গল্প
সময়ের পাঠ
বুলবুল চৌধুরী
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ১২:০০
তিন দিন ধরে আকাশ কখনো প্রবল, কখনোবা গুঁড়িগুঁড়ি ধারায় বয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি। তারই মাঝে লেগে আছে মেঘের ডাকাডাকি আর বিদ্যুৎ চমকের ঘনঘটা। বিরতিহীন চলছে বাতাসের ওঠানামা। এই কাইতানে ঘরবন্দি মানুষগুলো ত্যক্ত-বিরক্ত যদিও একমাত্র স্ত্রী হামিনাকে ঘিরেই ইজাবুদ্দিনের দুশ্চিন্তা গভীর হচ্ছে। গতকাল থেকে খানিক বাদে বাদেই প্রসব যাতনায় মেয়েমানুষটার কঁকানো আওয়াজ শুনেই আসছে সে। শেষে স্ত্রীর প্রতি মমতা ঢেলে দেওয়ার মতো করে স্বামী প্রশ্ন করল, কী গো, বিষডা খালি বাড়তাছে নিহি?
হামিনা জবাব দিল, চিন্তা করতাছ যে, এইডা কইলাম হেই বিষ না।
হেইলে?
ছডির বিষ-বেদনা কোন মায় বাদ থুইতে পারে! তয় হেরও বেশি আমার কান্দন উঠতাছে আরেক চিন্তায়।
কী চিন্তা?
কেডা কয় পেডের ছাওয়ালডা খোদায়নি এইবারে বাঁচাইয়া রাখব। তাঁর দুয়ারে দুই হাত তুইল্লা তুমি খালি কইয়া যাও, হে খোদা, আমগো আইয়ে ছাওয়ালডারে তুমি সহিসালামতে রাইখো।
হামিনার পেটে দু'বার সন্তান এলেও জন্মেই তারা মারা যায়। কে জানে তৃতীয়বারে কী লেখা আছে তার কপালে! ইজাবুদ্দিন শুনেছে, সাত-তবক আসমানের ঊর্ধ্ব সীমানায় ইহকাল-পরকালের মালিক বাস করেন। বউয়ের ওই কথার পর উপরওয়ালার দিকে মোনাজাতের হাত তুলে সে বলে ওঠে, হে খোদা, এইবারে ছাওয়ালডারে বাঁচাইয়া রাইখো তুমি।
বাইরে চলছে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। হাওয়ার প্রবাহ কখনো বাড়ে, কখনো নুয়ে আসে অনেকখানি। হয়তো পৃথিবীর মানুষ, গাছগাছালি, ফুল, পাখি ও পানির স্পর্শে বাতাস যেমন প্রাণ পায়, সেসবেরও তেমন অপেক্ষা থাকে ওই বাতাসেরই জন্য। তারই পরশে দেহ শীতল ঠেকলেও জীবনের যাতনায় মন বড়ই অঠাঁইয়ে পড়ে। অমন পাক খেয়েই হামিনা প্রশ্ন করে, কও তো পেডের ছাওয়ালডা এইবারে কি বাঁইচ্চা থাকবো?
আমি কেমনে কমু হেই খবর! তয় কইতাম পারি, খোদায় চাইলে বাঁচব আমগো ছাওয়াল।
হামিনা বলল, আর একখান কথা।
কী?
কতখন ধইরাই ছাওয়ালডার মোডে লড়াচড়া নাই। আমার পেডে হাত দিয়া কও তো, কী দশা যাইতাছে তার!
সেই আহ্বানে সম্মোহিতের মতো স্ত্রীর স্টম্ফীত পেটে হাত রাখে ইজাবুদ্দিন। যেকোনো সময় 'ওয়া, ওয়া' কান্নার ভিতর দিয়ে হামিনার পেটের সন্তান নেমে আসবে পৃথিবীতে। তবে পেটে হাত রেখে সে আন্দাজ করতে পারে, বাচ্চাটার কোনো নড়াচড়া নেই। আর ঘরে জ্বলতে থাকা হারিকেনের আলোয় স্বামীর চুপচাপ ভাব খেয়াল করে স্ত্রী জানতে চাইল, কী বুঝলা?
