একুশে
ও আমার বাংলাভাষা
মহাদেব সাহা
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ১২:০০
মানুষের প্রথম ভাষা কান্না, বোধ হয় সমস্ত প্রাণীরও। বলা যায়, কান্নাই পৃথিবীর মাতৃভাষা। জন্মের পর তিন সপ্তাহ মানবশিশুর চোখে জল থাকে না, এই অশ্রুহীন কান্নাই তার ভাষা। কান্না দিয়েই সে তার অস্তিত্ব প্রকাশ করে, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কষ্ট, প্রয়োজন জানায়। মানুষ মায়ের কাছ থেকে কথা শেখে, মায়ের ভাষাই হয়ে ওঠে তার ভাষা, মাতৃভাষা। এই মাতৃভাষার কোনো তুলনা নেই, ভাষার কাছে মানুষের ঋণ অপরিশোধ্য। মাইকেলের খেদোক্তি তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত, 'হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;-/ তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,/ পর-ধন-লোভে মত্ত'- এই সত্য মাইকেল জীবন দিয়ে অনুভব করেছিলেন। মাতৃভাষা ছাড়া কবির জন্য বোধ হয় অন্য অবলম্বন নেই, থাকলেও তা দিয়ে 'মেঘনাদবধ কাব্য' লেখা যায় না। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন 'সং অফারিংস' লিখে, গীতাঞ্জলি নয় বা গীতাঞ্জলির অনুবাদ নয়, পৃথক বই, যদিও পৃথক বই- গীতাঞ্জলির কি ছায়া নেই সেখানে? তারপরও বলবো, বঙ্কিমের 'রাজমোহন'স ওয়াইফ' বা রবীন্দ্রনাথের 'সং অফারিংস' লেখা সত্ত্বেও যেমন বোধ হয় ইংরেজিতে 'মেঘনাদবধ কাব্য' লেখা সম্ভব নয়, তেমনি বোধ হয় রবীন্দ্রনাথেরও 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ', 'সোনার তরী', 'মানস সুন্দরী', 'শেষ বসন্ত' লেখা সম্ভব নয় বাংলা ভাষা ছাড়া হয়ে ওঠা সম্ভব নয় পশ্চিমের পাঠসেরা রোমান্টিক ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কিটস, শেলি, বায়রন, কোলরিজের একই সমান রোমান্টিক। মাতৃভাষার এ এক আশ্চর্য জাদু। এ কথা ঠিকই যে গদ্যে রাধাকৃষ্ণাণ, জওহরলাল নেহরু, নীরদ সি চৌধুরী বা সাম্প্রতিক কালের অনেক খ্যাতিমান লেখক খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।
ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠকদেরও প্রশংসা অর্জন করেছেন। কবিতায় বোধ হয় এমন দৃষ্টান্ত নেই, থাকলেও আমার জানা নেই। আমার তো মনে হয়, ইংরেজি ভাষাতেই একজন শেকসপিয়র হন, ফরাসি ভাষাতে একজন বোদলেয়ার হন, বাংলা ভাষাতে একজন রবীন্দ্রনাথ হন। এই হচ্ছে মাতৃভাষার শক্তি, ঐশ্বর্য। আমি মুগ্ধ হয়ে মাতৃভাষার এই অপার ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে থাকি। যখন যে শব্দের প্রয়োজন, ভাবনার সঙ্গী যে অক্ষর সমষ্টির প্রয়োজন, যে চিত্রকল্প প্রয়োজন, যে ব্যঞ্জনা প্রয়োজন তা পাই আমি আমার বাংলা ভাষার কাছ থেকে, বাংলা ভাষা আমার মায়ের ভাষা, কবিতার ভাষা। রবীন্দ্রনাথ 'সং অফারিংস' লিখেছিলেন ঠিকই কিন্তু ইংরেজিতে কি গীতবিতান লেখা সম্ভব ছিলো, এত সুর, এত ছন্দ, এত রূপবৈচিত্র্য, এত ভাবসম্পদ? মনে হয় কখনোই নয়। জীবনানন্দের শব্দ যে এত কাব্যময়, তার কাব্য যে এত রূপময় এটি সম্ভব হয়েছিলো এই বাংলা ভাষার জন্য, তার মাতৃভাষার জন্য। মানুষ প্রথম যেদিন ভাষা শেখে, মা বলতে পারে, সেদিন তার সামনে পৃথিবীর নতুন দুয়ার খুলে যায়। মাতৃভাষা মানুষের প্রাণের পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ, তার সমস্ত ভাবের রূপ, এই ভাষাতেই সে দ্রোহ, প্রেম, বিপ্লব