একুশে
ভাষাতে দূষণ-ফ্যুশন (Fusion) সংক্রান্ত দুশ্চিন্তা
মানস চৌধুরী
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ১২:০০
ভাষার চর্চা ও কাঠামোর প্রশ্নটা আসলে শাসনপ্রণালি ও ক্ষমতা কাঠামোর প্রসঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ রকম সরল অথচ স্পষ্ট একটা কথা ঘোষণা অত্যন্ত বিপদ বয়ে আনতে পারে, অন্তত ঢাকা শহরে। একদল শ্রোতা এর অর্থ করে বসেন সংসদে থাকা, ও যেতে ইচ্ছুক, রাজনৈতিক দলগুলোর সাপেক্ষে। এর থেকে সূক্ষ্ণ অর্থ যাঁরা করতে আগ্রহী, তাঁরাও বড়জোর জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখেন। আরও সূক্ষ্ণ করে যাঁরা দেখতে রাজি আছেন, তাঁরাও 'বড়লোক'-এর ভাষা ব্যবহার হিসেবে বড়জোর দেখতে পারেন। কিন্তু আমি স্বীকার করব যে, শেষোক্তটাতে কোনো মতে আমার কাজ চলে যাবে। যদিও আমার ভাবার জায়গা আরও খানিকটা বিশিষ্ট ও সাধারণ। ভাষার মেজাজ-মর্জি, হালচাল, গড়ন-শৈলী নেহায়েতই প্রতিষ্ঠানের মাথাব্যথার বিষয়। আর এর সচলতা নিশ্চিন্তে আমমানুষের মুখে-মুখে বিরাজমান থাকে। এই সারসত্য আমার ভাবার জায়গা, তাই আমার দুর্ভাবনা কম।
আমি মেহেরপুরের একটা অনাল্ফম্নী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম। যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, সম্ভবত, মগফুর স্যারের মেয়ে আচানক এক সুপারহিরো হয়ে গেল। সেটা অন্য স্কুলের ঘটনা। তবুও তার সেই নায়কোচিত কর্মকাণ্ডের পর আমার মনে পড়ে, অনেকের মতোই আমিও ওকে চিনবার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেছিলাম। চেনা হয়েছিল কিনা এত বছর পর আর মনে নেই। জানা যায়, অঙ্কের ক্লাসে ও তখন ক্লাস থ্রির ছাত্রী, শিক্ষক তখন এক টাকায় ১০টি কলা পাওয়া গেলে তিন টাকায় কয়টি কলা পাওয়া যাবে ধরনের একটা প্রশ্ন করেছিলেন। কলার নাম ঠটে। মেহেরপুরের উচ্চারণে সেটা 'ঠইটি'। এটাও জানা যায়, সেই প্রস্তাবনার পর সেই নায়িকা, ক্লাস থ্রিতে বসেই, বার কয়েক শিক্ষককে ঝালাই করিয়ে নেয় যে টাকায় দশটাই তিনি প্রস্তাব করেছেন কিনা। বলাই বাহুল্য, ১৯৭৭-৭৮-এর বাংলাদেশেও কোনো কলাই টাকায় দশটা পাওয়া যেত না, ঠটে হলেও। ফলে শিক্ষকের প্রস্তাব বদল করার পর্যাপ্ত গণতান্ত্রিক সুযোগ সেই বিচক্ষণ শিশুটি দিয়েছিল। তো শিক্ষক যেহেতু গণিতের নিয়মেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছিলেন, সমাজ বা বাজার ব্যবস্থার বাস্তবতা নিয়ে খুব কম আগ্রহী ছিলেন, সেই মেয়ে এরপর এ রকম একটি প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে, গণিতের হিসাব ছেড়ে, শিক্ষকের কোনো প্রত্যঙ্গ দিয়ে কলা বিক্রেতা এই দামে কলা গুঁজে দিতে পারেন সে রকম একটা সম্ভাবনা ঘোষণা করে। শোনা যায়, সেই সম্ভাবনার সঙ্গে মানানসই দৃশ্য প্রস্তাব করতেও সে ভোলে না। স্তম্ভিত সেই শিক্ষক এরপর কী করেছিলেন সেই গল্প আমাদের কানে এসে থাকলেও কেউ তা মনে রাখেনি। সকলেই, মানে অনেকেই, এই দুর্দান্ত সমাজ বিশ্নেষক শিশুর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। এমনকি আমরাও, অন্য শিশুরা। আম সমাজে ভাষার জোর এমনই। সেখানে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম চলে না।
