ঢাকা বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

মেধস মুনির আশ্রম

মেধস মুনির আশ্রম

সারোয়ার সুমন

সারোয়ার সুমন

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:১১

চট্টগ্রাম শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বোয়ালখালী উপজেলা সদর। সেখান থেকে আরও ১১ কিলোমিটার এগোলে সামনে পড়ে আহলা করলডেঙ্গা ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নেরই সীমান্তবর্তী একটি পাহাড়ের নাম করলডেঙ্গা। যার চূড়ায় আছে হিন্দুদের গুরুত্বপূর্ণ এক তীর্থভূমি মেধস মুনির আশ্রম। দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল হিসেবে পরিচিত এই আশ্রমটির রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। 
শ্রীচণ্ডীতে উল্লেখ আছে, ঋষি মেধস মাতৃদর্শন লাভের জন্য বৈশ্য সমাধিকে এ পুণ্যক্ষেত্রেই প্রথম পূজা করতে আদেশ দিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন দুর্গাপূজার পাঠও। রাজা ও বৈশ্য নিজেদের দুরবস্থা থেকে মুক্ত হতে চট্টগ্রামে মেধসের এই আশ্রমটিতে মাটি দিয়ে দুর্গা প্রতিমা নির্মাণ করে মর্ত্যলোকে প্রথম দুর্গাপূজার সূচনা করেন। সেই থেকে আজ অবধি এখানে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। আর এই মেধস মুনির আশ্রম পরিচিতি পেয়েছে দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল হিসেবে। 
মেধস মুনির আশ্রমের অধ্যক্ষ বুলবুলানন্দ বলেন, ‘এই আশ্রমটি হিন্দুদের গুরুত্বপূর্ণ এক তীর্থভূমি। এটি দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল হিসেবে পরিচিত। এটির রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। পৌরাণিকেও তার উল্লেখ রয়েছে। দর্শনার্থীদের কাছেও তাই এই আশ্রমটি আলাদা মর্যাদা পায় সব সময়।’
যা আছে আশ্রমে
আশ্রমের প্রবেশপথে রয়েছে গণেশ মন্দির। ১৪০টি সিঁড়ি বেয়ে প্রায় ৫০০ ফুট ওপরে রয়েছে মেধস মুনির মন্দির। ওই পথে আরও কয়েক ধাপ এগোলে চোখে পড়বে দৃষ্টিনন্দন মূল আশ্রম। মূল আশ্রমেই রয়েছে চণ্ডী মন্দির। চণ্ডী মন্দিরের পাশে রয়েছে আশ্রমের আবিষ্কারক যোগী পুরুষ স্বামী বেদানন্দ মহারাজের সমাধি মন্দির। মূল আশ্রমের ডানে পাহাড়ি পথে কিছুদূর এগোলে চোখে পড়বে কামাখ্যা মন্দির। তারপরের সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় শিবমন্দির। এরপর ওই পাহাড়ের আরও কয়েক ধাপ নেমে আবারও উঠতে হয় আরেকটি পাহাড়ের শীর্ষে। ওই পাহাড়ের শীর্ষে রয়েছে তারা কালী মন্দির। মূল আশ্রমের বাম পাশের একটি পাহাড়ে রয়েছে মেধসশ্বরী দক্ষিণা কালী মন্দির। মূল আশ্রম, কামাখ্যা মন্দির, শিবমন্দির ও তারা কালী মন্দিরে পাহাড়ে সন্ধিস্থলে রয়েছে মানস সরোবর। পাহাড় নিঃসৃত ঝরনাধারা এ সরোবরে প্রতিনিয়ত প্রবাহিত হচ্ছে। মূল আশ্রম থেকে প্রায় ৩০০ ফুট নিচে এ সরোবর। তার পাশে রয়েছে সীতা মন্দির। জনশ্রুতি আছে, ত্রেতাযুগে সীতা এ সরোবরে স্নান করেছিলেন। মূল চণ্ডী মন্দিরের পেছনের অংশে রয়েছে ভোগঘর, আশ্রম অধ্যক্ষের কার্যালয়, যাত্রী নিবাস। এ ভোগঘরের সামনে কাঁঠালগাছের গোড়ায় রয়েছে বিলুপ্ত প্রজাতির ১২টি কাছিম। এরা ঋষি কচ্ছপ নামে পরিচিত। 
কেন ব্যতিক্রম এই আশ্রম
ইতিহাস বলছে, বরিশাল জেলার গৈলা গ্রাম নিবাসী বৈদিক ব্রাহ্মণকুলে ১২৬৬ বাংলার ২৫ অগ্রহায়ণ চন্দ্রশেখর নামে যে শিশুটি জন্মেছিল, কালান্তরে সে শিশুই মহাযোগী বেদানন্দ নামে আখ্যায়িত হয়ে সনাতনী সমাজের সুপ্রাচীন শক্তি তীর্থ আবিষ্কার করে চট্টগ্রামকে পৃথিবীর কাছে এক নতুন পরিচয়ে পরিচিত করেছেন। 