সাধিত করে; যেমন 'এই অক্ষরে মাকে মনে পড়ে' তেমনি 'এই শব্দ দিয়ে গান লিখে নিয়ে যুদ্ধ করেছি জয়', আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের সেই গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা আমার ভাষা, বাংলা ভাষা। ভাষা দিয়েই গড়ে উঠেছে আমাদের রাষ্ট্র, বাংলা ভাষার রাষ্ট্র, পৃথিবীতে এমন বোধ হয় দুটি নেই। ভাষার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের আত্মপরিচয় আবিস্কার করেছি, বুঝেছি আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের ভাষা, 'আ মরি বাংলা ভাষা'। ভাষা যেন শতশত নদী, ভাষা যেন মহাসাগর, আকাশের পর আকাশ, জানি না তার পরে কী। ভাষা আমার অস্তিত্ব, আমার যখন আর কিছুই থাকে না তখন এই ভাষাই আমার একমাত্র সম্বল।
সে আমার প্রার্থনার ভাষা, আমার দুঃখ প্রকাশের ভাষা, আমার বেদনার ভাষা, আমার আনন্দের ভাষা, সম্বোধনের ভাষা। ভাষা মানেই তো বাক্শক্তি, সে অন্ধকারে আলো, যখন কোনো আলো থাকে না, সেই ঘোর অন্ধকারে এই ভাষাই আমার অবলম্বন, আমার সমস্ত আবেগ প্রকাশ করতে পারি এই ভাষায়। এই ভাষার বিকাশ এবং উৎকর্ষ সাধনের প্রয়াস যে কী বড় কাজ, তা বলে বোঝানো দুরূহ। ভাষা নদীর মতো, সে কতবার কত বাঁক নিয়েছে, ভাষার আধুনিকতার জন্য আমরা কেউ কেউ কখনও খুবই ব্যাকুল হই বটে, কিন্তু ভাষা নিজেই তার আধুনিকতা তৈরি করে, সে যুগে যুগে আধুনিক হয়ে ওঠে, যুগোপযোগী হয়ে ওঠে, একই জায়গায় থাকে না। নানা মতভেদ সত্ত্বেও সপ্তম শতককে যদি বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদের কাল বলে ধরি, দেখবো সেই চর্যাপদের ভাষার সঙ্গে আজকের বাংলার কত পার্থক্য। সে বাংলা বাংলাই কিন্তু যেন অনুবাদ করে আমাদের বুঝতে হয়। তারপর বৈষ্ণব পদাবলির ভাষা, বিদ্যাপতির ব্রজবুলি, আরও পরে ভারতচন্দ্র, ঈশ্বরগুপ্ত, মধ্যযুগের আরও বহু কবি, এমনকি মাইকেল, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমের ভাষা ছাড়িয়ে আজ বাংলা ভাষা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। এ কোনো একক প্রয়াস বা চেষ্টার ফল নয়, ভাষার এই নদী সতত বহমান, স্বতোৎসারিত। বোধ হয় সব ভাষাতেই আদি রচনা কবিতা। মানুষের মুখে মুখে রচিত হয়েছে এই কবিতা, এই গান; কবিতাকে তাই ভাষার আদি রূপ বলতে পারি, বাংলা ভাষায় যেমন চর্যাপদ. তিন হাজার, চার হাজার এমনকি পাঁচ হাজার বছর আগে মুখে মুখে যে শ্নোক বা কাব্য পঙ্ক্তি তৈরি হয়েছিলো, তাই তো সাহিত্যের আদি রূপ। তার মধ্যে জন্ম, জীবন ও জগতের প্রায় সব উত্তরই আমরা খুঁজে পাই। ম্যাক্সমুলার বা এমারসনের মতো পণ্ডিতেরা সবিস্ময়ে প্রাচীন থেকে প্রাচীনতর কালের এই শ্নোক ও মন্ত্রের মহিমা ও ঐশ্বর্য লক্ষ্য করেছেন, অভিভূত হয়েছেন।
আমরা ভাষার আধুনিকতা নিয়ে মাঝে মাঝে যেন খুব বেশি ব্যাকুল হই, তার সংস্কারের কথা ভাবি, বিকৃতি রোধের কথা ভাবি, সে শুধু আজ নয়, পাণিনি, পতঞ্জলিও ভেবেছিলেন, ব্যাকরণ লিখে বিকৃতি রোধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভাষা নিজের গতিতেই চলে। আমাদের ভাষার মূল নিয়ে পণ্ডিতদের নানা ব্যাখ্যা আছে, মাগধি না গৌড়ীয়, তর্কের শেষ হয়নি। এইসব তর্ক, অন্বেষণ সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাচ্ছি ভাষা তার নিজের গতিপথ নিজেই নির্মাণ করে চলে। আমি মনে করি, ভাষার ক্ষেত্রে লোকজ সমাজ, লোকভাষা, লোককবিদের একটা বড় অবদান আছে, আমরা যতই ভ্রু কুঁচকে আধুনিকতার কথা বলি না কেন, তারাই কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলা ভাষা। আমরা যে ভাষা ব্যবহার করি, সে তো অভিজাত শ্রেণির নাগরিক ভাষা, আমরা 'জন্মদিন' বলি না 'বার্থ ডে' বলি. 