দুই
প্রতিষ্ঠানের নিয়ম তাহলে কাদের জন্য চলে? কাদের সেই নিয়মের শাসনে থাকতে হয়? কারাই বা নিয়মের বদলে, কিংবা নিয়মরক্ষা হচ্ছে না বলে, মুষড়ে পড়েন? ভাষার ক্ষেত্রে সেসব নিয়ম কি কেবলই 'প্রমিত উচ্চারণের' প্রসঙ্গ? অব্যয়, সর্বনাম, নামপদের অসীম ভান্ডার আর ক্রিয়াপদের রূপের প্রসঙ্গ? সহি আচরণের সুস্পষ্ট শাসনবিধিও নয়? এসব জ্ঞানগর্ভ জিজ্ঞাসার বিপরীতে পুস্তকের উদ্ধৃতি আর তত্ত্বসারময় আলাপের রেওয়াজ আছে। সেটাই দস্তুর। কিন্তু আমি এখানেও আটপৌরে অভিজ্ঞতাকেই আনব। আমি সে সবেই ন্যায্য সব উত্তর খুঁজে পাই।
স্কুলজীবনে দুটোই বেতপ্রহারের কথা আমি মনে করতে পারি। খুব গোঁয়ার ধরনের শিক্ষক কখনও কাউকে কিল-ঘুষি মেরে থাকলেও স্কুলে বেতের বাড়িই সাধারণ প্রচলিত পিটানির পথ। ফলে আমার বেতপ্রহার দুটোই কেবল সামগ্রিক প্রহার, ছাত্র হিসেবে। তার মধ্যে একটা ছিল সপ্তম শ্রেণিতে থাকাকালীন। হেডমাস্টার তাঁর রুমে ডেকে এনেছিলেন আমাকে। আমি স্কুলকামাই দিয়ে দরখাস্ত দিয়েছিলাম একটা। বছরের কয়েক দিন জ্বরের কারণে আমার কামাই হতো। একই স্কুলের কখনও-কামাই-না-দেওয়া শিক্ষক আমার বাবাকেও ডেকে আনা হলো হেডমাস্টারের ঘরে। আমরা দু'জন দুই জায়গা থেকে বিহ্বল এসে আবিস্কার করি আমরা দু'জনই অতিথি। হেডমাস্টার মূলত বাংলার শিক্ষক বাবাকে আমার দরখাস্তটা এগিয়ে দিয়ে জানতে চাইলেন এই দরখাস্তটা তিনি দেখেছেন কিনা বা খসড়া করে দিয়েছিলেন কিনা। সহকর্মীকে হেডমাস্টার বসতেও বলেননি, হয়তো শাস্তির মুডখানা সঠিকভাবে ধরে রাখার জন্য। আমাকে বসতে বলার তো প্রশ্নই নেই। বাবা দরখাস্তটা পড়তে পড়তে নিচু গলায় জানালেন যে, দরখাস্ত সাধারণত আমি নিজেই লিখি। বাস্তবিকই, আমি ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই নানানজনের দরখাস্ত লিখে দিই, এমনকি উঁচু ক্লাসের ছাত্রদেরগুলোও। দরখাস্তটা পড়ে বাবা আবারও মৃদুস্বরে জানান দিলেন তিনি কোনো ভুল দেখতে পাচ্ছেন না। হেডমাস্টার তখন যারপরনাই বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন 'অধীনের বিনীত নিবেদন' কথাটি নাই কেন। এর আগ পর্যন্ত আমি আমার অপরাধ বোঝারই সুযোগ পাইনি। আমার বাবাও যখন বুঝলেন অপরাধখানা, হয়তো তাঁর সামনে আমাকে মার খেতে দেখতে চান না বলেই, তিনি অনুমতি চেয়ে এবং উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেলেন। এর কিছুদিন আগেই আমি বাসায় বসে বাবার সঙ্গে নানান রকম গল্পগুজবের মধ্যে 'অধীনের বিনীত নিবেদন' কথাটা যে অহেতু তা দাবি করি। আমার নিরীহ বাবা কোনো যুক্তি দিয়েই এটার হেতু প্রমাণ করতে না পেরে মেনে নিয়েছিলেন।
