একুশে
মিডিয়ায় বাংলা ভাষা
মোরশেদুল ইসলাম
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ১২:০০
প্রমিত ভাষার ব্যবহার একটি দেশের যে কোনো মাধ্যমে জরুরি। আর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আমরা যারা সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছি, আদতে এ বিষয়টি নিয়ে কতটা ভাবছি সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বেশ কয়েক বছর ধরেই মিডিয়ায় বেশ কিছু মানুষ বলে আসছিলেন, ভাষার ব্যবহার যথাযথভাবে হচ্ছে না। অনেকের দাবি, নিম্নমানের কিংবা কুরুচিপূর্ণ শব্দের ব্যবহারে ছেয়ে গেছে টেলিভিশন প্রযোজনাগুলোয়। মাঝে মধ্যে ভাষার বিকৃতি নিয়ে বিভিন্ন দাবি উঠলেও এ সমস্যার পরিত্রাণ বিরাট আকারে চোখে পড়েনি। কারণ ড্রয়িংরুম থেকে শুরু হয় এ বিকৃতি। পথে নেমে কান পাতলে শোনা যায় আরও শত রকমের বিকৃত বাংলা উচ্চারণ। একটি দেশের প্রজন্মের বড় একটি অংশ শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে কথা বলতে পারে না। এদের অনেকের কাছেই ইংরেজি ও বাংলার মিশ্রণে তৈরি নতুন ধরনের ভাষা প্রিয় হয়ে উঠছে। আর এই নতুন ভাষা প্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে মিডিয়া অঙ্গনের মানুষ দায় এড়াতে পারেন না। বরং এ দায় এর অনেকখানি অংশ সংস্কৃত অঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তির ওপর বেশি পড়ে।
বর্তমানে নাটক ইন্ডাস্ট্রিতে ভাষা বিকৃতি বিষয়টি বড় আকারে চোখে পড়ছে। ইদানীং বেশিরভাগ নাটকেই আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করা হচ্ছে। হয়তো জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য এমনটা বেশি হচ্ছে। কিন্তু আগেও তো অনেক নাটক নির্মিত হয়েছে। অনেকগুলো আবার শুধু জনপ্রিয় নয়, কালজয়ীও হয়েছে। আঞ্চলিক ভাষা কিংবা চটুল সংলাপের কয়টি নাটক কালজয়ী হয়েছে, তা আমার জানা নেই। টিভি চ্যানেল বা ইউটিউবের জন্য নির্মিত নাটকের সেন্সর না থাকায় নির্মাতারা কোনো ধরনের বিচার-বিবেচনা ছাড়াই উদ্ভট নাটক বানিয়ে চলেছেন। আসলে এমন ঘরানার দুই-একটি নাটক জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এখন সবাই এই স্রোতে গা ভাসিয়েছেন। বিশেষ করে অনলাইনে দর্শকদের টোপ গেলাতেই এমন নাটক নির্মাণ করছেন। এসব নাটকের নির্মাতাদের তালিকায় সব কাতারের নির্মাতাই আছেন। টিভি চ্যানেলগুলোয় প্রিভিউ বোর্ড থাকায় সেখানে অশ্নীল এবং কুরুচিপূর্ণ অকথ্য গালাগালে সয়লাব নাটক প্রচার সম্ভব না হলেও ভাষাকে বিকৃত করে প্রচার হচ্ছে। আবার ইউটিউবে প্রিভিউ বোর্ড না থাকায় সেখানকার নাটকে প্রায়ই অশ্নীল বাক্য প্রয়োগের ছড়াছড়ি চলছে। এ ছাড়া ইদানীং বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়ে জানতে পারলাম, স্ট্ক্রিপ্ট ছাড়াই নাকি নাটক নির্মাণ হচ্ছে। তাহলে কি মনে যখন যা আসে, তাই ক্যামেরার সামনে বলা হয়! বেশ কিছু নাটক দেখলে তাই মনে হয়। একটি