'আসি' বলি না 'বাই' বলি। বাংলা মাস, সন, তারিখ আমরা তো প্রায় ভুলেই গেছি, চিঠিপত্রে, স্বাক্ষরে ব্যবহার করি ইংরেজি সন-তারিখ; ইংরেজি, মাস, সন-তারিখই আমাদের ব্যবহারিক ভাষা। বাংলা সন, তারিখ, মাস এখনও লোকসমাজেই সাধারণ মানুষ ধরে রেখেছে, বাঁচিয়ে রেখেছে। আমরা অভিজাত নাগরিকরা যে ভাষা ব্যবহার করি, ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে, প্রায়শই একটি সম্পূর্ণ বাক্য বোধ হয় আমরা বাংলায় বলি না, বাংলায় বলতে লজ্জাবোধ করি, ইংরেজি বই আমাদের বইয়ের তাকে শোভা বর্ধন করে, বাংলা উচ্চারণ করতে আমরা কষ্টবোধ করি, কিন্তু আমরা সড়ড়হ (মুন) বা ংড়ড়হ (সুন) বা ফড়ড়ৎ (ডোর) ঠিকই মনে রাখতে পারি। চংুপযড়ষড়মু-র (সাইকোলজি) মতো কঠিন বানান ও উচ্চারণটি আমাদের অসুবিধা হয় না, বাংলা হ্রস্ব ই-কার, দীর্ঘ ঊ-কার, য-ফলা, রেফ নিয়ে আমাদের কত অভিযোগ, আসলে আমরা মনে রাখতে চাই না, চর্চা করতে চাই না। বাংলাকে আমরা ব্রাত্যজনের ভাষা বলে অবহেলা করি, এখনও। আমার কেন যেন মনে হয়, গ্রাম্যজন, ব্রাত্যজন বলে আমরা যাদের উপেক্ষা করি, কুঞ্চিত চোখে তাকাই, ভেবে দেখি না, ভাষা তাদের মধ্যেই বেঁচে আছে। লোকভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে অনেকের আপত্তিও শুনি কিন্তু কিছু তো করার নেই, সম্ভবত পনেরো-বিশ কিলোমিটার পর পরই মুখের ভাষা আলাদা হয়ে যায়, একে রোধ করারই-বা দরকার কী, কোনো ভাষায়ই ভাষার এই স্বাভাবিক গতিপথ রোধ করার চেষ্টা নেই।
ইংরেজি ভাষার কথ্যরূপ কি আমরা বুঝতে পারবো? তারা তো শব্দের অর্ধেকও উচ্চারণ করে না। কিন্তু সেই ভাষাকে তারা বিলোপ করতে চায়নি, একে সম্পদই মনে করে তারা। কিন্তু আমরা নগরজনেরা পরিহার করতে চাই লোকভাষা, আধুনিক-আধুনিক বলে বড় ছটফট করি, আধুনিকতা আসলে কী, সে কি শুধুই জামা-কাপড়, ফ্যাশন, কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার। অস্বীকার করি না যে, আমাদের কবিতাও মূলত এই আধুনিক নাগরিক ভাষায় লেখা। রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহের পদাবলি লিখেছিলেন ব্রজবুলিতে কিন্তু তাকেও এই নগরজনের ভাষাতেই লিখতে হয়েছে। কিন্তু তার আক্ষেপ ছিলো- 'যে আছে মাটির কাছাকাছি/ সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি', আমাদের লোকভাষার কাব্য বা পেস্টোরাল যে রচনা, সেটাও ঠিক মূলধারা হয়ে ওঠেনি, যদিও আমি ব্যতিক্রম মনে করি লালনের গান; লালনের গানকে আমি মূলধারাই মনে করি। আমরা উৎস ও ঐতিহ্যকে বড় বেশি মানতে চাই না, এ বোধ হয় আধুনিকতার নামে আমাদের দীনতারই পরিচয়। যদিও টি.এস এলিয়ট ঐতিহ্যকে অসামান্য মূল্য দিয়েছেন, 'ট্রাডিশন অ্যান্ড ইন্ডিভিজ্যুয়াল ট্যালেন্ট' তার প্রমাণ। ভাষা বিষয়ে এমনি নানা কথা আছে, নানা মত আছে, নানা তর্ক আছে, কারণ ভাষা অগাধ। বাংলা ভাষার এই অফুরন্ত সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে আমার বুক ভরে ওঠে, বারবার বলতে চাই, ও আমার বাংলা ভাষা, তোমার 'পরে ঠেকাই মাথা।
লেখক
কবি
- বিষয় :
- ও আমার বাংলাভাষা