বাবা চলে যাওয়ার পর, হেডমাস্টার তখন আমাকে কাছে টেনে দুই হাতের তালুতে নিয়মমাফিক বেত পেটালেন। বাবার চলে যাওয়ার 'ঔদ্ধত্যে'র কারণে বাড়তি কয়েকটা পিটানি আমি পেয়েছিলাম কিনা, এত বছর পর তা আর আমার মনে নেই। অন্য উদাহরণটি একজন শ্রেণিশিক্ষকের তরফে পাওয়া এবং কাছাকাছি। নেহায়েত অহেতু পুনরুল্লেখের সম্ভাবনায় সেটা বিশদ করছি না। গল্পগুলো এমন এক সময়কালের যখন আমাকে এমনকি আদব-কায়দাহীন সাব্যস্ত করতে পরম শত্রুরও কষ্ট হতো। আমি একটা আগাপাশতলা ভ্যাবলা বাচ্চা ছিলাম। এই যে দরখাস্তের উদাহরণটা, এখানে দূষণের কোনো ব্যাপার তো নেই! এটা নিছকই শাসনবিধির প্রশ্ন। ভাষা আগাগোড়া তাই।
তিন
আমি তথাকথিত প্রমিত বাংলায় বচন ছাড়ি বলে আমাকে কলকাতীয় বলার দুর্যোগ আছে; 'রুচিশীল' বর্গের ওকালতি করব বলে ধরে নেওয়ার দুর্ঘট আছে; বাংলা ভাষার আনুষ্ঠানিক রূপের ক্ষেত্রে শক্তপোক্ত নিয়মানুগ তথা 'প্রমিতপক্ষীয়' ভাবার চল আছে। কীভাবে আমার বচন প্রমিতগন্ধী হলো সেটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আলাপ; আবার এখানে প্রাসঙ্গিক হতেও পারে। পরিণতকালে আমার ধারণা হয়েছে যে, আমার রাজশাহীর প্রভাবযুক্ত পিরোজপুরী উচ্চারণের বাবা আর উপন্যাস পড়া জিভে বরগুনার মায়ের সঙ্গে, প্রতিটা ভোরবেলা বিবিসি ও আকাশবাণীর বাধ্যতামূলক সেবন- এসবের অবধারিত ফল হয়েছে বিবিসিকে আমার জিহ্বায় নিয়ে আসা। সেটাকে দুর্ঘটনা বা মঙ্গলময়তা কোনোভাবেই আমি আর দেখি না। যা হোক, এটা বলা অতিরঞ্জন হবে না যে, আমার উচ্চারণ বা কথনরীতিতে অন্ত্যজ মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশার সংকটকেও বড় করে দেখা যেতে পারে। বাস্তবে, আমার তেমন কোনো ঝামেলা যে হয় না সেটা আরেক প্রসঙ্গ। এসব দুর্ঘট-দুর্যোগ থাকা সত্ত্বেও আমার ধরনের ভাষা (চর্চা) প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছিলাম সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায়, অননুমিত এক পক্ষ থেকে।
ঢাকায় বর্তমানে অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান ও সুবক্তা এক চিন্তক সবে তখন মার্কিন মুল্লুক থেকে এসেছেন। সেদিন তাঁর এক বক্তৃতা ছিল, সেটাই আমি শুনতে গেছি। তুমুল বৃষ্টির কারণে বক্তৃতা-উত্তরকালে বক্তৃতা-ভবনের বারান্দায় সবাই ঠাসা দাঁড়িয়ে। তিনি সেখানে, হয়তো একটা আলাপ তুলবার ইচ্ছাতেই, জানতে চাইলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি প্রশ্ন, যে দুটো সম্পর্কিত হলেও একত্র করতে পারা বেশ ক্রোধ বা বিদ্বেষের কাজ বটে। একটি প্রশ্ন ছিল এই যে, অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ভাষা আমি বুঝি কিনা। এই