ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

একুশে

ভাষাও কি ভেসে যাবে

ভাষাও কি ভেসে যাবে

হানিফ সংকেত

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ১২:০০

প্রযুক্তির এই স্বর্ণযুগে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কোথায় আমরা ভাষাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করব তা নয়, বরং উল্টো আমরা প্রযুক্তির অপব্যবহার করছি। বিশেষ করে দর্শক হাসানোর চেষ্টায় গণমাধ্যমে কিছু উদ্ভট ভাষার আমদানি করে দূষিত করা হচ্ছে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষাকে। আমাদের সর্বস্তরেই বিশেষ করে বই-পুস্তক এবং গল্প-সাহিত্যে প্রমিত রীতিই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ভাষা। তাই শুধু আড্ডা কিংবা অনানুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা ছাড়া সব ধরনের আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে যেমন বেতার, টিভি-সংবাদ পাঠ, উপস্থাপনা, আলোচনা অনুষ্ঠান, স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান, যে কোনো অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, অনুষ্ঠান ঘোষণা- এসব ক্ষেত্রে প্রমিত ভাষা ব্যবহার করা উচিত। হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও প্রমিত বাংলার পরিবর্তে অবলীলায় চলছে ইংরেজি ও হিন্দির সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত ভাষা। দিনে দিনে এই শব্দদূষণ অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়েই চলছে। আধুনিকতার নামে আমরা আমাদের ভাষার রূপ, পরিচয়, সৌন্দর্য বদলে ফেলছি। আমরা জানি টেলিভিশনের মূলমন্ত্র হচ্ছে- শিক্ষা, তথ্য ও বিনোদন। কিন্তু এখনকার টেলিভিশনে মানুষ এই তিনটি তো দূরের কথা একটিও যথার্থভাবে পায় না। খবর শুনতে গেলে উচ্চারণ ত্রুটির কারণে খবরটাও শ্রুতিমধুর হয় না। আজকালকার অধিকাংশ টিভি অনুষ্ঠানে উপস্থাপক উপস্থাপিকার হায়, হুই আর ওঁয়াও জাতীয় শব্দ প্রয়োগ শুধু শব্দদূষণ বা বিরক্তিকরই নয় বরং কানের এবং শরীরের জন্যও ক্ষতিকর।

