একুশে
ভাষার শরীরে নখের আঁচড়ে ক্ষত
মুজতবা আহমেদ মুরশেদ
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ১২:০০
মাতৃভাষার নিজস্ব আঙ্গিক, রূপ, গন্ধ, ছন্দ, মৌলিক আবর্তন, আবেদনের সুরক্ষায় সব দেশেই কিছু মানুষ ভাবে, কাজ করে। আমাদের দেশেও আছেন অনেকে, যারা এ নিয়ে নিরন্তর কথা বলছেন, লিখছেন। এরপরও আবারও লেখা ও প্রতিবাদে বলিষ্ঠ হয়ে বলার প্রয়োজন বোধ করছেন তারা।
কেন এমন প্রচেষ্টা? কেন এভাবে কণ্ঠে জোর এনে বলতে হয়, দিতে হয় ডাক, 'ভালোবাসো তুমি তোমার মায়ের ভাষারে'। অবিকৃত রাখো তুমি তোমার মাটিতে বেড়ে ওঠা ভাষার শুচিতাকে।
এত ডাকের পরও মনে হয়, এর পুরো কার্যকারিতা নেই। তখন প্রবল ক্রোধ আর হাহাকার উভয় মিলিয়ে মিশ্র লাভার সঞ্চার হয় এ সমাজের পরতে, অলিন্দে। এ পরিস্থিতিতে ভাবার বিষয়, কী করে এটা ঘটছে? সমাজে বাস করা কিছু মানুষের মননে, মস্তিস্কে কী করে ভাষার বিকৃতি বিকশিত হচ্ছে নগ্নভাবে?
চল্লিশের দশকে ব্রিটিশের হাত থেকে ভারত আর পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পর যে শৃঙ্খল মুক্তি, তাই কিনা আবার আমাদের পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালির জন্য ফাঁস হয়ে দেখা দিল। পশ্চিমারা চাইল আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে। ভাষার জন্য সালাম, বরকত, জব্বার, রফিকরা জীবন দিলেন। তারপর সেই ভাষার ভিত্তিতেই জাগরিত হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এ ইতিহাস মুখে মুখে রূপকথার গল্পের বিন্যাসের মতো ছড়ানো। এ জাতির অমোঘ নিয়তিতে ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগের বিজয়। একটি দেশ ও পতাকা পেতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো, 'এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।' অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ। জন্ম নেয় বাংলাদেশ।
সব কিছুই ঘটল ভাষার দাবির যে স্রোতঃস্বিনী, সেই প্লাবন জলের অভিঘাতে। কিন্তু স্বাধীনতার দু'দশক পেরোতে না পেরোতেই বাংলা ভাষার ভেতর ইংরেজি ভাষার প্রচুর শব্দের অনুপ্রবেশ। আর এখন এর প্রাবল্য মহাবিস্তৃত।
এ প্রসঙ্গে সবার মতো করেই জানা কথাগুলো আবারও উচ্চারণ করতে চাই। বিশেষত অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পাঠ্যসূচি এবং আচার-আচরণ ধনিকশ্রেণির সন্তানদের সাধারণের থেকে আলাদা হওয়ার যে শিক্ষা দেয় নিজেদের সুরক্ষায়, তা একটি দানব। বিশেষ করে সেসব পড়ূয়ার কোমল মস্তিস্কে পিতামাতার বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে অর্জিত কালো টাকার পাহারা দেওয়ার অস্ত্র সাজানো হয়। সেটি হলো ইংরেজির মিশেলে একটি বিজাতীয় ভাষার বিকাশ করে দরিদ্র ও শ্রমিক শ্রেণিকে নিয়ন্ত্রণ ও তাদের সঙ্গে পার্থক্য তৈরিতে কৌশল শেখানো। এসব স্কুল নামক সমাজ ও রাষ্ট্রভাষার মূল সুরবিরোধী সাংস্কৃতিক কারখানায় উৎপাদিত বিকৃত ভাষাই আত্মঘাতী মরণব্যাধিতে জন্মানো পুঁজের মতো নব্য ধনিকশ্রেণি এবং ধনী হতে চাওয়া অসংখ্য উচ্চ মধ্যবিত্তের দেহেও প্রবেশ করে ঘনীভূত হয়েছে এবং হচ্ছে।