প্রশ্নের অনুমানটি ছিল এই যে, আমি অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের 'অনুগত' (আমি তা কারোরই নই, বা ছিলাম না কোনোকালে)। আর বিশদ টীকাটি এই ছিল যে ওঁর ভাষা অবোধগম্য। দ্বিতীয় প্রশ্নটি এই ছিল, সমাজ নিরীক্ষণ নামক পত্রিকাটি যে বাংলা ভাষাকে 'পচিয়ে' দিচ্ছে সে বিষয়ে আমি একমত কিনা। পাঠকের জানা দরকার, পড়তে পারে যে পত্রিকাটি খোদ জাহাঙ্গীরই এযাবৎকাল সম্পাদনা করে আসছেন (অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের বর্তমান স্বাস্থ্যদশায় মনে হয় না যে, আর পারবেন)। প্রজ্ঞাবান সেই সহকর্মীর প্রশ্নের উত্তরে আমি কী কী বলেছিলাম তা এখানে অত গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এমনকি চুলচেরা বিচারে তাঁকে কাঠগড়ায় তোলাও আমার বিশেষ উদ্দেশ্য নয়। বরং এমনকি প্রতিষ্ঠানপ্রিয় মধ্যবিত্তের কাঠামোগত ভাষাচর্চার মধ্যেও শৈলী ও কারিগরি নিয়ে, ভঙ্গি ও বিন্যাস নিয়ে, কীভাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভাষাচর্চাকারগণ পরস্পরকে অসহিষ্ণুভাবে মানদণ্ড চাপিয়ে দিতে থাকেন- তার একটা প্রামাণ্য হিসেবে এই কাহিনিখানা উল্লেখ করলাম। একটা কোনো বিশেষ পত্রিকা ভাষাকে 'পচিয়ে' দেওয়ার সামর্থ্য রাখে না, এটা সাধারণ জ্ঞানের প্রসঙ্গ। দৈনিক পত্রিকার প্রারম্ভিক কালে, কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক বাংলার প্রারম্ভিককালে তবু কোনো একটি বিশেষ পত্রিকার প্রভাবন-সামর্থ্য নিয়ে গুরুতর উপলব্ধি করার সুযোগ ছিল। কিন্তু এক্ষণে বসে এটা না লক্ষ্য করার কোনোই কারণ নেই যে, খ্যাত-অখ্যাত, দৈনিক-কালিক সকল পত্রিকাই সংমিশ্রিত, বহুশৈলীধারী। ফলে অভিযোগটাকে দেখতে হবে অপছন্দ আর বৈরিতা দিয়ে। পাঠকের মনে পড়বে মধ্যবিত্ত চিন্তক বর্গের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধেই আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগের কারণে অভিযোগ করা হয়ে থেকেছে। বিপরীতে অধিক তৎসম-ঘেঁষা থাকার অভিযোগও খুব অচেনা নয়। বাংলাতে ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে প্রয়োগ করতে থাকা নিয়ে নানাবিধ ও জটিল পক্ষ ও আলোচনা আছে। সেটাকে আপাতত স্বতন্ত্র রাখছি। যদি ধরে নিই আজকের পাঠক, কিংবা অধুনা ভাষায় 'দূষণ' প্রসঙ্গে আলাপ-দুশ্চিন্তাতে অংশগ্রহণকারিগণ মূলত ভাষায় 'অনাগরিক' 'অরুচিকর' শব্দমালা (কিংবা ভঙ্গি, কিংবা বাক্যবিন্যাস) নিয়ে চিন্তিত, তাহলে ধরে নেওয়াটা খুব একটা ভুল হবে না। আমি সেসবের মধ্যে আরবি-ফারসি-তৎসম-ইংরাজি পদমালার প্রসঙ্গ ইচ্ছে করেই তুলেছি। এসব পরিস্থিতি দূষণের প্রশ্নের থেকেও ভীষণের প্রশ্ন বড় এখানে। কে কার ওপর কী ভীষণ বিধানের ছড়ি ঘোরাবেন তার চর্চায় স্বশ্রেণি বা স্বগোষ্ঠীও রেয়াত পান না। অন্য শ্রেণি বা গোষ্ঠীর দশা তো দূরের আলাপ!
