একুশে
ভাষা :ভালোবাসা না অবহেলা?
ফারজানা সিদ্দিকা
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ১২:০০
'ভাষায় এবার আমাদের স্বকীয়তা চিহ্নিত করতে হবে'... বোধকরি এমন ভাবনা এ পর্যন্ত তিনবার ভেবেছে বাংলাদেশের বাঙালিরা। প্রথমবার ১৯৫২-তে, দ্বিতীয়বার ১৯৭১-এ আর তৃতীয়বার ১৯৯০ সালে। তিনটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বাঁক বদলে দেওয়া সাল। প্রথমবার ভাষাকে রক্ষা করা, আগলে রাখা আর বেশি বেশি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নতুন করে, নতুন উদ্যম ও উপলব্ধি নিয়ে ভালোবাসতে বাসতেই আসে ১৯৭১। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সরকারি অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহারের ঘোষণা এলেও দরকার পড়ে দীর্ঘ পরিকল্পনা ও সংস্কারের। কেননা, ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনামলের ফল হিসেবে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি পরতে যে ইংরেজি ভাষার প্রচলন রয়ে গেছে তার তেমন একটা বদল ঘটেনি পাকিস্তান শাসনামলেও। স্বাধীনতার পরে, বিশেষ করে, সংবিধান ও আদালতে ব্যবহূত আইনি ভাষা দ্রুত বাংলা করার তাগিদ আর উর্দু হটাও জাতীয় আবেগ ইত্যাদি বেশ গতিশীলতা পেয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫-এর ভয়াল ইতিহাসের পর বদলে যায় সার্বিক পরিস্থিতি। সামরিক শাসকদের ইংরেজিপ্রীতি পুনরায় প্রতিষ্ঠা পায় রাষ্ট্রে। ১৯৯০-এ সামরিক শাসনের পতনের পর যে গণতন্ত্রের নতুন হাওয়া বইতে শুরু করে সেখানে আবারও ভাষা নিয়ে নতুন চিন্তার প্রকাশ ঘটতে থাকে। অন্য দু'বারের তুলনায় তৃতীয়বারের ভাষা বিষয়ে ভাবনার ক্ষেত্রে দুটো বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, ইংরেজি এবার আর তেমন শত্রু ভাষা নয়। কেননা, মুক্তবাজার অর্থনীতির সুফল (!) পাওয়ার স্বপ্ন ততদিনে এ দেশের মানুষও দেখতে শুরু করেছে। ফলে ইংরেজি অত্যন্ত জরুরি ভাষা হিসেবে নতুনভাবে গণ্য হলো। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের ভাষার (মূলত নদীয়ার প্রমিত ভাষা) মতো নয়, বিশেষত, কথ্যরীতিতে একটা স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই ভাবনা প্রাধান্য পেল কিংবা বিস্তার লাভ করল আরও বছর কয়েক পরে বেসরকারি টেলিভিশনের জন্য তৈরি প্যাকেজ নাটকের ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের কবিতায় আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার পুরোনো নয়। স্বাধীনতার পরপরই আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার বাংলাদেশের মঞ্চনাটককে দিয়েছে অনন্য স্বকীয়তা। ঢাকাইয়া কুট্টি, নোয়াখালী, বরিশাল আর বৃহত্তর ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায়ই প্রধানত ব্যবহূত হতো মঞ্চনাটকে। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষারীতির বাইরে প্রমিত উচ্চারণ রীতি মূলত যেটা পশ্চিম বাংলায় চালু রয়েছে তার বিপরীতে এক 'নতুন ভাষারীতি' ব্যবহারের প্রস্তাব নিয়ে রীতিমতো তর্কযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে প্রথম থেকেই এবং এটা এখনও চলমান। তর্কযুদ্ধটা শুরু হয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্যাকেজ নাটকের রমরমা উত্থানের সময়।
এখানে মনে রাখা জরুরি যে, বিষয় বা চরিত্রের প্রয়োজনে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার নিয়ে নয়। তর্কযুদ্ধটা শুরু হয়েছে 'নতুন ভাষারীতি' নিয়ে। এই 'নতুন ভাষারীতি'তে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাই কেবল যুক্ত হয়নি, যুক্ত হয়েছে এক অভিনব বাচনরীতিও। এমনকি সম্বোধনবাচক শব্দেও এসেছে পরিবর্তন। বহু ব্যবহূত তিনটি বাক্য থেকে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, (১, ২ ও ৩ নম্বর বাক্য দুই বন্ধুর মধ্যে, ৪ নম্বরটি প্রেমিক-প্রেমিকার) ১. 'আব্বা বলেছেন, তার পক্ষে টাকা দেয়া সম্ভব না।' (বাপে কইছে, হ্যায় টাকা দিতে পারবো না।) ২. 'খুব সুন্দর একটা জামা গায়ে দিয়েছো তো বন্ধু!' (হেব্বি একখান শার্ট গায়ে দিছো তো মামা!) ৩. 'বাড়িতে পৌঁছে ফোন কোরো।' (বাড়িত গিয়া ফোন দিছ।) ৪. 'ভাত খেয়েছো সোনা?' (ভাত খাইছো বাবু?)। সম্বোধনে 'মামা', 'বাবু' নতুন অর্থ নিয়ে হাজির হয়েছে। অন্যদিকে, শুধু উচ্চারণ প্রক্রিয়ায় বদলে গেছে চেনা শব্দের অর্থ। যেমন, কঠিন, জিগায়, জোস, ওয়াও, সেরম, চরম, পচানো, মাঞ্জা ইত্যাদি। জীবন চলমান, ভাষাও। ভাষার ব্যবহার নিয়ে তর্কযুদ্ধ নতুন নয়। সাহিত্যের ভাষা হিসেবে সাধু না চলিতরীতি ব্যবহার করা হবে, এ নিয়ে মীমাংসায় সহসা পৌঁছানো যায়নি। লিখিত রূপ থেকে সাধুরীতি প্রায় বাদ পড়লেও এখনও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কথ্য রূপে সাধুরীতির ব্যবহার বহাল আছে। কারও মৃত্যুর সংবাদের মাইকিংয়ে, সিটি করপোরেশনের জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রচারে... 'এতদ্বারা এলাকাবাসীকে জানানো যাইতেছে যে...' দিয়ে বাক্য শুরুর রেওয়াজ দিব্যি চালু রয়েছে। সুতরাং কিছু সাধুরীতির ব্যবহার এই একবিংশ শতাব্দীতেও রয়ে গেছে।
কিন্তু যে বিষয়টি লক্ষ্য করা জরুরি তা হলো বাংলাদেশে ১৯৯০ পরবর্তী ভাষা পরিস্থিতি। নব্য গণতন্ত্রের সুবাতাসে ভাষা ব্যবহারের স্বকীয়তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শেষ হতে না হতেই ইন্টারনেটের দুনিয়া। এলো অভ্র! এলো ইউনিকোড! ভাষা এবার আরও শক্তি নিয়ে স্বাধীন। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় বাংলা ভাষার ব্যবহার বেড়েছে, বাড়ছে প্রতিদিন। এই তথ্য গর্বিত করলেও চোখ মেলে দেখতে মন চায় (মুঞ্চায়!) কেমন সে ভাষা? ব্যস্ততার পৃথিবীতে বাড়ছে নানা রকম সাইন বা ইমোজির ব্যবহার। স্বভাবতই, বাংলাদেশের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীও ইমোজির ব্যবহারে দক্ষ। ফলে শুভেচ্ছা, শোক, উচ্ছ্বাস, ক্ষোভ ইত্যাদি প্রকাশের জন্য নির্ধারিত শব্দের রূপান্তর ঘটছে। কিন্তু যখন ইমোজি নয়, শুভেচ্ছা প্রকাশে 'এইচবিডি' আর শোক প্রকাশে 'আরআইপি' ব্যবহার করা হয়, তখন ভাষা ভালোবাসা আর অহেতুক ব্যস্ততার অজুহাত নিয়ে সন্দেহ জাগে! ইমোজি ছাড়াও আছে বানান নিয়ে 'ভয়াবহ' সব অভিজ্ঞতা। আঞ্চলিকতাদুষ্ট বানানকে মার্জনা করা চলে, কিন্তু বাংলা বানানের আদলটাকেই যখন বদলে ফেলা হয় তখন রীতিমতো আতঙ্কিত হতে হয়!
এরও বাইরে শিক্ষা ব্যবস্থায় আনা হয় যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর প্রথম কয়েক বছরে অলিখিতভাবে নিয়ম করা হয় যে, শিক্ষার্থীরা যা-ই লিখবে তাতেই পাস! ভুল লিখুক, একটা শব্দ লিখুক, আধখানা বাক্য লিখুক... কিছু তো লিখেছে! পাস করানো হবে। তারপর, এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর কিছুটা বিধিনিষেধ আরোপ হলো ঠিকই, তাতে লাভ তেমন হলো না। এবার শুরু হলো শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে পাসের হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতা! এ প্রতিযোগিতায় আবারও অলিখিতভাবে নির্দেশ এলো- 'পাস করিয়ে দিতে হবে'। একদিকে, স্বকীয় ভাষারীতি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইচ্ছামতো বানানরীতির ব্যবহার, অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমন খেয়ালিপনা দুইয়ে মিলে গত দশ/পনেরো বছরের ফলাফল কী পাওয়া যাচ্ছে? প্রকাশনা ব্যবসায় যুক্ত যারা তারা পাচ্ছেন না ভরসা করে থাকার মতো তরুণ প্রুফ রিডার। সংবাদপত্রগুলোতেও একই অভিজ্ঞতা। আন্তর্জাতিক, খেলা ও বিনোদনের পাতাগুলোতে ভুলের ছড়াছড়ি। উদাহরণ দেয়া যাক, নায়িকার নাম স্বস্তিকা। ইংরেজি থেকে স্বস্তিকা বিষয়ে কোনো খবর অনুবাদ করতে গিয়ে অনায়াসে লিখে দিচ্ছে সোয়াসতিকা! দুই পাতা নির্ভুল বাংলায় একটা রিপোর্ট লিখবার মতো আত্মবিশ্বাস বিশ্ববিদ্যালয় পড়ূয়া শিক্ষার্থীদের নেই। মজার ব্যাপার হলো, ইংরেজিতে লিখবার আত্মবিশ্বাস কিন্তু আছে। কেননা, 'কপি-পেস্ট', 'অটো-ডিকশনারি', 'অটো-কারেকশন' ইত্যাদির ওপর ভরসা অগাধ তাদের।
বাস-ট্রাক-সিএনজির পেছনে 'আল্লাহকে স্বরণ করুন' দেখতে দেখতে বড় হওয়া শিশুরা একদিন সত্যি সত্যি আর স্মরণ বানানটিকে স্মরণ করতে পারে না। বছরের পর বছর ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৪ ও ১৬ ডিসেম্বর, ১৭ ও ২৬ মার্চ এর ব্যানারে ভুল বানানের 'শ্রদ্ধাঞ্জলী'র ক্ষেত্রেও একই অভিজ্ঞতা ঘটছে। খোদ বইমেলায় 'গীতাঞ্জলী' নিয়ে হাজির হচ্ছে নামকরা প্রকাশক! এর সাথে যুক্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহূত অভিনব সব বানান! অনলাইনে 'পাকিস্তানি ও ভারতীয় থ্রি-পিস' বিক্রেতা এবং রান্নার বয়ানকারীদের ভাষা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, অহেতুক ইংরেজি প্রীতি ও ভুল উচ্চারণের ভয়াবহ চিত্র! যথেষ্ট ইংরেজি না বললে যেন 'ভিউয়ার্স' জোটানোই মুশকিল!