সফল প্রযোজনার অর্ধেক সাফল্য নির্ভর করে ভালো স্ট্ক্রিপ্ট ও সংলাপের ওপর। নিম্নমানের সংলাপ যেমন প্রযোজনার মান কমায়, ঠিক তেমনি ভাষার দূষণও ছড়ায়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম সে দূষণে হচ্ছে আক্রান্ত; যা দিনকে দিন আরও মহামারি আকার ধারণ করছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমরা যে কোনো মাধ্যমে যা-ই করি না কেন, সেখানে শুদ্ধরূপে প্রমিত বাংলার ব্যবহার থাকা উচিত। নাটক-সিনেমার সংলাপ লিখতে গেলেও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। আমি মনে করি, নাটক-সিনেমায় যারা অশালীন ভাষা ব্যবহার করছেন তারা ভুল করছেন। এটা অনৈতিক।
অশালীন ভাষার ব্যবহার শুধু নাটকে নয়, গানেও হচ্ছে। আর এসব প্রচার হচ্ছে ইউটিউব চ্যানেলে, টিভিতে নয়। রাস্তার অলিতে-গলিতে হাঁটতে গেলেও কুরুচিপূর্ণ ভাষার বিভিন্ন গান কানে আসে। দীর্ঘ সংগ্রাম আর রক্ত ঝরিয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার পেয়েছি আমরা। বিষয়টি আমাদের জন্য লজ্জার। আমার মতে, শুধু নাটকের অশালীন ভাষা নিয়ে নয়, গানের অশালীন ভাষা নিয়েও কথা বলা উচিত।
বিশ্বায়ন, আকাশ সংস্কৃতি, ডিজিটাইজেশনের কারণে ইংরেজির অধিক ব্যবহারের প্রভাবে মাতৃভাষা প্রবহমানতা হারাচ্ছে। তার ওপর আছে বিদেশি ভাষার আগ্রাসন। আজকাল বেতার-টিভি চালু করলেই শোনা যায় 'হ্যালো লিসেনার্স', 'হ্যালো ভিউয়ার্স'। তরুণদের মুখে মুখে 'আবার জিগায়', 'খাইলেই দিলখোশ', 'এক্সট্রা খাতির', 'তোর বেইল নাই' ইত্যাদি নানান ভাষার ব্যবহার। আবার নাটকের নাম- 'বেড সিন', 'ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাকা', 'চুটকি ভাণ্ডার', 'সেলিব্রেটি কাউ', 'ফালতু', 'লেডি কিলার', 'ড্যাশিং গার্লফ্রেন্ড', 'বংশগত পাগল', 'চ্যাতা কাশেম', 'ছ্যাঁছড়া জামাই', 'প্রোটেকশন' ইত্যাদি। তরুণ প্রজন্মের অনেকে যে ভাষা ব্যবহার করছে তা না আঞ্চলিক, না প্রমিত। তারা মামাকে 'মাম্মা'; রিকশাওয়ালা ও বাসচালককেও মাম্মা বলে সম্বোধন করে। এভাবেই বাংলা ভাষার সঙ্গে ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ফার্সির মিশ্রণ চলছে। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে এ রকম নানা শব্দ ঢুকে বাংলা ভাষাকে দূষিত করছে, বিকৃত করছে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন, নাটক বা চলচ্চিত্রে 'জগাখিচুড়ি' ভাষার ব্যবহার মূল ভাষায় প্রভাব ফেলছে। আবার বেতারে 'জকি' নামের আরেকটি চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে। এই চরিত্র ভাষার বিকৃৃতিতে নজির দেখাচ্ছে। গণমাধ্যমের প্রভাবে তরুণরা প্রভাবিত হচ্ছে। ভাষা বিকৃতির নতুন ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটারে। আমার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে ভাষা বিকৃতি তুলনামূলক কম হচ্ছে। তবে একটা সময় সিনেমায় ভাষা বিকৃতির অভিযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে অশ্নীল যুগের সিনেমার সময়ে- এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছিল। পরবর্তী সময়ে এ সমস্যা মোটামুটি ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছে সিনে ইন্ডাস্ট্রি।
