক চালিতে সব প্রতিমা থাকত। এখনকার মতো দুর্গার ডানে-বাঁয়ে সাজানো থাকত না।
তিনি জানান, ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ভারতের যাত্রাপালা আসত এই বাড়িতে। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত চলত যাত্রাপালা। আশপাশের জেলা থেকে কীর্তনীয়ারাও আসতেন গান গাইতে। বেশ একটা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ছিল তখনকার পূজায়, যেটি এখন কমে গেছে। এখনকার চাকচিক্যর চেয়ে ওই পূজাতেই তার বেশি ভালো লাগত বলে জানান বড়মা। ‘বেশ একটা ভক্তির ব্যাপার ছিল সেখানে,’ বলেন তিনি। তবে এখন ধুমধাম করে মিউজিক বাজিয়ে আনন্দ করে সবাই। ওদের আনন্দ তাই তার আনন্দ হিসেবে ধরে নেন তিনি।
’৯১ সালে তাঁর বড় মেয়ে রীতার বিয়ে হয়। ’৯৩ সাল থেকে শুরু হয় শরৎ সাহার বাড়ির আধুনিক পূজার আয়োজন। বাড়ির ছাদ থেকে যে লাইটিং করা হয়, তা ছড়িয়ে পড়ে শহর ছাড়িয়ে শহরতলি পর্যন্ত। আধুনিক সাউন্ড সিস্টেমে দুর্গতিনাশিনী দুর্গার অসুর বধের দৃশ্যায়ন দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসতে শুরু করেন পূজারি, ভক্তরা। হিন্দু-মুসলিম সব সম্প্রদায় ও শ্রেণির মানুষই শরৎ সাহার বাড়ির এই পূজা দেখতে ভিড় জমাতেন সেখানে। ২০০০ সাল পর্যন্ত চলে এই ধুমধাম আয়োজন। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত বাড়ির আঙিনায় তিল ধারণের ঠাঁই থাকত না। প্রতি ১৫ মিনিট পরপর চলত অসুর বধের সেই শো, তাই লেগে থাকত দর্শক-শ্রোতার ভিড়। ২০২০ সালে জামাতা এসবি নায়েক করোনায় মারা যাওয়ার পর ভাটা পড়ে সেই আয়োজনে। ২০২১ সাল থেকে আয়োজনের ভাটা পড়লেও সন্তানসন্ততি ও তাদের উত্তরসূরিরা চেষ্টা করে যাচ্ছে আয়োজনকে ধরে রাখতে।
অর্পণা রানী সাহা বলেন, আমাদের ছেলেপেলেরা অনেক নম্র, ভদ্র প্রকৃতির। সামর্থ্য থাকলেও সাহস পায় না। পরের প্রজন্ম এসে হয়তো আবার জমিয়ে তুলবে ঐতিহ্যবাহী এই পূজাকে।
শরৎ সাহার বাড়ির ছেলে সাংবাদিক সঞ্জয় সাহা পিয়াল। তাঁর স্ত্রী চৈতি সাহা বললেন, ২০১৪ সালে বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে আসার পর থেকে জমজমাট পূজা দেখেছি। যখন বিয়ে ঠিক হয়েছে, তখন থেকেই লোকজন বলত– যে বাড়িতে বউ হয়ে যাচ্ছিস, সেখানে বিরাট পূজা হয়। সারাদেশের মানুষ সেখানে জড়ো হয়। বাস্তবে তাই দেখেছি আমরা ২০২০ সাল পর্যন্ত। ১০ মিনিটের অসুর বধ শো দেখতে হাজার হাজার মানুষ বাড়িরা আঙিনায় ভিড় জমাতে। মৌমাছির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসত, তিল ধারণের ঠাঁই থাকত না। বছরের এই দিনটির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম আমরা। এখনও আসি, কিন্তু আগের সেই জৌলুস নেই। আমার ছেলেমেয়েরা বলে, স্বামী-ভাশুর তাদের বাচ্চারাও বলে, বড় হয়ে তারা এই বাড়িতে আবার ঐতিহ্যবাহী পূজাকে ফিরিয়ে আনবে, আবারও ঢল নামবে উৎসব মানুষের। ওদের কথা শুনে আমরা উৎসাহ পাই। আমরা এখনও ধরে রেখেছি কোনোরকমে এই পূজাকে।
হাসানুজ্জামান: সমকালের স্টাফ রিপোর্টার
- বিষয় :
- উৎসব পালন