একই সঙ্গে বলা যায়, আমাদের দেশে আজকাল বিভিন্ন আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে শিক্ষাটা দেওয়া হয়, তা মূলত আন্তর্জাতিকীকরণের নামে একটা ভালো চাকরি বা মোটা বেতনের চাকরি জোগাড় করার শিক্ষাও বটে।
স্পষ্টতই ভাষা বিকৃতির এ প্রক্রিয়াটিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে ইংরেজি মাধ্যামে পড়াশোনা করানো একশ্রেণির তথাকথিত অভিজাত পরিবার ও তাদের সন্তান। সে ধারার কিছু মুনাফাখোর ব্যবসায়ী এখানে যুক্ত। যাদের বাবা-মা নিজের দেশটাকে নিজের না ভেবে হাঁচি দিলেও বিদেশ যান, বা একটা মামুলি গেঞ্জি কিনতেও এয়ারপোর্টে গিয়ে বিমানে চেপে বসেন। দেশটাকে তারা নেহাত একটা প্ল্যাটফর্ম স্টেশন ভাবেন। তাদের কাছে এ দেশ, মাটির কোনো গুরুত্ব নেই। এখানে তারা কেবল অল্প কিছু সময় থাকেন। তাদের মূল আবাস আর ভাবনা হয় আমেরিকা, না হয় অন্য কোনো উন্নত দেশ। তারা ভাবেন, এভাবে বাংলা বললে যেন অনেক বেশি নিজেকে অভিজাত হিসেবে এই দরিদ্র সমাজটাতে তুলে ধরা যায়, আধিপত্য বিস্তার করা যায়। 'আমি তো ঠিক খরে বাংলা, আই মিন বোলত্যে, সরি আই ডোন্ট ফিল কমফরটেবল'- এই তো হলো এদের অবস্থা।
আগের বলা কথার সরলীকৃত প্রকাশটি হলো, ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করা ছাত্রছাত্রীরা খাঁটি বাংলায় কথা বলতে লজ্জাবোধ করে। বাংলায় কথা বললে এই বুঝি তাদের অন্যের সঙ্গে নিজেদের আলাদা করে রাখার সীমান্তটা সরে গেল। খাঁটি বাংলায় কথা বললে পিতামাতার চুরি করে আয় করা কালো টাকায় বানানো অহংকারটা শেষ হয়ে যায়। পিতা-প্রপিতামহের আদি অকৃত্রিম খাঁটি বাংলায় কথা বললে তারা নেহাত একটা সাধারণ মানুষ হিসেবে অন্যের কাছে মূল্যায়িত হয়ে আভিজাত্য হারিয়ে অধস্তন হয়ে পড়ে। আর সেই ভয়েই ইংরেজির মিশেলে খিচুড়ি ভাষার ছাদের নিচে আশ্রয় নেয়। তাদের তৈরি করা সে বিকৃত ভাষায় একটি জনগোষ্ঠী প্রভাবিত। সে প্রভাব কতখানি ব্যাপক তা বোঝা যায় পথ চলতে বা সেসব গণমাধ্যমের ভাষা শুনলে।
বিশেষত এফএম রেডিও এবং কিছু টিভি চ্যানেলে কিছু অনুষ্ঠানের ভাষা এমন কদর্য ধারায় ইংরেজির মিশেলে খিচুড়ি হয়ে সবার কাছে পরিবেশিত হচ্ছে, যা বিপজ্জকভাবে এই প্রজন্মের অনেককেই প্রলুব্ধ করছে সেভাবে বলতে। আজব আর আজগুবি এক মোহ সবার। আবার যেটুকু বাংলা বলছে, সেই উচ্চারণে ইংরেজি বলনেওয়ালা সাহেবদের কায়দা ঢুকিয়ে দেওয়া। অন্তরে ভাবখানা, 'আহা কেউ যদি নাই বুঝল আমি ইংরেজি রপ্তধারায় কথা বলি, কী আর মর্যাদা থাকল তবে আমার?' ফলে অর্থমিশ্রিত সেই অহংকারটা বোঝাতে গেলেই তাকে এমন ধারার উচ্চারণে বাংলা বলতে শোনা যায় এবং সেই বাংলাটা আর সে রকম বাংলা থাকে না। 