প্রযুক্তির পৃথিবীতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বেড়েছে আরও এক অভিজ্ঞতা নিয়ে। 'একুশের স্বীকারোক্তি' কবিতায় শহীদ কাদরী যেমন লিখেছিলেন, 'যখন শত্রুকে গাল-মন্দ পাড়ি,/কিংবা অযথা চেঁচাই,/ আহদ্মাদে লাফিয়ে উঠে/বিছানায় গড়াই;/ মধ্যরাতে তেরাস্তায় দাঁড়িয়ে/সম্মিলিত কণ্ঠে চিৎকারে দিনে দিনে জমে ওঠা উষ্ফ্মাকে/অশুভ পেঁচক ভেবে উদ্বিগ্ন গৃহস্থের মতো/ সখেদে তাড়াই...' কিংবা ' ...কখনো সখনো রঙ্গমঞ্চের বাতি নিভে গেলে/ আঁধারের আড়াল থেকে যেসব অশ্নীল শব্দ ছুঁড়ে মারি,' তখনও কবির একান্ত আশ্রয় হয়ে ওঠে অ, আ, ক, খ। ... যোগাযোগ মাধ্যম নামের রঙ্গমঞ্চের বাতি কখনোই নেভে না। ঝকঝকে আলোতেই এখন চলে গালাগালের উন্মাদনা। আলোচিতদের (এখানে যুৎসই শব্দ হলো সেলিব্রিটি) নিয়ে মুখরোচক গুজবে, সেফাতউল্লাহর নতুন ভিডিওতে, ধর্ম বিষয়ে বিশেষ কোনো বক্তব্যে যে সব শব্দে মন্তব্য (পড়ূন কমেন্ট) লেখা হয় তার জন্যে আঁধারের দরকার পড়ে না কারও। এমনকি শব্দ ব্যবহার ছাড়াও মন্তব্যের বিকল্প হিসেবে যে সকল অশ্নীল ভঙ্গিমাযুক্ত ইমোজি ব্যবহার করা হয় সেটাও তো একটা ভাষা, সাংকেতিক ভাষা। আধুনিক তাত্ত্বিকরা হয়তো বলবেন, 'শ্নীল' ও 'অশ্নীল'-এর ধারণা আরোপিত। এটাও হয়তো সত্য। কিন্তু কার জন্য সত্য? কোন ব্যবহারকারীর জন্য সত্য? যে শিক্ষার্থী সৃজনশীল পরীক্ষায় দু/একটা শব্দ লিখে বাংলা বা ইংরেজি বিষয়ে এ প্লাস পেয়ে বসে আছে, সে তো সুযোগ পেলেই বলবে, সকল ভাষার ব্যাকরণ ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা উচিত। ছন্দ যে জানে সেই তো ভাঙতে পারে ছন্দের দেয়াল। অথচ দেয়াল না চিনেই যে দেয়ালটা ভাঙতে যায় তার হাতের হাতুড়িটাই ভয়ানক হয়ে ওঠে না কি!
১৯৯০-এর পর যারা 'ভাষায় এবার আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা চিহ্নিত করতে হবে' আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন তাদের আকাঙ্ক্ষা প্রাথমিকভাবে পূরণ হলেও আন্দোলনটি তাদের হাত ফসকে বেড়িয়ে গেছে। তাকে নিয়ন্ত্রণের উপায় আপাতত নেই। পরীক্ষার খাতাতে অনায়াসে লেখা হয় 'রবীন্দ্রনাথ + নজরুল', '১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু+আরও অনেকে নিহত হয়েছে', 'উপ্রের বর্ণনা অনুযায়ী', 'কলম্বাস আম্রিকা আবিস্কার করেছে'। তৃতীয় ও শেষ বাক্যটি খেয়াল করা যাক, কোথায় 'করেছে' আর 'করেছেন' ব্যবহূত হবে এর প্রয়োগ সম্পর্কেই বেশিরভাগের ধারণা নেই। অনায়াসে লিখছে, 'রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে।', 'সে (রবীন্দ্রনাথ) একদিন পদ্মায় বোটে বসে ছিল।' আঞ্চলিক উচ্চারণের প্রভাবে বানান ত্রুটি পূর্বেও ছিল এখন তা আরও বেড়েছে। যেহেতু 'ভাষায় এবার আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা চিহ্নিত করতে হবে' বিধায় ব্যবহারিক জীবনে প্রমিত উচ্চারণের হার কমেছে। ফলে, যা উচ্চারণ করা হয় বানানে তারই প্রতিফলন ঘটে। শুধু বানান নয়, যে