যে কোনো প্রযোজনার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার হতে পারে। যদি তা আরোপিত হয় তখনই তা দৃষ্টিকটু দেখায়; যা বর্তমানে বিভিন্ন মাধ্যমে দেখা যায়। আমরা সবাই জীবনঘনিষ্ঠ প্রযোজনা নির্মাণের কথা বলে আসছি। কিন্তু একটি প্রযোজনায় বাস্তব জীবনের কতটুকু অংশ আমাদের দেখানো উচিত- সেটি অবশ্যই মাথায় রাখা প্রয়োজন।
লেখক
চলচ্চিত্র পরিচালক
বর্তমানে নাটক ইন্ডাস্ট্রিতে ভাষা বিকৃতি বিষয়টি বড় আকারে চোখে পড়ছে। ইদানীং বেশিরভাগ নাটকেই আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করা হচ্ছে। হয়তো জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য এমনটা বেশি হচ্ছে। কিন্তু আগেও তো অনেক নাটক নির্মিত হয়েছে। অনেকগুলো আবার শুধু জনপ্রিয় নয়, কালজয়ীও হয়েছে। আঞ্চলিক ভাষা কিংবা চটুল সংলাপের কয়টি নাটক কালজয়ী হয়েছে, তা আমার জানা নেই। টিভি চ্যানেল বা ইউটিউবের জন্য নির্মিত নাটকের সেন্সর না থাকায় নির্মাতারা কোনো ধরনের বিচার-বিবেচনা ছাড়াই উদ্ভট নাটক বানিয়ে চলেছেন। আসলে এমন ঘরানার দুই-একটি নাটক জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এখন সবাই এই স্রোতে গা ভাসিয়েছেন। বিশেষ করে অনলাইনে দর্শকদের টোপ গেলাতেই এমন নাটক নির্মাণ করছেন। এসব নাটকের নির্মাতাদের তালিকায় সব কাতারের নির্মাতাই আছেন। টিভি চ্যানেলগুলোয় প্রিভিউ বোর্ড থাকায় সেখানে অশ্নীল এবং কুরুচিপূর্ণ অকথ্য গালাগালে সয়লাব নাটক প্রচার সম্ভব না হলেও ভাষাকে বিকৃত করে প্রচার হচ্ছে। আবার ইউটিউবে প্রিভিউ বোর্ড না থাকায় সেখানকার নাটকে প্রায়ই অশ্নীল বাক্য প্রয়োগের ছড়াছড়ি চলছে। এ ছাড়া ইদানীং বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়ে জানতে পারলাম, স্ট্ক্রিপ্ট ছাড়াই নাকি নাটক নির্মাণ হচ্ছে। তাহলে কি মনে যখন যা আসে, তাই ক্যামেরার সামনে বলা হয়! বেশ কিছু নাটক দেখলে তাই মনে হয়। একটি সফল প্রযোজনার অর্ধেক সাফল্য নির্ভর করে ভালো স্ট্ক্রিপ্ট ও সংলাপের ওপর। নিম্নমানের সংলাপ যেমন প্রযোজনার মান কমায়, ঠিক তেমনি ভাষার দূষণও ছড়ায়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম সে দূষণে হচ্ছে আক্রান্ত; যা দিনকে দিন আরও মহামারি আকার ধারণ করছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমরা যে কোনো মাধ্যমে যা-ই করি না কেন, সেখানে শুদ্ধরূপে প্রমিত বাংলার ব্যবহার থাকা উচিত। নাটক-সিনেমার সংলাপ লিখতে গেলেও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। আমি মনে করি, নাটক-সিনেমায় যারা অশালীন ভাষা ব্যবহার করছেন তারা ভুল করছেন। এটা অনৈতিক।