ছাওয়ালডার মোডে লড়াচড়া নাই। ঘুমাইতাছে লাগে।
হঁ, ঘুমাইতাছে হইবো। তয় আতকা আতকা হেইডায় পেডের ভিত্তে কেমুন উড়ামুড়া যে লাগায়! করুক উড়ামুড়া। হেসে দুনিয়াতে ছাওয়ালডার বাঁইচ্চা থাকনই হইলো আসল।
ইজাবুদ্দিন ভাবে, পুরুষ নয়, সন্তান জন্মাবার বেদনা যা সওয়ার তা একমাত্র সয় নারী। এক্ষেত্রে স্বামী হয়ে সে শুধু স্ত্রীর ভাবনারই ভাগীদার। তারই মাঝে হামিনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ওঠে, দুইবার পেড লইলেও কোনো ছাওয়াল বাঁচে নাই। হেইতে জাইনো নিজেরে নিজে আমি খালি দুইষাই যাইতাছি।
ইজাবুদ্দিন আর্দ্র কণ্ঠে জবাব দেয়, হেইতে নিজেরে নিজে দোষনের কী হইলো? মাইনষের মরণ-বাঁচন খালি খোদায় কইতে পারেন।
জামাই-বউয়ের তাবৎ আলাপ ঘরের দক্ষিণ-পুব কোণে পাটিতে শোয়া বৃদ্ধা জমিলা বিবির কানে পশে। এবারে নীরবতা ভেঙে বুড়ি বলে, হামিনা গো, ছডির বিষ উডবো, হেইডা তো আছেই। তয় হেরও বেশি কইরা কওন লাগে পইক্ষের যেমুন জোড়া, তরা জামাই-বউ হেমুন ফিনের হইয়াই বান্ধা পড়ছস।
বুড়ির উক্তিতে হামিনা লজ্জিত স্বরে জবাব দেয়, জেডি যে কী কয়!
হঁ, কয়। এও কয়, আমার জামাই ইজাবুদ্দিনের রহম ভালা মানুষ আছিলো।
হামিনা বলে, বিয়ার পরে আইসা তাইনেরে আমার পাওয়া হয় নাই জেডি।
কেমনে পাবি তারে? তুই ইজাবের বউ হইয়া আওনের কয়েক বছর আগে কলেরা লাইগা মরল জামাই। সোনার মানুষ আছিলো হেয়।
ইজাবুদ্দিন মন্তব্য করল, জেডার লাহান নরম দিলের মানু আমি দুনিয়াতে আর কেউরে পাই নাই।
ইজাব রে!
কী জেডি?
পোড়াকপালি হওনে আমার পেডে পোলা-মাইয়া জন্মায় নাই। হেই দুঃখে তর জেডা আরেক বিয়া করলে পারত। করে নাই। এফি তগো দুই দুইডা পোলা হইয়াও বাঁচে নাই। হেই দুখ আমিও বুইঝাই যাইতাছি। লগে লগে খোদার ধারে কইয়াইও যাইতাছি, এইবারে ছাওয়ালডারে বাঁচাইয়া রাইখো গো খোদা।
সঙ্গে সঙ্গে অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় ইজাবুদ্দিন প্রশ্ন করে, কেমুন বুঝতাছো গো জেডি, পোলার বেডগ না তো কোনো?
বেডগ হইবো ক্যান, পেডের পোলা লড়েচড়ে। আমার মোন কয়, আল্লায় তগো দিক মুখ তুইলা চাইব।
ওই উত্তর পেয়ে ইজাবুদ্দিন বলে ওঠে, জেডি, আমারও মোন কয়, আল্লায় ছাওয়ালডারে বাঁচাইয়া রাখব।
বয়সের কারণে দৃষ্টিশক্তি কমে আসায় আকাশের ভাবসাব দেখতে পাওয়ার নয় বুড়ির। তাই জিজ্ঞেস করে, ইজাব রে, আসমানডায় কী ডগ দিলো?
মাঝেমধ্যে বর্ষণ কমলেও ফের তা গভীর ঢল হয়েই নেমে আসে ধরণীতে। সেদিক খেয়াল করে ইজাবুদ্দিন জবাব দেয়, আসমান ডগ দিব কী জেডি, লাগে কাইতান আরও বাড়তাছে।
ইজাব রে!
কী?
তর ঘরে আইসা আনাজের ছান, হুটকির ভর্তা, ডাইল বাদে মাছ খাইলাম না এক বেইলও। আমার কথা বাদ দে। তর বউয়ের পেডে ছাওয়াল। হের তো ভালা কিছু খাইতে মোনে কয়। হেইতে কই কী, কাইল বিয়ানে বাজারে গিয়া কয়ডা মাছ কিন্না আনিছ।
ইজাবুদ্দিন অসহায় স্বরে জবাব দেয়, কেমনে পামু মাছ?
ক্যান?