'হ্যালো ভিউয়ার্স, হাই, আসশা কোরি আপনারা সক্কলে ফাইন, ভালোও আছেন। থ্যাংস ভিউয়ার্স...'- এই রকম আর কি তাদের বোলচাল। আমি হতভম্ব। বিশুদ্ধভাবে না কেউ ইংরেজি বলছে, না কেউ বাংলা বলছে! কোনো ভাষারই বিশুদ্ধতা নেই! কেউ ধারও ধারছে না এই পাপের।
এমন একটি কিম্ভূতকিমাকার চেহারায় বাংলাদেশেই মাতৃভাষার আসল স্বরূপের পাশাপাশি বিকৃত এ ধারাটি বেশ সচল। এ বিকৃত ধারার পৃষ্ঠপোষক মালিক ও নতজানু কর্মীরা এমন ভাষার সচলতায় উৎসাহিত। কেননা, তারা একটি বিশেষ শ্রেণির কাছে তাদের বাজার এভাবে ধরতে পেরে মুনাফা করছেন। ফলে মাতৃভাষাকে বিকৃত করে তার উপস্থাপন প্রতিনিয়ত চলছে।
সত্যিই কী হাস্যকর এই অনুভূতি বা ভাবনা এবং তাদের ভাষাচর্চা! কেউ কি এমন দেখেছে কখনও, কোনো উন্নত দেশের মানুষ তাদের নিজেদের ভাষার ভেতর অন্য ভাষার মিশেল দিয়ে কথা বলে? অথবা নিজেদের ভাষায় অন্য ভাষার কথা বলার লয়টাকে মিশিয়ে বাক্য বিন্যাস করে? করেও না, বলেও না। ফরাসিরা কি জার্মান মিশিয়ে, বা ইংরেজরা কি জাপানি মিশিয়ে বা আরবরা কি রাশিয়ান মিশিয়ে কথা বলে? কখনোই নয়।
শুধু অনেক ভারতীয় ইংরেজি মিশিয়ে আজকাল এই ধারায় কথা বলে তাদের ইলেকট্রনিক মাধ্যমে। কিন্তু তাদের এই ধারাকে আমাদের অনুসরণ করতে হবে, যারা এটা ভাবেন এবং চর্চা করেন, তাদের কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। ভারতের অনেক অঞ্চলের তরুণরা এভাবে কথা বলে তার কারণ হলো, ওই দেশটাতে অসংখ্য প্রদেশ এবং সবার আলাদা একটা করে ভাষা। যার ফলে এক প্রদেশের মানুষ অন্য প্রদেশের মানুষের ভাষা বোঝে না। ফলে ইংরেজি তাদের কাছে একটা সংযোগকারী পুলের মতো। সেটার মধ্য দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করা সহজ। কিন্তু আমরা অনেকেই যেন তাদের এই অবস্থাটাকেই আমাদের জন্য প্রযোজ্য যুক্তি হিসেবে মানছি।
কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তো আমাদের দেশের একটাই ভাষা- প্রধান ভাষা। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর স্বল্পসংখ্যক মানুষের সঙ্গে প্রধান জনগোষ্ঠীর সংযোগ রক্ষায় আমাদের অন্য কোনো ভাষার দরকার পড়ে না। আমাদের যা দরকার পড়ে তা হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যোগাযোগের জন্য। সে কারণে ইংরেজি অবশ্যই শিখতে হবে। কেউ তো এ বিষয়ে কাউকেই বারণ করছে না। কেউ যদি ঝরঝরে ইংরেজি ভাষায় কথা বলে, কেউ কি তাকে মানা করবে? কেউ করবে না।