চার
'প্রমিত বাংলা' বলতে সাধারণত উচ্চারণের ইঙ্গিত করা হলেও, আজকের আলাপে তা ভাষার আরও গাঠনিক দিকে মনোযোগী বলেই মনে হচ্ছে। 'শুদ্ধ বাংলা' শব্দযুগলেও সেই একই ঝামেলাটা আছে। কিন্তু সে যাই হোক, বিধান মেনে ভাষা চর্চার গুরুত্ব অবশ্যই আছে। ব্যাকরণের বইগুলো না হলে আমাদের পড়তে হলো কেন! আমার বলার দুয়েকটা জায়গার একটা হলো এই যে দরকারটা গভীরভাবে শিক্ষিত শ্রেণির একান্ত। আরও নিশ্চিত করে বললে, চাকরিজীবী শ্রেণির। এর বাইরে যে গরিব আর মহাধনপতিবৃন্দ আছেন তাঁদের কারও জন্যই এই বিধানমাফিক ভাষা এত গুরুত্বপূর্ণ কোনো কালে ছিল না। গরিবদের এমনকি পাত্তা দেওয়ারও দরকার পড়ে না ভাষার বিধানমালা। সহিহ্ বা শুদ্ধ উচ্চারণ রীতি, 'মানসম্পন্ন' নামপদ, কিংবা 'শ্রুতিমধুর' ক্রিয়াপদ। ইত্যাদি। তবে আমার আরেকটা গুরুতর বিষয় বলার আছে।
যেকালে, শর্তাদির মধ্যে ও পরিপ্রেক্ষিতে ভাষার অভিভাবক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে, আমাদের এলাকায় যেমন, সারা বিশ্বেই, সেই শর্তগুলো আর পরিপ্রেক্ষিতের গুরুতর বদল হয়েছে। এই বদলটিকে মনোযোগ দিয়ে পাঠ করার জন্য আমাদের বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়বে না। যখন ভাষার উৎপাদন লিপিমুখী হয়ে উঠেছে, যখন আধুনিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হচ্ছে, যখন লিপিসমূহ জাতির গঠনের ভিত্তিভূমি তৈরি করছে, তখন সেই লিপিমালাকে (হ্যাঁ, মোটের ওপর লিখিত ভাষারাজিই) বিধিবদ্ধকরণের দায় ও প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। ভাষার কাঠামো ও রূপকে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া 'শুদ্ধ' ভাষার প্রশ্ন যতটা, তার থেকে 'শুদ্ধ' জাতির প্রশ্ন আরও অনেক প্রবলভাবে। সেই ঐতিহাসিক শর্তগুলো তো নেই। আমার বলবার মানে এই করতে চাইছি না আমি যে, জাতীয়তাবাদ তার শক্তি হারিয়েছে; বরং পরিস্থিতি গুণগতভাবেই বোধহয় উল্টা। কিন্তু সেই 'শুদ্ধ' জাতীয়তাবাদের দাসত্ব করতে কে কে চাইছেন না বা চাইবেন না তার ব্যাকরণও তৈরি করা হয়েছে ইতিহাসে। এই প্রসঙ্গটি যদি রাজনৈতিক-দার্শনিক ভিত্তিভূমির হয়ে থাকে, তাহলে প্রাযুক্তিক আরেকটি দিক আছে। সেটা অত্যন্ত গুরুতর মাত্রার, আর আমার বিবেচনাতে সেটাকে আমলে এনে আলাপ-আলোচনার রেওয়াজ খুবই কম। যদি আমলে আনতেন, তাহলে আমার সাহিত্যিক- লেখক বন্ধুরা কোনো এককালে 'ধ্রুপদী' বা 'অমর' কিছু লিখে ফেলবার বাসনায় ব্যাকুল থাকতেন না।