হোনো জেডি, এমুন কাইতানে বাজারে গাহক উডেনি যে, তাগো আশায় জাউলায় মাছ লইয়া হেইখানে যাইব।
হামিনা পাশে বসা স্বামীর গায়ে মৃদু চিমটি কাটে। সেই স্পর্শে আবদারের গন্ধ পেয়ে ইজাবুদ্দিন প্রশ্ন করে, কী হইলো?
আমার কইলাম বড় মাছ খাইতে ইচ্ছা করতাছে!
কও কী, হেমুনের মাছ আমি কই পাই অখনে?
বুড়ি জিজ্ঞেস করে, তোমার কী মাছ খাওনের ইচ্ছা গো বউ?
বোয়াল, বড় রহমের একখান বোয়ালের ছান যদি খাইতাম পারতাম!
বুড়ি বলে, চাইলেই কই পাওন যাইব হেমুনের বোয়াল? আইজের দিনে কী হেইতান পাওনের উপায় আছে! দুনিয়াতে মানুষ বাড়তাছে। হেরা ছোড থাকতেই মাছ ধইরা ধইরা এমন সাবাড় করতাছে যে, কোনোডা বড় হওনের ফাঁকনি পায়! তয় আগিলা দিনে বড়রও বেশি বড় বোয়াল, গজার, হইল, আইড় বাদেও কত্ত রহমের মাছ আমি খাইছি!
বুড়ির আলাপে হামিনা বেশ জমে যায়। বলে, হঁ গো জেডি, হেমুনের বড় মাছেই স্বাদ বেশি।
ইজাবুদ্দিন জিজ্ঞেস করে, জেডি, বড় মাছের আলাপ যে তুললা, কোনহানে পাইছিলা হেইতান?
হোন, আমার বাপের বাড়ি আছিলো যমুনার ধারে। ছোডকালে বাপ-চাচা আর ভাইয়ের লগে নাওয়ে কইরা হেই গাঙে আমিও জাল বাওয়ায় যাইতাম।
ইজাবুদ্দিন বলে, কাইল দিন ভালা গেলে বাজারে গিয়া হেমুনের মাছ না পাইলেও পামু তো বড় কিসিমের কোনডা। আনমুনে।
ইজাব রে।
কী জেডি?
তগো মাছের একখান গপ যে হোনানের আছিল।
কী গপ জেডি?
নিজের চউক্ষে না পড়লেও এইতান জানছি বাবারে দিয়া। তাইনে কইছিলেন হাইনজা নামতেই হিয়ালের ঝাঁক গাঙে গিয়া নিহি পানিতে লেঙুড় ডুবাইয়া খালি চুপ মাইরা থাকত।
স্বামী-স্ত্রী সমস্বরে জানতে চায়, ক্যান গো জেডি?
রাইতের কালে ছোড কস, বড় কস, হগল পদের মাছ গাঙের কিনার লয়। হেইগুলানের কোনো কোনোডায় কেডা কইবো কী বুইঝা হিয়ালের লেঙুড় কামুড় দিয়া ধরতেই ফান্দে পড়ত।
ইজাবুদ্দিন জিজ্ঞেস করল, এইডা আবার কেমুনের ফান্দ গো জেডি?