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা একান্ত জরুরি। একটা বিষয়ে অস্বীকারের কোনোই জায়গা নেই- আমাদের দেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করতে এবং বিশ্ব রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে শক্তিশালী দেশ হিসেবে নিজেদের পরিচয় মেলে ধরতে হলে ইংরেজি শিক্ষালাভ অপরিহার্য। শুধু ইংরেজি কেন, আরও দু'চারটা ভাষা জানাও দরকার। ফরাসি, জার্মান, রাশান, চীনা এবং জাপানি ভাষা শেখা যেতেই পারে এবং শেখাটাই উচিত। তবে কোনোভাবেই একটা ভাষার সঙ্গে আর একটা ভাষাকে মিশিয়ে খিচুড়ি বানিয়ে বলা বা ব্যবহার করার কোনো মানে নেই। এভাবে ভাষার ব্যবহার, একটা ভাষাকে কেবল ধ্বংসই করে।
স্পষ্ট করে বলা যায়, আমাদের প্রজন্মকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে চাকুরে মনোবৃত্তির খিচুড়ি ভাষা শিক্ষা ও ব্যবহার থেকে আমাদের দূরে থাকা উচিত। আর এ জন্য প্রতিটি পিতামাতার ভাবা উচিত তাদের সন্তানকে কীভাবে, কোন শিক্ষা পদ্ধতিতে সত্যিকারের শিক্ষিত করে তুলবেন তারা। এমন শিক্ষা দিতে ব্রতী হবেন যে, সেই শিক্ষা যেন তাদের সন্তানকে মাতৃভাষার হত্যাকারীতে পরিণত না করে। হীনম্মন্যতার আবহে প্রোথিত হয়ে নিজের শুদ্ধ সংস্কৃতির শিকড়বাকড় আর আত্মপরিচয় ভুলিয়ে না দেয়।
তাই এটাই বোধহয় প্রকৃত সময়, যারা এভাবে এফএম ব্যান্ডে প্রচারিত রেডিও কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে খিচুড়ি ভাষার ব্যবহারবিধি ছড়াচ্ছে, যারা এই পদ্ধতিতে বা এই হযবরল মন-মানসিকতায় বাংলাকে ইংরেজির সঙ্গে উদ্ভটভাবে মিলিয়ে একটা কদর্য ভাষা বানিয়ে অন্যকে গেলাচ্ছে- তাদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ করা। এই দেশটাকে, এই মায়ের ভাষাটাকে ভালোবাসবার মতো শক্তিসম্পন্ন এই নতুন প্রজন্মকে রুখে দাঁড়ানোর সাহস জোগানো দরকার, তারা যেন তাদের বিরুদ্ধে লড়তে পারে, সে লড়াইয়ের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে নিজের মাতৃভাষার সঠিক গতিপথটা কোনো দিন যেন হারিয়ে না ফেলে। তাদের দেশপ্রেম আর ভাষার প্রতি মমত্ব স্তব্ধ না হয়। তারা ববং হয়ে উঠবে মাতৃভাষার অকৃত্রিম কণ্ঠস্বর।
আর তা হলেই অর্থবহ হয়ে উঠবে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান। সগৌরবে মনে হবে, এ বাঙালি জাতিই মাতৃভাষার মর্যাদা আদায়ের ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে নিজেদের সামগ্রিক উন্নতি সাধনে রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল।
চাই না সুবিশাল বটবৃক্ষের পাতা খসিয়ে খসিয়ে সেখানে ক্যাকটাসের কাঁটাওয়ালা পাতা সন্নিবেশিত করে বটবৃক্ষের পুরো আদলটিকে পাল্টে কেউ দিক। তাদের এ ধৃষ্টতাকে রুখে দিতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে শপথে উচ্চারণ করতে চাই, এ মাটি, আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মায়ের ভাষাটিকে আদরে লালন করাই এক পবিত্র ধর্ম। বিশ্বাস করতে চাই, বড় মমতা আর ভালোবাসায় নিবিড় করে মায়ের ভাষাকে আগলে রাখতেই আমাদের সংগ্রাম সব সংশয় দূর করে হাঁটুক ক্লান্তিহীন।
লেখক
কবি, কথাসাহিত্যিক
কেন এমন প্রচেষ্টা? কেন এভাবে কণ্ঠে জোর এনে বলতে হয়, দিতে হয় ডাক, 'ভালোবাসো তুমি তোমার মায়ের ভাষারে'। অবিকৃত রাখো তুমি তোমার মাটিতে বেড়ে ওঠা ভাষার শুচিতাকে।
এত ডাকের পরও মনে হয়, এর পুরো কার্যকারিতা নেই। তখন প্রবল ক্রোধ আর হাহাকার উভয় মিলিয়ে মিশ্র লাভার সঞ্চার হয় এ সমাজের পরতে, অলিন্দে। এ পরিস্থিতিতে ভাবার বিষয়, কী করে এটা ঘটছে? সমাজে বাস করা কিছু মানুষের মননে, মস্তিস্কে কী করে ভাষার বিকৃতি বিকশিত হচ্ছে নগ্নভাবে?
চল্লিশের দশকে ব্রিটিশের হাত থেকে ভারত আর পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পর যে শৃঙ্খল মুক্তি, তাই কিনা আবার আমাদের পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালির জন্য ফাঁস হয়ে দেখা দিল। পশ্চিমারা চাইল আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে। ভাষার জন্য সালাম, বরকত, জব্বার, রফিকরা জীবন দিলেন। তারপর সেই ভাষার ভিত্তিতেই জাগরিত হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এ ইতিহাস মুখে মুখে রূপকথার গল্পের বিন্যাসের মতো ছড়ানো। এ জাতির অমোঘ নিয়তিতে ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগের বিজয়। একটি দেশ ও পতাকা পেতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো, 'এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।' অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ। জন্ম নেয় বাংলাদেশ।
সব কিছুই ঘটল ভাষার দাবির যে স্রোতঃস্বিনী, সেই প্লাবন জলের অভিঘাতে। কিন্তু স্বাধীনতার দু'দশক পেরোতে না পেরোতেই বাংলা ভাষার ভেতর ইংরেজি ভাষার প্রচুর শব্দের অনুপ্রবেশ। আর এখন এর প্রাবল্য মহাবিস্তৃত।
এ প্রসঙ্গে সবার মতো করেই জানা কথাগুলো আবারও উচ্চারণ করতে চাই। বিশেষত অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পাঠ্যসূচি এবং আচার-আচরণ ধনিকশ্রেণির সন্তানদের সাধারণের থেকে আলাদা হওয়ার যে শিক্ষা দেয় নিজেদের সুরক্ষায়, তা একটি দানব। বিশেষ করে সেসব পড়ূয়ার কোমল মস্তিস্কে পিতামাতার বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে অর্জিত কালো টাকার পাহারা দেওয়ার অস্ত্র সাজানো হয়। সেটি হলো ইংরেজির মিশেলে একটি বিজাতীয় ভাষার বিকাশ করে দরিদ্র ও শ্রমিক শ্রেণিকে নিয়ন্ত্রণ ও তাদের সঙ্গে পার্থক্য তৈরিতে কৌশল শেখানো। এসব স্কুল নামক সমাজ ও রাষ্ট্রভাষার মূল সুরবিরোধী সাংস্কৃতিক কারখানায় উৎপাদিত বিকৃত ভাষাই আত্মঘাতী মরণব্যাধিতে জন্মানো পুঁজের মতো নব্য ধনিকশ্রেণি এবং ধনী হতে চাওয়া অসংখ্য উচ্চ মধ্যবিত্তের দেহেও প্রবেশ করে ঘনীভূত হয়েছে এবং হচ্ছে।
