সরকার জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাকে (আইএলও) জানিয়েছে, শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া এবং দাবি-দাওয়া জানানোর পথ সহজ করা হচ্ছে। সংস্কার করা হচ্ছে শ্রম আইন। বিপরীতে দেশের কয়েকটি খাতে ধর্মঘট নিষিদ্ধের আইন হতে যাচ্ছে। সংসদে উত্থাপিত হয়েছে অত্যাবশ্যক পরিষেবা বিল-২০২৩। শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, আইনটি তাদের ন্যায্য আন্দোলনের অধিকার খর্ব করবে।

বাংলাদেশের শ্রম খাত আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত বিষয়। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অধিকার সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে কথা বলে আসছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগঠন করতে না দেওয়া, কঠোর নিয়ম করে রাখা এবং বাধা দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগের সুরাহা করা হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে। আইএলওকে জানানো হয়েছে, আইএলওর সুপারিশ অনুযায়ী সরকার শ্রম আইন সংশোধনের কাজে হাত দিয়েছে। শ্রম আইন সংশোধন বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় ওয়ার্কিং গ্রুপ রয়েছে। তারা সরকার, মালিকপক্ষ এবং শ্রমিকদের কাছ থেকে মোট ১৭টি প্রস্তাব পেয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম আইন ও মানের সঙ্গে মিল রেখে সংশোধন করা হবে বলে আইএলওকে জানিয়েছে সরকার। ইপিজেড এলাকায় শ্রম আইনের সংশোধনের কাজ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত চলবে।

অথচ এই একই মন্ত্রণালয় বিতর্কিত ধর্মঘট নিষিদ্ধ করার আইনের খসড়া সংসদে উত্থাপন করেছে। গত ৬ এপ্রিল শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বিলটি সংসদে তোলেন। বিলে বলা হয়েছে, সরকার দরকার মনে করলে, জনস্বার্থে কোনো প্রতিষ্ঠানে লকআউট ও লেঅফ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে।

আইনটি পাস হলে অত্যাবশ্যকীয় সেবা খাতে ধর্মঘট নিষিদ্ধের ক্ষমতা পাবে কর্তৃপক্ষ। ‘বেআইনি’ বলে কথিত ধর্মঘটের জন্য জেল-জরিমানার বিধানও রয়েছে। কোনো ব্যক্তি বেআইনি ধর্মঘট শুরু করলে বা চলমান রাখলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। যেসব পরিষেবা বিঘ্নিত হলে ‘জনগণের অসহনীয় কষ্ট হতে পারে’ বলে সরকার মনে করবে, সেসব সেবাও অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করার সুযোগ আইনে থাকবে।

আইনের খসড়ায় অত্যাবশ্যক পরিষেবার দীর্ঘ তালিকা

ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, ই-কমার্স ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল সেবা; ডিজিটাল আর্থিক সেবা; বিদ্যুৎ সঞ্চালন, বিতরণ, সরবরাহ ও বিক্রয় এবং এ-সংক্রান্ত স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ; স্থলপথ, রেলপথ, জলপথ বা আকাশপথে যাত্রী বা পণ্য পরিবহন সেবা, বিমান ও বিমানবন্দর পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কিত পরিষেবাসহ বাংলাদেশ বেসামরিক ও বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কার্যপরিধিভুক্ত অন্য যে কোনো পরিষেবা, স্থলবন্দর, নদীবন্দর, সমুদ্রবন্দর বা বিমানবন্দরে পণ্য বোঝাই-খালাস, স্থানান্তরসহ সংশ্লিষ্ট বন্দর বা বন্দর-সম্পর্কিত পরিষেবা, কোনো পণ্য বা যাত্রীকে ছাড়পত্র প্রদান সম্পর্কিত পরিষেবা, চোরাচালান প্রতিরোধ-সম্পর্কিত পরিষেবা, সশস্ত্র বাহিনীর আওতাধীন যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত পরিষেবা এবং দেশের প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক স্থাপিত বা প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো পরিষেবা, দেশের প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পণ্য বা মালপত্র উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো পরিষেবা, খাদ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, মজুত, সরবরাহ বা বিতরণের কাজে নিযুক্ত সরকারি মালিকানাধীন বা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো পরিষেবা, সরকারি মালিকানাধীন বা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং পানি সরবরাহ বা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা-সম্পর্কিত পরিষেবা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা এ রূপ প্রতিষ্ঠান এবং ডিসপেনসারি-সম্পর্কিত কোনো পরিষেবা, ওষুধ উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন, ক্রয়-বিক্রয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা কারখানার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো পরিষেবা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত পরিষেবা, কয়লা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, ইস্পাত ও সার উৎপাদন, পরিবহন, সরবরাহ বা বিতরণের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো পরিষেবা, কোনো তেলক্ষেত্র, তেল শোধনাগার, তেল সংরক্ষণাগার এবং পেট্রোলিয়াম বা পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ উৎপাদন, পরিবহন, সরবরাহ ও বিতরণের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান, টাঁকশাল ও নিরাপত্তামূলক মুদ্রণ কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো পরিষেবা।

এ বিলের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছে শ্রমিক সংগঠন, শ্রমিক ইউনিয়ন, টিআইবিসহ নাগরিক সংগঠনগুলো। অত্যন্ত খারাপ একটি আইন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী। সমকালকে তিনি বলেন, এ আইনের যেসব বিষয়ে আমাদের আপত্তি রয়েছে, তা চিঠি দিয়ে সরকারকে জানাব। এ আইনের ফলে শ্রমিক ইউনিয়ন করার অধিকার সংকুচিত হবে।

প্রস্তাবিত বিলে ধর্মঘট সম্পর্কে যা বলা হয়েছে সেটি ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করবে বলে মন্তব্য করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সমকালকে তিনি বলেন, জরুরি সেবা নিরবচ্ছিন্ন রাখার গুরুত্ব থাকে। কিন্তু সংগঠন বা প্রতিবাদের অধিকার সাংবিধানিক। সংশ্লিষ্ট সবার কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে আইনটি মালিকদের সুরক্ষা দেওয়া বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য অপব্যবহারের শিকার হতে পারে। সেটি যেন না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি), জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলসহ শ্রমিক সংগঠনগুলো আইনের সমালোচনা করে বলেছে, এটি প্রতিবাদের অধিকার কেড়ে নেবে এবং মালিক বা কর্তৃপক্ষের দৌরাত্ম্যই শুধু বাড়াবে না; শ্রমিকদের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করবে।