মাছের দুই চোয়ালে দাঁত কী এক-দুইখান? হেইতে হিয়ালের লেঙুড়ে কামুড় দেওনের লগে লগে মাছের কিরকিরা দাঁত লোম্বায় আইটকা যাইত। হিয়ালেও অমনেই দৌড়ে পাড়ে উইড্ডা হেই মাছ কচকচাইয়া খাইত।
গর্ভের সন্তান নড়ে উঠতেই হামিনা অজানা স্বামীর ডান হাত আঁকড়ে ধরে বলল, দুনিয়াতে আওনের লাগি পেডের পোলাডা আবার মোচড় তুলছে।
স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে স্বামী জবাব দিল, দেইখো, এইবারে খোদার ইচ্ছায় ছাওয়ালডা বাঁইচা থাকব।
এ সময় প্রসব যাতনা তীব্র আকার ধারণ করতেই হামিনা কঁকিয়ে ওঠা গলায় বলল, খোদা গো, বাঁচাও, পেডের ছাওয়ালডারে বাঁচাও।
সঙ্গে সঙ্গে জমিলা বিবি জানান দিল, বুঝতাছি তোর বউয়ের ছডি নামনের দেরি নাই। এমুনের দশায় তর সামনে থাকন মানা; যা ঘর ছাইড়া তুই ওছড়ায় গিয়া বইসা পড়।
ঘর ছেড়ে ইজাবুদ্দিন গিয়ে জায়গা নিল বারান্দায়। বইছে তুমুল বৃষ্টি। আছে ঝোড়ো হাওয়া। তারই মাঝে প্রসব বেদনায় একের পর এক চিৎকার দিয়ে যাচ্ছে স্ত্রী। ঝড়-ঝঞ্ঝার তীব্রতায় চারদিক যেমন তছনছ হতে পারে, প্রসব বেদনার তীব্রতায় স্ত্রীও তেমন মোচড় খাচ্ছে। তবে পুরুষ হয়ে ওই যন্ত্রণার কী বুঝবে ইজাবুদ্দিন! এসব যে শুধুই নিজেকে দিয়ে জানতে পারে একমাত্র গর্ভধারিণী। মাঝে বসে ঊর্ধ্বাকাশে দৃষ্টি মেলে ধরে সে আকুতি জানায়, হে দয়াল, তুমি হগল কিছুর মালিক। হামিনারে তুমি বাঁচাও। হের পেডের ছাওয়ালরেও বাঁচাও গো তুমি।
উন্মাতাল হাওয়া এসে গাছগাছালি আর বসতভিটায় ঝাপটা মারার আওয়াজ কানে আসে। আকাশের নানা প্রান্তে মেঘ গর্জায়। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের আলোয় পৃথিবী মুহূর্তের জন্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেও অন্ধকারই দাঁড়ায় অবশেষের গতি। সেসব ছাপিয়ে হামিনার প্রসব যাতনার চিৎকার ইজাবুদ্দিনের মর্মমূলে বেজেই চলে। শেষে বউয়ের গর্ভপাত হতেই নবজাতক 'ওয়া ওয়া' কেঁদে ওঠে। তারও খানিক বাদে জমিলা বিবি ডাকল, ইজাব রে, তোর পোলা হইছে। আজান দে, আজান দে তুই।
পশ্চিমমুখী হয়ে ইজাবুদ্দিন দু'কানে দু'হাতের আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে 'আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর' ধ্বনি তুলল।
তারপর ইজাবুদ্দিন ভাবল, বউয়ের গর্ভ থেকে যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো, সে বাঁচে না মরে, তা উপরওয়ালারই অধীন বিষয়। তাই সে ফের মোনাজাতের হাত তুলে বিড়বিড় স্বরে বলে উঠল, হে খোদা, হে মাবুদ, ছাওয়ালডারে তুমি বাঁচাইয়া রাইখো।
পর মুহূর্তে জমিলা বিবি ডাক ছাড়ে, পোলার মুখ চাওনের হইলে আয় রে ঘরে।
ইজাবুদ্দিন ঢোকে ঘরে। হামিনা ঊর্ধ্বমুখী শুয়ে আছে বিছানায়। জমিলা বিবি নবজাতককে কোলে নিয়ে তার সামনাসামনি হয়ে বলল, চোখ ভইরা দেখ তর পোলার মুখ।
ইজাবুদ্দিন পলকহীন চোখে সন্তানের দিকে তাকাতেই হামিনা ফিসফিস স্বরে ডাকল, আজ্ঞগ্দাও, তোমারে কানে কানে একখান কথা কই।
বউয়ের কাছাকাছি হয়ে ইজাবুদ্দিন জিজ্ঞেস করে, কানে কানে কী কথা গো তোমার?
হঁ গো, আমার পেডে আগেও দুইখান পোলা দিছিল খোদায়। বাঁচে নাই। তয় এইবারেরডা যেমুন ডাঙর-ডোঙর হইছে, গতরের জোরডাও হেমুনের বেশি লইয়া আইছে দুনিয়ায়।
হাছা?
হঁ, এইডায় দুধ খাইতে গিয়া বুনি ঠাইসা ঠাইসা চোয়। ঠোঁডেও জবর তাগদ। হঁ গো, খোদায় কী এইডারেও দুনিয়ারত্থে লইয়া যাইব কও?