এই কাল এমন এক কাল যখন ভাষা উৎপাদন নানানভাবে, নানান সূত্রে, নানান ক্ষেত্রে লাগাতার হয়ে চলেছে। এখানে ভাষা উৎপাদন বলতে কেবল অর্থের নয়া নয়া সৃজন ও রদবদলই বোঝাচ্ছি না। সে তো বটেই, উপরন্তু অভিব্যক্তি প্রকাশের দুর্দান্ত মাত্রাগত বিকাশ বোঝাচ্ছি। সাদামাটাভাবে বললে, শব্দমালার উৎপাদন হচ্ছে অসংখ্য উপায়ে ও জায়গায়, উৎপাদিত শব্দমালা বিপুল, কল্পনাতীত প্রায়। সেলফোনের এসএমএস থেকে শুরু করে সাইবার স্পেসের পাতায়-দেয়ালে, হাজার হাজার পোর্টালে, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় হাজার হাজার দৈনিকে-সাপ্তাহিকে-পাক্ষিকে-মাসিকে-ত্রৈমাসিকে, লক্ষ লক্ষ পুস্তকে। এগুলো বললাম কেবল ভাষার লেখ্য রূপ নিয়েই। উৎপাদন যখন এত অবারিত ও লাগাতার, তখন উৎপাদনের বৈশিষ্ট্য-গুণ-রূপ কোনো উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। আপনারা বলতেই পারেন যে, খাদ্যমানের গুণপনা যাচাই করার ব্যবস্থা ও প্রয়োজন দুই-ই আছে, বরং আমাদের দেশে তার অভাবের কারণেই সমস্যা হয়ে থাকে বা ইত্যাদি। খাদ্যমানের প্রসঙ্গ প্রাণঘাতী হতে পারে। ভাষার রূপান্তর বা পুনর্গঠন বা নড়াচড়া প্রাণঘাতী কিছু নয়। তা ছাড়া দুয়ের তুলনাও কৌতুককর পরিস্থিতি ছাড়া কোনো ভাবগম্ভীর আলোচনা হতে পারে না।
'শুদ্ধতা'র দুশ্চিন্তা একটা অহেতু জিনিসই বটে। জাতির গৌরব ও বিশুদ্ধতা নিয়ে যেসব আহাজারি আছে তাতে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে বটে। কিন্তু ইতিহাস চর্চাকারী মাত্র জানেন যে 'শুদ্ধতা' বরাবরই একটা কল্পিত বিষয়ই বটে। আর আম মানুষের ভাষাপ্রসঙ্গ এসবের মধ্যেই নেই। চা-বাগানের শ্রমিক কিংবা ধাঙ্গর সম্প্রদায়ের ভাষা প্রসঙ্গ নিয়ে আপনারা অনেক আলাপ করে থাকেন। কারণটাও তো জানেন। যোগাযোগের অমোঘ প্রয়োজনে নিজেদের আরেক ভাষা আবিস্কার করে নেওয়া ছাড়া তাঁদের জীবনে কোনো উপায় ছিল না। যেমন কিনা হিজড়া সম্প্রদায়েরও। শাসিতের ভাষার একটা সার্বভৌমত্ব আছে। হয়তো পরাস্ত, কিন্তু উদ্ভাবনগুণে তা সার্বভৌম।
লেখক
কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক