
দেশের শ্রম আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ২৪ হাজার ৭টি মামলা। এর মধ্যে গত ছয় মাসের বেশি সময় ধরে ১৯ হাজার ৬০৯টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। অনিষ্পন্ন মামলাগুলো মোট মামলার ৮১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। অথচ শ্রমিকদের দায়ের করা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে চার বছর আগে দেশের তিন জেলায় পৃথক শ্রম আদালত গঠন করে সরকার। ফলে দেশে মোট শ্রম আদালতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০টি। গত বছর আরও তিনটি শ্রম আদালত গঠিত হলেও এগুলো এখনও সচল হয়নি। তাই মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তি কম হওয়ায় প্রতি বছরই মামলাজট বাড়ছে। আইন অনুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে শ্রম আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কথা।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক মামলা আটকে আছে। গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত এসব শ্রম আদালতে মোট ২৪ হাজার ৭টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ২০১৭ সালের মার্চে দেশের সাতটি শ্রম আদালত এবং শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ছিল ১৬ হাজার ১১৫টি মামলা। শ্রম আইন ২০০৬-এর ধারা ২১৮(৫)-এ বলা হয়েছে, দুই বা ততোধিক বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল চলবে। আইন অনুযায়ী শ্রম আদালতকে ৬০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হলে উপযুক্ত কারণ ব্যাখ্যা করে আরও ৯০ দিন সময় দেওয়া যাবে। কিন্তু এক যুগ আগের মামলাও আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
এদিকে বিদ্যমান ১০টির বাইরে নতুন আরও তিনটি শ্রম আদালত গঠন করা হয়েছে। গত বছর গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা জেলায় এসব শ্রম আদালত গঠন করা হয়। সম্প্রতি এ তিন আদালতে চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হলেও প্রয়োজনীয় জনবলসহ নানা কারণে এর কাজ শুরু হয়নি। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানসহ আটটি পদও শূন্য রয়েছে।
বর্তমানে ঢাকার তিনটি আদালতে যথাক্রমে ৮ হাজার ২৪৮, ৭ হাজার ১৩৮ ও ৪ হাজার ২৩৯টি, চট্টগ্রামের দুটি আদালতে যথাক্রমে ১ হাজার ৬৯৯ ও ৬৮৯টি, খুলনায় ১৫৯টি, রাজশাহীতে ১৩৩টি, রংপুরে ৫৪টি, সিলেটে ৮৩ এবং বরিশালে ৭১টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আর শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন আছে ১ হাজার ৪৯৪টি মামলা। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ২৪২টি মামলা বর্তমানে হাইকোর্টে স্থগিত রয়েছে। এ ছাড়া ছয় মাসের বেশি সময় ধরে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে ৭৬৭টি মামলা। প্রয়োজনীয় সংখ্যক আদালত, বিচারক ও সহায়ক জনবল সংকটের অভাবে বছরের পর বছর এসব মামলা ঝুলে আছে।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ (২০২২) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মোট শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৭৪ লাখ ৮ হাজার এবং নারী ২ কোটি ৫৯ লাখ ৩ হাজার। তবে ১৫ বা তদূর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে শ্রমশক্তির বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪ কোটি ৬৯ লাখ।
সূত্র জানায়, শ্রম আদালতের কার্যক্রম শুরুর সময় ঢাকা ও এর আশপাশে কলকারখানা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। বর্তমানে ১০টি শ্রম আদালতে বিচার চললেও তা যথেষ্ট নয়। মামলা অনুপাতে শ্রম আদালতের সংখ্যা ও লোকবল বাড়েনি। এসব আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের জন্য দেশে মাত্র একটি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল রয়েছে, যেটি ঢাকায় অবস্থিত। ফলে অনেক শ্রমিকই ঢাকায় এসে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে আগ্রহ দেখান না। আবার মামলাজটের কারণেও শ্রম আদালতে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে শ্রমিকদের। একইভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রম আদালত ও আপিল ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে স্থগিতাদেশ নিয়ে বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রাখে। এতেও বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয় এবং শ্রমিকরা দ্রুত ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) পরিচালক (আইন) মো. বরকত আলী সমকালকে বলেন, কাগজপত্রে ১৩টি শ্রম আদালত থাকলেও কার্যকর রয়েছে ১০টি। এসব আদালতে আনুপাতিক হারে মামলা বণ্টন করা হলে জট কমতে পারে। এর সঙ্গে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য এডিআর (বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করতে হবে। নয়তো শ্রমিকদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। তাঁর মতে, আইন অনুযায়ী শ্রম আদালতে বিচারকের পাশাপাশি শ্রমিক ও মালিকপক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে কোর্ট গঠন করা হয়। প্রায়শই মালিকপক্ষের প্রতিনিধি উপস্থিত না থাকায় মামলার শুনানি বন্ধ থাকে। এজন্য আইন সংশোধন করে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ সম্পন্ন করার বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাহলে শ্রম আদালতে মামলাজট অনেকাংশেই কমে আসবে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, ‘আমরা শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ যুগোপযোগী করে ২০২২ সালে সংশোধন করেছি। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে সংশোধন করেছি। শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ শ্রম আইন আবারও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি। সংশোধিত এই শ্রম আইন অর্থনৈতিক অঞ্চলেও কার্যকর হবে। আমাদের এসব কার্যক্রম শ্রমজীবী মানুষের জন্য অধিকার নিশ্চিত করবে।’
মন্তব্য করুন