এতে সত্য উত্তর টানতে পারেন একমাত্র উপরওয়ালা। অমন বুঝে লাজওয়াব রইলেও ইজাবুদ্দিনের অন্তরে বউয়ের জিজ্ঞাসাটাই ফিরে ফিরে প্রতিধ্বনি তোলে। পাশাপাশি সে শুনতে পায় আগের চেয়েও অধীর হয়ে নেমে আসা বৃষ্টির ঝুপঝাপ আওয়াজ। ঝোড়ো হাওয়াও ছুটে যায় শূন্য থেকে আরও দূর শূন্যে। বাড়ে মেঘের গর্জন। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের আলো ঠিকরে উঠলেও পর মুহূর্তে মিলিয়ে যায় অন্ধকারের অতলে। সেদিকে তাকিয়ে সে সবে নিজের ঔরসে জন্ম নেওয়া নবজাতকের মুখখানা বহমান সময়ের ভিতরে একাকার পায়।
লেখক
কথাসাহিত্যিক
হামিনা জবাব দিল, চিন্তা করতাছ যে, এইডা কইলাম হেই বিষ না।
হেইলে?
ছডির বিষ-বেদনা কোন মায় বাদ থুইতে পারে! তয় হেরও বেশি আমার কান্দন উঠতাছে আরেক চিন্তায়।
কী চিন্তা?
কেডা কয় পেডের ছাওয়ালডা খোদায়নি এইবারে বাঁচাইয়া রাখব। তাঁর দুয়ারে দুই হাত তুইল্লা তুমি খালি কইয়া যাও, হে খোদা, আমগো আইয়ে ছাওয়ালডারে তুমি সহিসালামতে রাইখো।
হামিনার পেটে দু'বার সন্তান এলেও জন্মেই তারা মারা যায়। কে জানে তৃতীয়বারে কী লেখা আছে তার কপালে! ইজাবুদ্দিন শুনেছে, সাত-তবক আসমানের ঊর্ধ্ব সীমানায় ইহকাল-পরকালের মালিক বাস করেন। বউয়ের ওই কথার পর উপরওয়ালার দিকে মোনাজাতের হাত তুলে সে বলে ওঠে, হে খোদা, এইবারে ছাওয়ালডারে বাঁচাইয়া রাইখো তুমি।
বাইরে চলছে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। হাওয়ার প্রবাহ কখনো বাড়ে, কখনো নুয়ে আসে অনেকখানি। হয়তো পৃথিবীর মানুষ, গাছগাছালি, ফুল, পাখি ও পানির স্পর্শে বাতাস যেমন প্রাণ পায়, সেসবেরও তেমন অপেক্ষা থাকে ওই বাতাসেরই জন্য। তারই পরশে দেহ শীতল ঠেকলেও জীবনের যাতনায় মন বড়ই অঠাঁইয়ে পড়ে। অমন পাক খেয়েই হামিনা প্রশ্ন করে, কও তো পেডের ছাওয়ালডা এইবারে কি বাঁইচ্চা থাকবো?
আমি কেমনে কমু হেই খবর! তয় কইতাম পারি, খোদায় চাইলে বাঁচব আমগো ছাওয়াল।
হামিনা বলল, আর একখান কথা।
কী?
কতখন ধইরাই ছাওয়ালডার মোডে লড়াচড়া নাই। আমার পেডে হাত দিয়া কও তো, কী দশা যাইতাছে তার!
সেই আহ্বানে সম্মোহিতের মতো স্ত্রীর স্টম্ফীত পেটে হাত রাখে ইজাবুদ্দিন। যেকোনো সময় 'ওয়া, ওয়া' কান্নার ভিতর দিয়ে হামিনার পেটের সন্তান নেমে আসবে পৃথিবীতে। তবে পেটে হাত রেখে সে আন্দাজ করতে পারে, বাচ্চাটার কোনো নড়াচড়া নেই। আর ঘরে জ্বলতে থাকা হারিকেনের আলোয় স্বামীর চুপচাপ ভাব খেয়াল করে স্ত্রী জানতে চাইল, কী বুঝলা?
ছাওয়ালডার মোডে লড়াচড়া নাই। ঘুমাইতাছে লাগে।
হঁ, ঘুমাইতাছে হইবো। তয় আতকা আতকা হেইডায় পেডের ভিত্তে কেমুন উড়ামুড়া যে লাগায়! করুক উড়ামুড়া। হেসে দুনিয়াতে ছাওয়ালডার বাঁইচ্চা থাকনই হইলো আসল।
ইজাবুদ্দিন ভাবে, পুরুষ নয়, সন্তান জন্মাবার বেদনা যা সওয়ার তা একমাত্র সয় নারী। এক্ষেত্রে স্বামী হয়ে সে শুধু স্ত্রীর ভাবনারই ভাগীদার। তারই মাঝে হামিনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ওঠে, দুইবার পেড লইলেও কোনো ছাওয়াল বাঁচে নাই। হেইতে জাইনো নিজেরে নিজে আমি খালি দুইষাই যাইতাছি।
ইজাবুদ্দিন আর্দ্র কণ্ঠে জবাব দেয়, হেইতে নিজেরে নিজে দোষনের কী হইলো? মাইনষের মরণ-বাঁচন খালি খোদায় কইতে পারেন।
জামাই-বউয়ের তাবৎ আলাপ ঘরের দক্ষিণ-পুব কোণে পাটিতে শোয়া বৃদ্ধা জমিলা বিবির কানে পশে। এবারে নীরবতা ভেঙে বুড়ি বলে, হামিনা গো, ছডির বিষ উডবো, হেইডা তো আছেই। তয় হেরও বেশি কইরা কওন লাগে পইক্ষের যেমুন জোড়া, তরা জামাই-বউ হেমুন ফিনের হইয়াই বান্ধা পড়ছস।
বুড়ির উক্তিতে হামিনা লজ্জিত স্বরে জবাব দেয়, জেডি যে কী কয়!
হঁ, কয়। এও কয়, আমার জামাই ইজাবুদ্দিনের রহম ভালা মানুষ আছিলো।
হামিনা বলে, বিয়ার পরে আইসা তাইনেরে আমার পাওয়া হয় নাই জেডি।
কেমনে পাবি তারে? তুই ইজাবের বউ হইয়া আওনের কয়েক বছর আগে কলেরা লাইগা মরল জামাই। সোনার মানুষ আছিলো হেয়।
ইজাবুদ্দিন মন্তব্য করল, জেডার লাহান নরম দিলের মানু আমি দুনিয়াতে আর কেউরে পাই নাই।
ইজাব রে!
কী জেডি?
পোড়াকপালি হওনে আমার পেডে পোলা-মাইয়া জন্মায় নাই। হেই দুঃখে তর জেডা আরেক বিয়া করলে পারত। করে নাই। এফি তগো দুই দুইডা পোলা হইয়াও বাঁচে নাই। হেই দুখ আমিও বুইঝাই যাইতাছি। লগে লগে খোদার ধারে কইয়াইও যাইতাছি, এইবারে ছাওয়ালডারে বাঁচাইয়া রাইখো গো খোদা।
সঙ্গে সঙ্গে অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় ইজাবুদ্দিন প্রশ্ন করে, কেমুন বুঝতাছো গো জেডি, পোলার বেডগ না তো কোনো?
বেডগ হইবো ক্যান, পেডের পোলা লড়েচড়ে। আমার মোন কয়, আল্লায় তগো দিক মুখ তুইলা চাইব।
ওই উত্তর পেয়ে ইজাবুদ্দিন বলে ওঠে, জেডি, আমারও মোন কয়, আল্লায় ছাওয়ালডারে বাঁচাইয়া রাখব।
বয়সের কারণে দৃষ্টিশক্তি কমে আসায় আকাশের ভাবসাব দেখতে পাওয়ার নয় বুড়ির। তাই জিজ্ঞেস করে, ইজাব রে, আসমানডায় কী ডগ দিলো?
মাঝেমধ্যে বর্ষণ কমলেও ফের তা গভীর ঢল হয়েই নেমে আসে ধরণীতে। সেদিক খেয়াল করে ইজাবুদ্দিন জবাব দেয়, আসমান ডগ দিব কী জেডি, লাগে কাইতান আরও বাড়তাছে।
ইজাব রে!
কী?
তর ঘরে আইসা আনাজের ছান, হুটকির ভর্তা, ডাইল বাদে মাছ খাইলাম না এক বেইলও। আমার কথা বাদ দে। তর বউয়ের পেডে ছাওয়াল। হের তো ভালা কিছু খাইতে মোনে কয়। হেইতে কই কী, কাইল বিয়ানে বাজারে গিয়া কয়ডা মাছ কিন্না আনিছ।
ইজাবুদ্দিন অসহায় স্বরে জবাব দেয়, কেমনে পামু মাছ?
ক্যান?
হোনো জেডি, এমুন কাইতানে বাজারে গাহক উডেনি যে, তাগো আশায় জাউলায় মাছ লইয়া হেইখানে যাইব।
হামিনা পাশে বসা স্বামীর গায়ে মৃদু চিমটি কাটে। সেই স্পর্শে আবদারের গন্ধ পেয়ে ইজাবুদ্দিন প্রশ্ন করে, কী হইলো?
আমার কইলাম বড় মাছ খাইতে ইচ্ছা করতাছে!
কও কী, হেমুনের মাছ আমি কই পাই অখনে?