একই সঙ্গে বলা যায়, আমাদের দেশে আজকাল বিভিন্ন আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে শিক্ষাটা দেওয়া হয়, তা মূলত আন্তর্জাতিকীকরণের নামে একটা ভালো চাকরি বা মোটা বেতনের চাকরি জোগাড় করার শিক্ষাও বটে।
স্পষ্টতই ভাষা বিকৃতির এ প্রক্রিয়াটিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে ইংরেজি মাধ্যামে পড়াশোনা করানো একশ্রেণির তথাকথিত অভিজাত পরিবার ও তাদের সন্তান। সে ধারার কিছু মুনাফাখোর ব্যবসায়ী এখানে যুক্ত। যাদের বাবা-মা নিজের দেশটাকে নিজের না ভেবে হাঁচি দিলেও বিদেশ যান, বা একটা মামুলি গেঞ্জি কিনতেও এয়ারপোর্টে গিয়ে বিমানে চেপে বসেন। দেশটাকে তারা নেহাত একটা প্ল্যাটফর্ম স্টেশন ভাবেন। তাদের কাছে এ দেশ, মাটির কোনো গুরুত্ব নেই। এখানে তারা কেবল অল্প কিছু সময় থাকেন। তাদের মূল আবাস আর ভাবনা হয় আমেরিকা, না হয় অন্য কোনো উন্নত দেশ। তারা ভাবেন, এভাবে বাংলা বললে যেন অনেক বেশি নিজেকে অভিজাত হিসেবে এই দরিদ্র সমাজটাতে তুলে ধরা যায়, আধিপত্য বিস্তার করা যায়। 'আমি তো ঠিক খরে বাংলা, আই মিন বোলত্যে, সরি আই ডোন্ট ফিল কমফরটেবল'- এই তো হলো এদের অবস্থা।
আগের বলা কথার সরলীকৃত প্রকাশটি হলো, ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করা ছাত্রছাত্রীরা খাঁটি বাংলায় কথা বলতে লজ্জাবোধ করে। বাংলায় কথা বললে এই বুঝি তাদের অন্যের সঙ্গে নিজেদের আলাদা করে রাখার সীমান্তটা সরে গেল। খাঁটি বাংলায় কথা বললে পিতামাতার চুরি করে আয় করা কালো টাকায় বানানো অহংকারটা শেষ হয়ে যায়। পিতা-প্রপিতামহের আদি অকৃত্রিম খাঁটি বাংলায় কথা বললে তারা নেহাত একটা সাধারণ মানুষ হিসেবে অন্যের কাছে মূল্যায়িত হয়ে আভিজাত্য হারিয়ে অধস্তন হয়ে পড়ে। আর সেই ভয়েই ইংরেজির মিশেলে খিচুড়ি ভাষার ছাদের নিচে আশ্রয় নেয়। তাদের তৈরি করা সে বিকৃত ভাষায় একটি জনগোষ্ঠী প্রভাবিত। সে প্রভাব কতখানি ব্যাপক তা বোঝা যায় পথ চলতে বা সেসব গণমাধ্যমের ভাষা শুনলে।
বিশেষত এফএম রেডিও এবং কিছু টিভি চ্যানেলে কিছু অনুষ্ঠানের ভাষা এমন কদর্য ধারায় ইংরেজির মিশেলে খিচুড়ি হয়ে সবার কাছে পরিবেশিত হচ্ছে, যা বিপজ্জকভাবে এই প্রজন্মের অনেককেই প্রলুব্ধ করছে সেভাবে বলতে। আজব আর আজগুবি এক মোহ সবার। আবার যেটুকু বাংলা বলছে, সেই উচ্চারণে ইংরেজি বলনেওয়ালা সাহেবদের কায়দা ঢুকিয়ে দেওয়া। অন্তরে ভাবখানা, 'আহা কেউ যদি নাই বুঝল আমি ইংরেজি রপ্তধারায় কথা বলি, কী আর মর্যাদা থাকল তবে আমার?' ফলে অর্থমিশ্রিত সেই অহংকারটা বোঝাতে গেলেই তাকে এমন ধারার উচ্চারণে বাংলা বলতে শোনা যায় এবং সেই বাংলাটা আর সে রকম বাংলা থাকে না। 'হ্যালো ভিউয়ার্স, হাই, আসশা কোরি আপনারা সক্কলে ফাইন, ভালোও আছেন। থ্যাংস ভিউয়ার্স...'- এই রকম আর কি তাদের বোলচাল। আমি হতভম্ব। বিশুদ্ধভাবে না কেউ ইংরেজি বলছে, না কেউ বাংলা বলছে! কোনো ভাষারই বিশুদ্ধতা নেই! কেউ ধারও ধারছে না এই পাপের।
এমন একটি কিম্ভূতকিমাকার চেহারায় বাংলাদেশেই মাতৃভাষার আসল স্বরূপের পাশাপাশি বিকৃত এ ধারাটি বেশ সচল। এ বিকৃত ধারার পৃষ্ঠপোষক মালিক ও নতজানু কর্মীরা এমন ভাষার সচলতায় উৎসাহিত। কেননা, তারা একটি বিশেষ শ্রেণির কাছে তাদের বাজার এভাবে ধরতে পেরে মুনাফা করছেন। ফলে মাতৃভাষাকে বিকৃত করে তার উপস্থাপন প্রতিনিয়ত চলছে।
সত্যিই কী হাস্যকর এই অনুভূতি বা ভাবনা এবং তাদের ভাষাচর্চা! কেউ কি এমন দেখেছে কখনও, কোনো উন্নত দেশের মানুষ তাদের নিজেদের ভাষার ভেতর অন্য ভাষার মিশেল দিয়ে কথা বলে? অথবা নিজেদের ভাষায় অন্য ভাষার কথা বলার লয়টাকে মিশিয়ে বাক্য বিন্যাস করে? করেও না, বলেও না। ফরাসিরা কি জার্মান মিশিয়ে, বা ইংরেজরা কি জাপানি মিশিয়ে বা আরবরা কি রাশিয়ান মিশিয়ে কথা বলে? কখনোই নয়।
শুধু অনেক ভারতীয় ইংরেজি মিশিয়ে আজকাল এই ধারায় কথা বলে তাদের ইলেকট্রনিক মাধ্যমে। কিন্তু তাদের এই ধারাকে আমাদের অনুসরণ করতে হবে, যারা এটা ভাবেন এবং চর্চা করেন, তাদের কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। ভারতের অনেক অঞ্চলের তরুণরা এভাবে কথা বলে তার কারণ হলো, ওই দেশটাতে অসংখ্য প্রদেশ এবং সবার আলাদা একটা করে ভাষা। যার ফলে এক প্রদেশের মানুষ অন্য প্রদেশের মানুষের ভাষা বোঝে না। ফলে ইংরেজি তাদের কাছে একটা সংযোগকারী পুলের মতো। সেটার মধ্য দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করা সহজ। কিন্তু আমরা অনেকেই যেন তাদের এই অবস্থাটাকেই আমাদের জন্য প্রযোজ্য যুক্তি হিসেবে মানছি।
কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তো আমাদের দেশের একটাই ভাষা- প্রধান ভাষা। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর স্বল্পসংখ্যক মানুষের সঙ্গে প্রধান জনগোষ্ঠীর সংযোগ রক্ষায় আমাদের অন্য কোনো ভাষার দরকার পড়ে না। আমাদের যা দরকার পড়ে তা হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যোগাযোগের জন্য। সে কারণে ইংরেজি অবশ্যই শিখতে হবে। কেউ তো এ বিষয়ে কাউকেই বারণ করছে না। কেউ যদি ঝরঝরে ইংরেজি ভাষায় কথা বলে, কেউ কি তাকে মানা করবে? কেউ করবে না।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা একান্ত জরুরি। একটা বিষয়ে অস্বীকারের কোনোই জায়গা নেই- আমাদের দেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করতে এবং বিশ্ব রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে শক্তিশালী দেশ হিসেবে নিজেদের পরিচয় মেলে ধরতে হলে ইংরেজি শিক্ষালাভ অপরিহার্য। শুধু ইংরেজি কেন, আরও দু'চারটা ভাষা জানাও দরকার। ফরাসি, জার্মান, রাশান, চীনা এবং জাপানি ভাষা শেখা যেতেই পারে এবং শেখাটাই উচিত। তবে কোনোভাবেই একটা ভাষার সঙ্গে আর একটা ভাষাকে মিশিয়ে খিচুড়ি বানিয়ে বলা বা ব্যবহার করার কোনো মানে নেই। এভাবে ভাষার ব্যবহার, একটা ভাষাকে কেবল ধ্বংসই করে।
