সুদীর্ঘ ৪ হাজার ৩৬৭ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমানা বাংলাদেশের। বিশ্ব মানচিত্রে ছোট্ট এ দেশটির সুবিশাল সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ– বিজিবি। বাহিনীটির কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত ৬৫ হাজারের বেশি সদস্য এবং তাঁদের পরিবারের পাশাপাশি প্রত্যন্ত সীমান্তের পিছিয়ে পড়া মানুষকে আধুনিক ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়ার মানসে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বিজিবি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের উদ্যোগে যাত্রা করে সীমান্ত ব্যাংক।

সীমান্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, যাত্রাকালের মাত্র ছয় বছর পেরিয়ে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক খাতের নতুন ব্যাংকটি কেবল সীমান্ত এলাকা বা বিজিবি সদস্যদের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই, ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে দেশের সর্বত্র। এমন প্রত্যন্ত অঞ্চল, যেখানে আধুনিক ব্যাংকিং সেবা তো দূরের কথা, সাধারণ ব্যাংকিং কার্যক্রমের কথা মানুষ কল্পনায়ও আনে না, সেখানেও শাখা স্থাপনসহ এটিএম মেশিনে ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড দিয়ে যখন তখন টাকা তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে ব্যাংকটি।
তিনি বলেন, যাত্রা শুরুর এক বছর পূর্তিতে  ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে দেওয়া এক বাণীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য হলো দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশাকে বাস্তব রূপ দিতে নিরলস কাজ করছে সীমান্ত ব্যাংক। এরই মধ্যে যশোরের বেনাপোল ও গদখালী, কক্সবাজারের টেকনাফ ও রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চম্পকনগর, কুষ্টিয়ার প্রাগপুর এবং কুমিল্লার বিবির বাজারসহ সীমান্তঘেঁষা বিভিন্ন এলাকায় শাখা স্থাপন করেছে। এসব শাখার মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষকে আধুনিক ব্যাংকিং সেবা যেমন দিচ্ছে, তেমনি সহজ অর্থায়নের মাধ্যমে তাঁদের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে।
তিনি জানান, ব্যাংকটির প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে মূল ধারার ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়া একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিজিবির বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে সীমান্ত ব্যাংক যথাযথ ভূমিকা রাখবে।
রফিকুল ইসলাম বলেন, সীমান্ত ব্যাংক কেবল মুনাফামুখী  নয়;  ব্যাংকিং সেবা প্রদানের পাশাপাশি প্রান্তিক মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। গত মে পর্যন্ত ৩০ কোটি ৯১ লাখ টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করেছে সীমান্ত ব্যাংক। টাকার অঙ্কে কম হলেও সীমান্ত ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক যে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়, তার থেকেও ৩২ শতাংশ বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এ বছর যে কয়টি ব্যাংক তাদের কৃষিঋণ বিতরণের শতভাগ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করেছে, তেমন শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে সীমান্ত ব্যাংক। তিনি জানান, ময়মনসিংহের ভালুকার সীডস্টোরে শাখা খোলা হয়েছে কৃষকদের আর্থিক সহায়তার উদ্দেশ্যে। যশোরের গদখালীতে যেখানে ফুলের চাষ হয়, সেখানেও শাখা খোলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মূল গ্রাহক হিসেবে তাঁদের লক্ষ্য ফুলচাষি। কুষ্টিয়ার প্রাগপুরে একেবারে সীমান্তঘেঁষা এলাকায় সীমান্ত ব্যাংক শাখা খুলেছে। যেখানে অন্য কোনো বেসরকারি ব্যাংকের শাখা নেই।

তিনি বলেন, ‘প্রত্যন্ত এলাকার এসব শাখায় কৃষকদের বিভিন্ন খাতে যেমন ফল উৎপাদন, ফুল চাষ, মাছ চাষ, খামারিদের দুগ্ধ উৎপাদন ও গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পে কৃষিঋণ দিচ্ছি। এমনকি গৃহে হাঁস-মুরগি পালন, নকশিকাঁথা তৈরিসহ অন্যান্য আয় উৎসারী কর্মকাণ্ডের জন্যও আমরা ছোট আকারে ঋণ দিচ্ছি। এসব ঋণে আমরা শতভাগ সফল। কৃষক ও খামারিরা আমাদের থেকে ঋণ নিয়ে ভালো ফসল উৎপাদন বা খামার করে লাভবান হচ্ছেন এবং আমাদের ঋণের টাকাও ফেরত দিচ্ছেন। এটা সফল হচ্ছে, কারণ এসব ঋণ দিয়ে সীমান্ত ব্যাংক যথাযথ মনিটর করছে এবং প্রয়োজনমতো পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছে। তা ছাড়া কৃষিঋণের সুদহারও খুব কম, যা মাত্র ৪ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে। যেখানে এসব কৃষক বা খামারি বিভিন্ন এনজিওর কাছ থেকে যে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করে, তার সুদহার কিছু ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশেরও বেশি পড়ে যায়। অর্থাৎ কম সুদে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে আমরা প্রান্তিক মানুষকে তাঁদের নিজ নিজ কৃষি বা খামারকে লাভজনক করতে সহায়তা করছি। তাঁদের উচ্চ সুদের ঋণের জালে আটকে যাওয়া থেকে বাঁচাতে সহায়তা করছি।’

রফিকুল ইসলাম বলেন, শুধু কৃষিই নয়, কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি  (সিএমএসএমই) খাতেও ২৫৫ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করেছি। কারণ সিএমএসএমই খাত বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে শিক্ষিত জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ব্যবসার প্রতি ঝুঁকছে, যা সিএমএসএমই খাতকে ক্রমাগত শক্তিশালী করছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এ খাতের উন্নয়নে সরকার সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। 