বুড়ি জিজ্ঞেস করে, তোমার কী মাছ খাওনের ইচ্ছা গো বউ?
বোয়াল, বড় রহমের একখান বোয়ালের ছান যদি খাইতাম পারতাম!
বুড়ি বলে, চাইলেই কই পাওন যাইব হেমুনের বোয়াল? আইজের দিনে কী হেইতান পাওনের উপায় আছে! দুনিয়াতে মানুষ বাড়তাছে। হেরা ছোড থাকতেই মাছ ধইরা ধইরা এমন সাবাড় করতাছে যে, কোনোডা বড় হওনের ফাঁকনি পায়! তয় আগিলা দিনে বড়রও বেশি বড় বোয়াল, গজার, হইল, আইড় বাদেও কত্ত রহমের মাছ আমি খাইছি!
বুড়ির আলাপে হামিনা বেশ জমে যায়। বলে, হঁ গো জেডি, হেমুনের বড় মাছেই স্বাদ বেশি।
ইজাবুদ্দিন জিজ্ঞেস করে, জেডি, বড় মাছের আলাপ যে তুললা, কোনহানে পাইছিলা হেইতান?
হোন, আমার বাপের বাড়ি আছিলো যমুনার ধারে। ছোডকালে বাপ-চাচা আর ভাইয়ের লগে নাওয়ে কইরা হেই গাঙে আমিও জাল বাওয়ায় যাইতাম।
ইজাবুদ্দিন বলে, কাইল দিন ভালা গেলে বাজারে গিয়া হেমুনের মাছ না পাইলেও পামু তো বড় কিসিমের কোনডা। আনমুনে।
ইজাব রে।
কী জেডি?
তগো মাছের একখান গপ যে হোনানের আছিল।
কী গপ জেডি?
নিজের চউক্ষে না পড়লেও এইতান জানছি বাবারে দিয়া। তাইনে কইছিলেন হাইনজা নামতেই হিয়ালের ঝাঁক গাঙে গিয়া নিহি পানিতে লেঙুড় ডুবাইয়া খালি চুপ মাইরা থাকত।
স্বামী-স্ত্রী সমস্বরে জানতে চায়, ক্যান গো জেডি?
রাইতের কালে ছোড কস, বড় কস, হগল পদের মাছ গাঙের কিনার লয়। হেইগুলানের কোনো কোনোডায় কেডা কইবো কী বুইঝা হিয়ালের লেঙুড় কামুড় দিয়া ধরতেই ফান্দে পড়ত।
ইজাবুদ্দিন জিজ্ঞেস করল, এইডা আবার কেমুনের ফান্দ গো জেডি?
মাছের দুই চোয়ালে দাঁত কী এক-দুইখান? হেইতে হিয়ালের লেঙুড়ে কামুড় দেওনের লগে লগে মাছের কিরকিরা দাঁত লোম্বায় আইটকা যাইত। হিয়ালেও অমনেই দৌড়ে পাড়ে উইড্ডা হেই মাছ কচকচাইয়া খাইত।
গর্ভের সন্তান নড়ে উঠতেই হামিনা অজানা স্বামীর ডান হাত আঁকড়ে ধরে বলল, দুনিয়াতে আওনের লাগি পেডের পোলাডা আবার মোচড় তুলছে।
স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে স্বামী জবাব দিল, দেইখো, এইবারে খোদার ইচ্ছায় ছাওয়ালডা বাঁইচা থাকব।
এ সময় প্রসব যাতনা তীব্র আকার ধারণ করতেই হামিনা কঁকিয়ে ওঠা গলায় বলল, খোদা গো, বাঁচাও, পেডের ছাওয়ালডারে বাঁচাও।
সঙ্গে সঙ্গে জমিলা বিবি জানান দিল, বুঝতাছি তোর বউয়ের ছডি নামনের দেরি নাই। এমুনের দশায় তর সামনে থাকন মানা; যা ঘর ছাইড়া তুই ওছড়ায় গিয়া বইসা পড়।
ঘর ছেড়ে ইজাবুদ্দিন গিয়ে জায়গা নিল বারান্দায়। বইছে তুমুল বৃষ্টি। আছে ঝোড়ো হাওয়া। তারই মাঝে প্রসব বেদনায় একের পর এক চিৎকার দিয়ে যাচ্ছে স্ত্রী। ঝড়-ঝঞ্ঝার তীব্রতায় চারদিক যেমন তছনছ হতে পারে, প্রসব বেদনার তীব্রতায় স্ত্রীও তেমন মোচড় খাচ্ছে। তবে পুরুষ হয়ে ওই যন্ত্রণার কী বুঝবে ইজাবুদ্দিন! এসব যে শুধুই নিজেকে দিয়ে জানতে পারে একমাত্র গর্ভধারিণী। মাঝে বসে ঊর্ধ্বাকাশে দৃষ্টি মেলে ধরে সে আকুতি জানায়, হে দয়াল, তুমি হগল কিছুর মালিক। হামিনারে তুমি বাঁচাও। হের পেডের ছাওয়ালরেও বাঁচাও গো তুমি।
