- বিশেষ সমকাল
- বৈষম্য: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
বৈষম্য: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

অধ্যাপক যতীন সরকার
১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্ষক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম। স্বাধীনতা হচ্ছে বড় প্রাপ্তি। পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! এই প্রাপ্তির সুদূরপ্রসারী সুফল পেতে আমরা এমন একটি সংবিধান রচনা করেছিলাম, যা তৃতীয় বিশ্বের আর কোনো রাষ্ট্রে আছে বলে আমার জানা নেই। '৭২-এর সংবিধানের মাধ্যমে আমরা এমন একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, যেখানে ধর্মের নামে কোনো বৈষম্য থাকবে না। মানুষে মানুষে মারামারি-কাটাকাটি হবে না। পাকিস্তান যে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছিল, তা ফিরে পাওয়ার উদ্দেশ্যে সংবিধানে অনেক ধারা যুক্ত করা হয়েছিল। সংবিধানে লিপিবদ্ধ চার মূলনীতির কথা আজ ভালোভাবে স্মরণ করতে হবে।
আমরা সত্যিকারার্থে একটি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে থাকবে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র। এসব লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হওয়ার প্রত্যাশা ছিল আমাদের। আমাদের প্রত্যাশা ঠিক যেভাবে প্রাপ্তিতে পরিণত করার কথা ছিল, সেভাবে হয়নি। স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছর যেতে না-যেতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ক্ষমতা দখলকারীরা রাষ্ট্রকে পূর্বতন ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল। বলা যেতে পারে, পাকিস্তানের ভূত আমাদের ঘাড়ে চেপে বসল। মূলনীতি কেটেছেঁটে একটি যা-তা অবস্থা সৃষ্টি করা হলো। আমরা স্বাধীনতার যে মূল্যবোধ সৃষ্টি করেছিলাম, তা হারিয়ে ফেললাম। এ অবস্থায় অর্ধশতাব্দীকাল অতিক্রম করার পরও যা প্রাপ্তি আমাদের হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। আজকে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কী করে রাষ্ট্রধর্ম থাকে- বুঝতে পারছি না।
পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম জুড়ে দেওয়া সংবিধানের মূলনীতিতে গভীরভাবে আঘাত করেছে। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা চেয়েছিলাম। আমাদের চার মূলনীতি বহাল; আবার রাষ্ট্রধর্মও বহাল- এটি গোঁজামিল ছাড়া আর কিছু নয়। এই গোঁজামিলের অবসান ঘটানোই আজকে আমাদের সবচেয়ে বড় করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের অবশ্যই এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে ধর্মের নামে মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না। বিজয়ের ৫২ বছরে এসেও এটি যে আমরা করতে পারিনি, তা অত্যন্ত বেদনার।
আজ পাকিস্তান আমলের মতো বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। আমাদের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সেই উন্নতি কতজন মানুষের জন্য হয়েছে- এটিই বড় কথা। সব মানুষের জন্য যেমনটি আমরা চেয়েছিলাম, তা কি করতে পেরেছি? মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল- এ কথা যদি বলতে হয়, বলতে হবে, সব বিষয়ে আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত করা হয়েছিল ভাষা-সংস্কৃতি থেকে।
আগে আমরা একজনও কোটিপতি ছিলাম না। পাকিস্তানের ২২টি কোটিপতি পরিবারের রমরমা দেখে কেবলই আমাদের চোখ টাটাত। গায়ে জ্বালা ধরে যেত। এখন তো আমাদের এই স্বাধীন দেশে বাইশের চেয়ে অনেক বেশি পরিবার শুধু কোটিপতি নয়; কোটি কোটিপতি হয়েছে। কিন্তু সেই কোটি কোটিপতি স্বদেশি হয়েও তো আমাদের চোখ টাটানো কিংবা গায়ের জ্বালা জুড়াতে পারেনি। আমি তো দেখছি, বিদেশি কোটিপতি ২২ পরিবারের চেয়েও এখন স্বদেশি কোটিপতিদের আমলে আমাদের দুর্গতির মাত্রা শনৈ শনৈ বাড়ছে। আজকে ২২ হাজার পরিবার অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বঞ্চিতই রয়ে গেছে। হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। তাদের প্রতিহত করতে হবে। অন্যথায় স্বাধীনতার মূল্যবোধ রক্ষা করতে পারব না।
আমরা সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেভাবে স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হয়েছিলাম; সেভাবে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম এ দেশে গড়ে তোলা দরকার ছিল। এ ব্যাপারে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ব্যর্থতা যদি দূর করতে না পারি; সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যদি প্রকৃত প্রস্তাবে সবার আগে এগিয়ে না আসে তাহলে এ অবস্থা দূর হবে না। এ অবস্থা দূর করার জন্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদেরও যুক্ত হওয়া উচিত। আমাদের এখন একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করতে হবে। কাগজ-কলমে থাকলেও আমরা সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি।
এত যে প্রাণের মূল্যে বিজয়ী হলাম; বিজয়ী হয়ে আমাদের দেশটিকে পরিণত করলাম একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে; তারপরও কি আমাদের দেশ আমাদের হয়েছে? এ প্রশ্নের মুখোমুখি হলে দুঃখ-বিষাদ-হতাশা-আত্মধিক্কারে একেবারে কুঁকড়ে যাই। আমার সব ভাবনাচিন্তা এলোমেলো হয়ে যায়। তবু প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে পারি না। বারবারই এ প্রশ্ন আমাকে বিদ্ধ করে। বলা যেতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা পেলেও যথাযথ মুক্তি আসেনি। আমরা সমাজতন্ত্রের কথা বলেছিলাম। এখনও সব মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে পারিনি। এ জন্য হতাশ না হয়ে পারি না। এগুলো করার জন্য এখনই সংগ্রামে নামতে হবে।
নতুন প্রজন্মের মধ্যে স্বাধীনতার মূল্যবোধ গড়ে তুলতে পারিনি। তাদের সামনে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে তাদের নিয়ে নতুন সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে যে ব্যবধান, তা দূর করাই এ মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ।
অধ্যাপক যতীন সরকার : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
মন্তব্য করুন