সীমান্ত ব্যাংক সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা ঋণ প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এসএমই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সিএমএসএমই ঋণের সুদহারও খুব কম, যা মাত্র ৪-৭ শতাংশের মধ্যে।

তিনি আরও বলেন, গত সপ্তাহেই দেশের সর্বদক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নীল ডুমুর এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। শ্যামনগরে আমরা উপশাখা খুলব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ উপশাখার অধীনে নীল ডুমুরে একটি এটিএম বুথ স্থাপন করব, যার মাধ্যমে সীমান্ত ব্যাংকের এটিএম কার্ডহোল্ডার এবং অন্যান্য ব্যাংকের কার্ডধারীরা এটিএম থেকে সহজে টাকা তুলতে পারবেন। নীল ডুমুর অত্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চল, যার পর সুন্দরবন শুরু। সেখানে কাঁকড়া চাষ হয়। ওই এলাকার মানুষকে ব্যাংকিং সেবা নিতে ৮-১০ কিলোমিটার দূরে আসতে হয়। এই এলাকার মানুষ আধুনিক ব্যাংকিং সেবা পাবেন সীমান্ত ব্যাংকের মাধ্যমে। যদি বাণিজ্যিক দিক বিবেচনা করেন, তাহলে এই এটিএম বুথকে লাভজনক পর্যায়ে উন্নীত করতে অনেক সময় লাগবে। তারপরও আমরা এটা করছি, কারণ আমরা সীমান্ত ও প্রান্তিক মানুষকে এভাবে ব্যাংকিং সেবা দিতে চাই।

সীমান্ত ব্যাংকের এমডি বলেন, ‘আমরা প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে শহরেও ব্যাংকিং করছি। এখানে মনে রাখতে হবে, সীমান্ত ব্যাংক শুধু সীমান্তের ব্যাংক নয়। এটি অন্য আর দশটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো। আমরা শহুরে মানুষকেও ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছি। যত ধরনের আধুনিক ব্যাংকিং সেবার কথা বলতে পারেন, তার সবই আমাদের আছে। ডেবিট, ক্রেডিট কার্ডের পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যাংকিং, বিএফটিএন, আরটিজিএস, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং রেমিট্যান্স সেবাও আমাদের আছে।’

তিনি বলেন, যশোরের গদখালীতে যেমন আমাদের শাখা আছে, তেমনি রাজধানীর গুলশানেও শাখা আছে। সীমান্ত ব্যাংক শুধু বিজিবি সদস্যের ব্যাংক নয়। এ ব্যাংক থেকে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ব্যাংকিং সেবা নিচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান অন্য ব্যাংকের পাশাপাশি সীমান্ত ব্যাংকের সঙ্গেও ব্যাংকিং করছে। তাদের আমদানি-রপ্তানির ব্যাংকিং সেবাও দিচ্ছি। দিন শেষে ব্যাংকটি যাতে লাভজনকভাবে পরিচালিত হয়, সে দিকটি সবসময়ই বিবেচনায় থাকে। তবে সীমান্ত ব্যাংকের লক্ষ্য, প্রান্তিক ও সীমান্ত এলাকার মানুষকে ভালো ব্যাংকিং সেবা দেওয়া এবং তাদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করা। ভোমরা স্থলবন্দরের কাছে একটি শাখা সমীক্ষা করছি। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হচ্ছে, ধীরে ধীরে পুরো সীমান্তে সীমান্ত ব্যাংককে নিয়ে যাওয়া। সব জায়গায় হয়তো শাখা খোলা সম্ভব হবে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক যে উপশাখা খোলার অনুমতি দিয়েছে, তাতে অল্প জায়গায় এবং স্বল্প জনবল দিয়েও মানুষকে পুরো ব্যাংকিং সেবা দেওয়া যাবে। এ ব্যবস্থা সীমান্ত ব্যাংকের উদ্দেশ্য পূরণে ব্যাপক সহায়তা করবে।

বিজিবির ব্যাংক থেকে বিজিবির সদস্যরা কী ধরনের ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছেন– এমন প্রশ্নে রফিকুল ইসলাম বলেন, বিজিবির সদস্যদের বেতন-ভাতা সীমান্ত ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ হয়। কোথাও এ ব্যাংকের শাখা না থাকলেও বিজিবির সদস্যরা এটিএম কার্ড দিয়ে অন্য যে কোনো ব্যাংকের এটিএম থেকে টাকা তুলতে বা ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা যে কোনো মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে টাকা উত্তোলন বা স্থানান্তর করতে পারেন।

রফিকুল ইসলাম জানান, বিজিবি সদস্যদের বিয়ের ঋণ বা সন্তানদের শিক্ষার জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হয়। এগুলো জামানতবিহীন। তাঁদের জন্য ‘সৈনিক ভবিষ্যৎ’ নামে দ্বিগুণ মুনাফা স্কিমে ফিক্সড ডিপোজিট খোলার সুযোগ আছে। পথ চলার মাত্র ছয় বছরে সীমান্ত ব্যাংক এরই মধ্যে ২৪টি শাখা/উপশাখার মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনা করছে। নতুন যেসব শাখা/উপশাখা যুক্ত হতে যাচ্ছে, সেগুলো হলো– রংপুর শহর, চুয়াডাঙ্গা শহর, দিনাজপুরের চিরির বন্দর, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, সিলেটের জকিগঞ্জ এবং ঢাকার মিরপুর।