উন্মাতাল হাওয়া এসে গাছগাছালি আর বসতভিটায় ঝাপটা মারার আওয়াজ কানে আসে। আকাশের নানা প্রান্তে মেঘ গর্জায়। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের আলোয় পৃথিবী মুহূর্তের জন্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেও অন্ধকারই দাঁড়ায় অবশেষের গতি। সেসব ছাপিয়ে হামিনার প্রসব যাতনার চিৎকার ইজাবুদ্দিনের মর্মমূলে বেজেই চলে। শেষে বউয়ের গর্ভপাত হতেই নবজাতক 'ওয়া ওয়া' কেঁদে ওঠে। তারও খানিক বাদে জমিলা বিবি ডাকল, ইজাব রে, তোর পোলা হইছে। আজান দে, আজান দে তুই।
পশ্চিমমুখী হয়ে ইজাবুদ্দিন দু'কানে দু'হাতের আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে 'আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর' ধ্বনি তুলল।
তারপর ইজাবুদ্দিন ভাবল, বউয়ের গর্ভ থেকে যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো, সে বাঁচে না মরে, তা উপরওয়ালারই অধীন বিষয়। তাই সে ফের মোনাজাতের হাত তুলে বিড়বিড় স্বরে বলে উঠল, হে খোদা, হে মাবুদ, ছাওয়ালডারে তুমি বাঁচাইয়া রাইখো।
পর মুহূর্তে জমিলা বিবি ডাক ছাড়ে, পোলার মুখ চাওনের হইলে আয় রে ঘরে।
ইজাবুদ্দিন ঢোকে ঘরে। হামিনা ঊর্ধ্বমুখী শুয়ে আছে বিছানায়। জমিলা বিবি নবজাতককে কোলে নিয়ে তার সামনাসামনি হয়ে বলল, চোখ ভইরা দেখ তর পোলার মুখ।
ইজাবুদ্দিন পলকহীন চোখে সন্তানের দিকে তাকাতেই হামিনা ফিসফিস স্বরে ডাকল, আজ্ঞগ্দাও, তোমারে কানে কানে একখান কথা কই।
বউয়ের কাছাকাছি হয়ে ইজাবুদ্দিন জিজ্ঞেস করে, কানে কানে কী কথা গো তোমার?
হঁ গো, আমার পেডে আগেও দুইখান পোলা দিছিল খোদায়। বাঁচে নাই। তয় এইবারেরডা যেমুন ডাঙর-ডোঙর হইছে, গতরের জোরডাও হেমুনের বেশি লইয়া আইছে দুনিয়ায়।
হাছা?
হঁ, এইডায় দুধ খাইতে গিয়া বুনি ঠাইসা ঠাইসা চোয়। ঠোঁডেও জবর তাগদ। হঁ গো, খোদায় কী এইডারেও দুনিয়ারত্থে লইয়া যাইব কও?
এতে সত্য উত্তর টানতে পারেন একমাত্র উপরওয়ালা। অমন বুঝে লাজওয়াব রইলেও ইজাবুদ্দিনের অন্তরে বউয়ের জিজ্ঞাসাটাই ফিরে ফিরে প্রতিধ্বনি তোলে। পাশাপাশি সে শুনতে পায় আগের চেয়েও অধীর হয়ে নেমে আসা বৃষ্টির ঝুপঝাপ আওয়াজ। ঝোড়ো হাওয়াও ছুটে যায় শূন্য থেকে আরও দূর শূন্যে। বাড়ে মেঘের গর্জন। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের আলো ঠিকরে উঠলেও পর মুহূর্তে মিলিয়ে যায় অন্ধকারের অতলে। সেদিকে তাকিয়ে সে সবে নিজের ঔরসে জন্ম নেওয়া নবজাতকের মুখখানা বহমান সময়ের ভিতরে একাকার পায়।
লেখক
কথাসাহিত্যিক
- বিষয় :
- সময়ের পাঠ