চট্টগ্রামে মেধসাশ্রম আবিষ্কার এক দৈব ঘটনা। শ্রীচণ্ডীতে উল্লেখ আছে স্বামী বেদানন্দ মহাত্মাই ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে যোগবলে জ্ঞাত হয়েই এ পুণ্যতীর্থ উদ্ধার করেন। তাঁর সংস্কৃতে রচিত ‘মেধসাশ্রম মাহাত্ম্য’ (যার অনুবাদ করেছেন সুপণ্ডিত দেবেন্দ্র বিজয় বসু)। স্বামী বেদানন্দ আবিষ্কৃত এ পবিত্র স্থানেই কয়েক হাজার বছর পূর্বে মহাশক্তি জগন্মাতার আগমন ঘটেছিল। এ পবিত্র স্থানই মর্ত্যলোকে মঙ্গলময়ী মায়ের আবির্ভাবের আদিস্থান। এখানেই প্রথম মৃন্ময়ী দেবীর আরাধনা হয়েছিল। মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তিতে পূজা হয়েছিল প্রথমবারের মতো। সেই থেকে প্রতিবছর মহালয়ার মাধ্যমে দেবী পক্ষের সূচনা হয় এই মন্দিরে।
দর্শনার্থী আসে প্রতিদিন
নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার এলাকা থেকে পরিবার নিয়ে আশ্রমে আসা শিব পোদ্দার বলেন, ‘প্রতিবছরই বাবা-মায়ের সঙ্গে এই মন্দিরে পূজা করতে আসি। এবার এলাম পূজার আগেই। এখানে প্রবেশ করার পর অন্যরকম এক অনুভূতি হয় দেহমনে।’ তিনি জানান, চট্টগ্রাম শহরের বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল হতে বাসযোগে অথবা সিএনজি ট্যাক্সিযোগে সরাসরি বোয়ালখালী উপজেলা পরিষদে আসা যায়। সেখান থেকে একইভাবে আসা যায় কানুনগোপাড়া কালাইয়ার হাটে। এটির বাম পাশ দিয়ে কিছুদূর অতিক্রমের পর সামনে পড়বে মেধসমুনি আশ্রম। প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই আশ্রম ও সংলগ্ন মন্দির ধ্বংস করে দেয়। পরে স্থানীয় হিন্দুদের সহযোগিতায় এই মন্দির ও আশ্রম পুনর্নির্মাণ করা হয়। 
হাজারো মণ্ডপে পূজা হলেও দৃষ্টি থাকবে মেধস মুনিরে।
চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলায় ৪ হাজার ৭৩০টি পূজামণ্ডপে এবার শারদীয় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ২ হাজার ৪৪৪, কক্সবাজারে ৩২১, ফেনীতে ১৪৬, নোয়াখালীতে ৮৩, লক্ষ্মীপুরে ৭৮, চাঁদপুরে ২২২, কুমিল্লায় ৭৭৭, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫২২, খাগড়াছড়িতে ৬১, রাঙামটিতে ৪৪, বান্দরবানে ৩২টি পূজামণ্ডপে এবার শারদীয় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। তবে সবচেয়ে প্রাচীন পূজামণ্ডপ হিসেবে এবারও দর্শনার্থীর ভিড় থাকবে মেধস মুনির আশ্রমে।
কী লেখা আছে ইতিহাসে
গৌরীতন্ত্রের কামাখ্যা পটলে এই আশ্রমের বিবরণ দিতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়, ‘কর্ণফুলী মহানদী গোপর্বত সমুদ্ভবা। তস্যাশ্চ দক্ষিণে তীরে পর্বতঃ পুণ্যাবিত্তমঃ। তত্র দশমহাবিদ্যা গঙ্গানাভি স্বরূপিণী। মার্কয়ে মুনেঃ স্থানং মেধসোমুনেরাশ্রমঃ। তত্রচ দক্ষিণাকালী বানলিঙ্গং শিবঃ স্বয়ং। ইতি গৌরী তন্ত্রীয় কামাখ্যা পটলে দেবী মাহাত্ম্য বর্ণন প্রসঙ্গেন সমুদ্ভাসিতম্‌।’ আবার কামাখ্যাতন্ত্রে বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয় যে, ‘কর্ণফুলীং সমারাভ্য যাবদ্দক্ষিণ সাগরম্‌। পুণ্যক্ষেত্রমিদং প্রেক্তং মুনিগণবিসেবিতম্‌। যত্রাস্তি বেতসা নাম্নী দিব্যা পুন্যাতোয়া নদী। তত্রৈবাসীম্মুনি শ্রেষ্ঠ মেধসঃ ঋষিরাশ্রমঃ। ইতি কামাখ্যাতন্ত্রে পঞ্চত্রিংসাৎ পটলে সিদ্ধস্থান। বর্ণন প্রসঙ্গেন সমুদ্ভাসিতম্‌।’ যোগিনীতন্ত্রে এই মার্কয়ে আশ্রমের কথা এবং তৎসন্নিহিত চতুর্ধনু পরিমিত মার্কয়ে কুণ্ড ও মার্কয়ে পদচিহ্ন ইত্যাদি উল্লিখিত আছে। এসব কারণে বোয়ালখালীর মেধসমুনি আশ্রম আছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।

সারোয়ার সুমন, রিজিওনাল এডিটর 
(চট্টগ্রাম), সমকাল
 

আরও পড়ুন

×