স্পষ্ট করে বলা যায়, আমাদের প্রজন্মকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে চাকুরে মনোবৃত্তির খিচুড়ি ভাষা শিক্ষা ও ব্যবহার থেকে আমাদের দূরে থাকা উচিত। আর এ জন্য প্রতিটি পিতামাতার ভাবা উচিত তাদের সন্তানকে কীভাবে, কোন শিক্ষা পদ্ধতিতে সত্যিকারের শিক্ষিত করে তুলবেন তারা। এমন শিক্ষা দিতে ব্রতী হবেন যে, সেই শিক্ষা যেন তাদের সন্তানকে মাতৃভাষার হত্যাকারীতে পরিণত না করে। হীনম্মন্যতার আবহে প্রোথিত হয়ে নিজের শুদ্ধ সংস্কৃতির শিকড়বাকড় আর আত্মপরিচয় ভুলিয়ে না দেয়।
তাই এটাই বোধহয় প্রকৃত সময়, যারা এভাবে এফএম ব্যান্ডে প্রচারিত রেডিও কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে খিচুড়ি ভাষার ব্যবহারবিধি ছড়াচ্ছে, যারা এই পদ্ধতিতে বা এই হযবরল মন-মানসিকতায় বাংলাকে ইংরেজির সঙ্গে উদ্ভটভাবে মিলিয়ে একটা কদর্য ভাষা বানিয়ে অন্যকে গেলাচ্ছে- তাদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ করা। এই দেশটাকে, এই মায়ের ভাষাটাকে ভালোবাসবার মতো শক্তিসম্পন্ন এই নতুন প্রজন্মকে রুখে দাঁড়ানোর সাহস জোগানো দরকার, তারা যেন তাদের বিরুদ্ধে লড়তে পারে, সে লড়াইয়ের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে নিজের মাতৃভাষার সঠিক গতিপথটা কোনো দিন যেন হারিয়ে না ফেলে। তাদের দেশপ্রেম আর ভাষার প্রতি মমত্ব স্তব্ধ না হয়। তারা ববং হয়ে উঠবে মাতৃভাষার অকৃত্রিম কণ্ঠস্বর।
আর তা হলেই অর্থবহ হয়ে উঠবে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান। সগৌরবে মনে হবে, এ বাঙালি জাতিই মাতৃভাষার মর্যাদা আদায়ের ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে নিজেদের সামগ্রিক উন্নতি সাধনে রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল।
চাই না সুবিশাল বটবৃক্ষের পাতা খসিয়ে খসিয়ে সেখানে ক্যাকটাসের কাঁটাওয়ালা পাতা সন্নিবেশিত করে বটবৃক্ষের পুরো আদলটিকে পাল্টে কেউ দিক। তাদের এ ধৃষ্টতাকে রুখে দিতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে শপথে উচ্চারণ করতে চাই, এ মাটি, আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মায়ের ভাষাটিকে আদরে লালন করাই এক পবিত্র ধর্ম। বিশ্বাস করতে চাই, বড় মমতা আর ভালোবাসায় নিবিড় করে মায়ের ভাষাকে আগলে রাখতেই আমাদের সংগ্রাম সব সংশয় দূর করে হাঁটুক ক্লান্তিহীন।
লেখক
কবি, কথাসাহিত্যিক
- বিষয় :
- ভাষার শরীরে নখের আঁচড়ে ক্ষত