কোনো উপস্থাপনাতেও। বন্ধুর আড্ডায় মুখর তরুণটিকে স্টেজে তুলে দিলে বা ক্যামেরার সামনে দাঁড় করালে থতমত রূপটি বেরিয়ে আসে। অথচ গ্লোবাল ইকোনমি বা মুক্তবাজার অর্থনীতির দুনিয়ায় রোজগারিতে টিকে থাকতে হলে 'প্রেজেন্টেশন আর্ট' এখন একটা বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের তরুণরা কি সেখানে পিছিয়ে আছে? না, নেই। প্রেজেন্টেশনটা যদি ইংরেজিতে দিতে হয় তবে আর তারা পিছিয়ে থাকে না। খুবই প্রাণবন্ত আধুনিক ইংরেজিতে প্রেজেন্টেশনে দক্ষ হয়ে উঠছে এদেশের তরুণরা। বিপত্তি ঘটে কেবল বাংলায়। 'ভাষায় এবার আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা চিহ্নিত করতে হবে' বিশ্বাসীরা যত অনায়াসে বাংলা ভাষার 'প্রমিত উচ্চারণ' ও 'প্রমিত বানানরীতি', এতগুলো শ (স, ষ) থাকার দরকার কি, ই-কার/ঈ-কার না থাকলে ক্ষতি কি ইত্যাদি অমান্য করার ব্যাপারে সোচ্চার ততটাই যত্নশীল 'আইইএলটিএস' বা 'টোয়েফেল' পরীক্ষার ব্যাপারে। আমেরিকান আর ব্রিটিশ বানান ও উচ্চারণের সূক্ষ্ণতম পার্থক্যগুলোও তাদের মুখস্থ হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের খেলোয়াড় যখন ক্যামেরার সামনে ভয়ে ভয়ে ভাঙা ইরেজি বলে, লজ্জা পায় দেশের দর্শক! গোলমাল হয় কেবল নিজের ভাষা নিয়ে!
বিগত কয়েক বছর ধরে এর চূড়ান্ত ফল পাওয়া যাচ্ছে ফেব্রুয়ারির বইমেলা শেষে মানসম্পন্ন বই বাছাই করতে গিয়ে। সংখ্যার হিসেবে বই প্রকাশের হার বাড়ছে ঠিকই কিন্তু বাড়েনি গুণগত মান। ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, সংস্কৃতি, ভূগোল বা জলবায়ু বিষয়ে বাংলায় লেখা মানসম্মত বই হাতে গোনা। এই সংকট সাহিত্যেও। অনুবাদেও। বাংলাদেশে সরকারি তো বটেই হু হু করে গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি বিভাগ থাকা সত্ত্বেও বাড়েনি ইংরেজিতে রচনা বা অনুবাদের সীমানা। ১৯৯০-এর পর প্রায় ত্রিশ বছর পার হয়ে যাচ্ছে অথচ সবখানেই হাতে গোনা ভরসার মানুষ। প্রযুক্তির কল্যাণে বাংলা ভাষার ব্যবহার বেড়েছে। মোবাইল ফোনের মেসেজে বাংলা ব্যবহার করা যায়। আছে গুগল ট্রান্সলেটর (যদিও প্রায়ই হাস্যকর অনুবাদ করে), অনলাইন বিজ্ঞাপন কিন্তু এটাও তো সত্যি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা অযত্ন আর অবহেলার ছাপ রয়ে যায় যেন। 'ভাষায় এবার আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা চিহ্নিত করতে' হলে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিতে হয়। সে জন্য ভাষা ব্যবহারের প্রতি যে ভালোবাসা বা সাধনার দরকার তার যথেষ্ট প্রমাণ তো এই ত্রিশ বছরে মেলেনি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নাটকগুলোর নামকরণে, খাবার ও পোশাকের দোকানের নামে, ব্যক্তিগত শব্দভাণ্ডারে... প্রতিদিন যা কিছু প্রকাশিত হচ্ছে তা কি ভাষার প্রতি ভালোবাসা না অবহেলা?
লেখক
প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক
- বিষয় :
- ভাষা :ভালোবাসা না অবহেলা?