অশালীন ভাষার ব্যবহার শুধু নাটকে নয়, গানেও হচ্ছে। আর এসব প্রচার হচ্ছে ইউটিউব চ্যানেলে, টিভিতে নয়। রাস্তার অলিতে-গলিতে হাঁটতে গেলেও কুরুচিপূর্ণ ভাষার বিভিন্ন গান কানে আসে। দীর্ঘ সংগ্রাম আর রক্ত ঝরিয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার পেয়েছি আমরা। বিষয়টি আমাদের জন্য লজ্জার। আমার মতে, শুধু নাটকের অশালীন ভাষা নিয়ে নয়, গানের অশালীন ভাষা নিয়েও কথা বলা উচিত।
বিশ্বায়ন, আকাশ সংস্কৃতি, ডিজিটাইজেশনের কারণে ইংরেজির অধিক ব্যবহারের প্রভাবে মাতৃভাষা প্রবহমানতা হারাচ্ছে। তার ওপর আছে বিদেশি ভাষার আগ্রাসন। আজকাল বেতার-টিভি চালু করলেই শোনা যায় 'হ্যালো লিসেনার্স', 'হ্যালো ভিউয়ার্স'। তরুণদের মুখে মুখে 'আবার জিগায়', 'খাইলেই দিলখোশ', 'এক্সট্রা খাতির', 'তোর বেইল নাই' ইত্যাদি নানান ভাষার ব্যবহার। আবার নাটকের নাম- 'বেড সিন', 'ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাকা', 'চুটকি ভাণ্ডার', 'সেলিব্রেটি কাউ', 'ফালতু', 'লেডি কিলার', 'ড্যাশিং গার্লফ্রেন্ড', 'বংশগত পাগল', 'চ্যাতা কাশেম', 'ছ্যাঁছড়া জামাই', 'প্রোটেকশন' ইত্যাদি। তরুণ প্রজন্মের অনেকে যে ভাষা ব্যবহার করছে তা না আঞ্চলিক, না প্রমিত। তারা মামাকে 'মাম্মা'; রিকশাওয়ালা ও বাসচালককেও মাম্মা বলে সম্বোধন করে। এভাবেই বাংলা ভাষার সঙ্গে ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ফার্সির মিশ্রণ চলছে। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে এ রকম নানা শব্দ ঢুকে বাংলা ভাষাকে দূষিত করছে, বিকৃত করছে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন, নাটক বা চলচ্চিত্রে 'জগাখিচুড়ি' ভাষার ব্যবহার মূল ভাষায় প্রভাব ফেলছে। আবার বেতারে 'জকি' নামের আরেকটি চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে। এই চরিত্র ভাষার বিকৃৃতিতে নজির দেখাচ্ছে। গণমাধ্যমের প্রভাবে তরুণরা প্রভাবিত হচ্ছে। ভাষা বিকৃতির নতুন ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটারে। আমার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে ভাষা বিকৃতি তুলনামূলক কম হচ্ছে। তবে একটা সময় সিনেমায় ভাষা বিকৃতির অভিযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে অশ্নীল যুগের সিনেমার সময়ে- এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছিল। পরবর্তী সময়ে এ সমস্যা মোটামুটি ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছে সিনে ইন্ডাস্ট্রি।
যে কোনো প্রযোজনার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার হতে পারে। যদি তা আরোপিত হয় তখনই তা দৃষ্টিকটু দেখায়; যা বর্তমানে বিভিন্ন মাধ্যমে দেখা যায়। আমরা সবাই জীবনঘনিষ্ঠ প্রযোজনা নির্মাণের কথা বলে আসছি। কিন্তু একটি প্রযোজনায় বাস্তব জীবনের কতটুকু অংশ আমাদের দেখানো উচিত- সেটি অবশ্যই মাথায় রাখা প্রয়োজন।
লেখক
চলচ্চিত্র পরিচালক
- বিষয় :
- মিডিয়ায় বাংলা ভাষা