এরা অনেকেই যে ভাষায় কথা বলছে তা না আঞ্চলিক, না প্রমিত। তাদের কাছে মামা হয়ে যাচ্ছে মাম্মা, মা হচ্ছে মম, বাবা হচ্ছে ড্যাড। উদ্ভট অঙ্গভঙ্গিতে ইঙ্গ-বঙ্গ ভাষার মিশ্রণ তুঙ্গে তুলে রঙ্গে-ঢঙ্গে যা উপস্থাপন করেন তা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক। আজকাল এফএম রেডিওতে কিছু শব্দ প্রায় নিয়মিত হয়ে গেছে। যেমন- সেন্ড করো, ফাটাফাটি ইভেন্ট, হায় লিসেনার্স, ইটস্‌ হট, লাভ ইউ, হায় ফেন্ডস্‌ এমনি অদ্ভুত সব শব্দ। এদের শব্দ প্রয়োগে মনে হয় রেডিও যারা শুনেন সবাই ওদের বন্ধু। ওদের বাবারাও যে রেডিওর শ্রোতা হতে পারে এটা বোধহয় এদের কল্পনাতেও আসে না। আর সে জন্যই এই জাতীয় এফএম অনেকেই শোনেন না। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় এক অদ্ভুত ভাষা ব্যবহার করা হয়। ইংরেজি অক্ষরে বাংলা উচ্চারণ। এখানে ভাষার বিকৃতি ছাড়াও রয়েছে বাংলা বিভিন্ন শব্দের অপ্রয়োগ। এর মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে আরও বিকৃত এবং হাস্যকর করা হচ্ছে। গণমাধ্যমের প্রভাবে যেমন তরুণ-তরুণীরা প্রভাবিত হচ্ছে, তেমনি ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে এর প্রচারে প্রসার ঘটছে দ্রুত। আমাদের টিভি মিডিয়ার কিছু কিছু তরুণ-তরুণী পাশ্চাত্যের চমক সর্বস্ব বিকৃতির মরীচিকার পেছনে ছুটে ভুলতে বসেছে নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। ভুলতে বসেছে নিজের শিকড়। অথচ শিল্প, সংস্কৃতি আমাদের অহংকার। তথাকথিত আধুনিকতার নামে ভাষার বিকৃতি কারোই কাম্য নয়।
ইদানীং টিভি নাটক এবং সিনেমায় বিকৃত আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার ও বিকৃতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিভিন্ন চ্যানেলে যেসব নাটক প্রচারিত হয় তার অধিকাংশ নাটকেই চরিত্রগুলো কোনো বিশেষ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। বলা হয় হাসির নাটক। এর ফলে কিছু কিছু নাটক আবার হাসির নাটক না হয়ে-হয়ে যায় হাস্যকর নাটক। আগে একটি বা দুটি নির্দিষ্ট চরিত্র নাটকে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলত। এখন সব চরিত্রই বলে। উদ্দেশ্য দর্শক হাসানো। কারণ প্রমিত ভাষায় কথা বলে হাসানো একটু কঠিন। অনেকেই আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগের দোহাই দিয়ে এই বিকৃতি চালাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, একটি বিশেষ অঞ্চলের ভাষাই সেখানকার প্রমিত ভাষা এবং মাতৃভাষা। তাই সবার সেই ভাষার প্রতি সম্মান দেখানো প্রয়োজন। যথাযথভাবে আঞ্চলিক ভাষার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি ভাষার একটি নির্দিষ্ট রূপ বা প্রকাশ ভঙ্গি রয়েছে। যেটাকে বজায় রেখে ভাষার প্রয়োগ করা উচিত। ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন এক ধরনের অপরাধ। এ ব্যাপারে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা আমাদের এই প্রিয় মাতৃভাষা পেয়েছি। পৃথিবীতে আর কোনো দেশেই ভাষার জন্য জীবন দিতে হয়নি। ভাষার মাস এলেই আমরা জেগে উঠি আর বাকি মাসগুলোয় যেন ঘুমিয়ে থাকি। এ মাসেই আমাদের ভাষার চেতনা জেগে ওঠে। অন্যান্য মাসে আমরা যেন ভুলে যাই আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি।
এমনকি আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় আমাদের ভাষা, স্বাধীনতা, নববর্ষ- সর্বোপরি আমাদের দেশাত্মবোধ নিয়ে কিছু মৌসুমি বিজ্ঞাপন দেখা যায়। যা ভাষার মাস, স্বাধীনতার মাস, বিজয়ের মাস কিংবা পহেলা বৈশাখে প্রচারিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি শুধু ফেব্রুয়ারি মাস এলেই ভাষার কথা বলব? নববর্ষে বাঙালি হবো কিংবা শুধু মার্চ কিংবা ডিসেম্বরেই আমাদের দেশাত্মবোধের চিত্র তুলে ধরব। সবকিছুকে ব্যবসা হিসেবে দেখাটা কি অন্যায় নয়?
এসব দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে- এদের তা বে ভাষাও কি ভেসে যাবে? ফেব্রুয়ারি এলে যারা গলা ফাটিয়ে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর কথা বলেন, যারা গাছে গাছে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ ঝুলিয়ে দেন, যারা টেলিভিশনে বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নিয়ে টক শো করেন এবং বাংলা ভাষা নিয়ে গভীর আলোচনা করেন তাদের অনেককেই ফেব্রুয়ারি ছাড়া অন্য মাসগুলোয় বাংলাভাষা নিয়ে আশাব্যঞ্জক কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায় না।
ইংরেজি ভাষা অবশ্যই আমাদের শিখতে হবে, জানতে হবে- তবে তা জ্ঞানার্জনের জন্য। কিন্তু আমাদের চিন্তা-চেতনা প্রকাশের মাধ্যম হওয়া উচিত বাংলা; যা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলিশ উচ্চারণের মাধ্যমে নয়, সঠিক উচ্চারণ ও প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাভাষার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে হবে আমাদেরই। আসলে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন সরকারি নীতিমালা এবং এর বাস্তবায়নে প্রয়োজন কঠিন পদক্ষেপ ও কার্যকরী উদ্যোগ।
লেখক
গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×