- অন্যান্য
- শুটিংয়ের রেকর্ডকন্যা
শুটিংয়ের রেকর্ডকন্যা

কামরুন নাহার কলি
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় চলমান বিশ্বকাপ শুটিংয়ের পর্দা নামছে ৮ ফেব্রুয়ারি। এবারের আসরে মেয়েদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে প্রথম বাংলাদেশি শুটার হিসেবে শুটিং বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলেন কামরুন নাহার কলি। কমনওয়েলথ এবং সাফে বাংলাদেশের শুটারদের রেকর্ড থাকলেও শুটিং বিশ্বকাপের ফাইনাল ছিল অধরা। ২৮ জানুয়ারি সেই অপ্রাপ্তি ঘুচিয়েছেন শুটার কামরুন নাহার।
বাছাইয়ে তিনি ৬২৮.৪ স্কোর করে ষষ্ঠ হন। কলি ছাড়াও বাংলাদেশের আরও ৩ নারী শুটার অংশ নেন এ প্রতিযোগিতায়। তবে নানা জটিলতায় বিশ্বকাপে অংশ নিতে পারেননি বাংলাদেশের পুরুষ শুটাররা। এবারের বিশ্বকাপ শুটিংয়ে ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়াও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শুটাররা অংশ নিচ্ছেন। তাদের মধ্য থেকে লড়াই করে সেরা আটে জায়গা করে নেন কলি।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
কলির জন্ম নারায়ণগঞ্জে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা শহরে। স্থানীয় স্কুল-কলেজে পড়াশোনা শেষে বর্তমানে তিনি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যে গ্র্যাজুয়েশন করছেন। তবে তাঁর ধ্যান-জ্ঞান এখন শুটিংয়ে। কলেজের মনোযোগী এই শিক্ষার্থী কেমন করে এলেন শুটিংয়ে সে এক কৌতূহলই বটে!
যেভাবে শুটিংয়ে
শুটিংয়ে কেমন করে এলেন- এই প্রশ্নের উত্তরে কলি বলেন, 'এটা অনেকটা কাকতালীয়। আমার পরিবারের কেউই শুটিংয়ের সঙ্গে নেই। আমি নিজেও বুঝতামনা শুটিং বিষয়টা। এ নিয়ে একটি মজার ঘটনা আছে। নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় রাইফেল ক্লাব। সেই ক্লাবের সামনের রাস্তা ধরে আমি রোজ কলেজে যাতায়াত করতাম। অন্য অনেক সাইনবোর্ডের মতো রাইফেল ক্লাবের সাইনবোর্ডও পড়তাম। একদিন খুব আগ্রহ হলো, রাইফেল ক্লাব সম্পর্কে জানার। সরাসরি নিজেই চলে গেলাম ক্লাবে। জানতে চাইলাম, এখানে কী হয়- তারা বললেন শুটিং।
আমি ভাবলাম সিনেমার শুটিং। পরে আমাকে ক্লাব কর্তৃপক্ষের লোকজন বিষয়টা বুঝিয়ে বললেন। আমি তো নিজের বোকামির জন্য নিজেই হেসে গড়াগড়ি খাই! পরে এক দিন ভর্তি হয়ে গেলাম ক্লাবে। এটা ২০১৭ সালের কথা। ক্লাবে ভর্তি হলেও শুরুর দিকে তেমন প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। অনেকটা ঢিমেতালে চলছিল দিন। এরই মধ্যে বছর পেরিয়ে গেল। ২০১৮ সালে যুব গেম উপলক্ষে শুরু হয় জোর প্রস্তুতি। এভাবেই আসলে শুটিংয়ের দুনিয়ায় পা রাখা।'
কলির শুটিংযাত্রা দীর্ঘ না হলেও অল্প সময়েই তাক লাগিয়ে দিয়েছেন শুটিং বিশ্বকে। যেই কলি ২০১৭ সালে শুটিং কী তা ঠিক বুঝতেন না। সেই কলি পরের বছর, মানে ২০১৮ সালে যুব গেমে অংশগ্রহণ করেই দ্বিতীয় স্থান দখল করে নেন। শুধু তাই নয়, একই বছর ২৩তম আন্তঃক্লাব শুটিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম স্থান দখল করে নেন। ২০১৯ সালে নবম সুজুকি জাতীয় এয়ারগান চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে গোল্ড জিতে আরেকবার আলোচনায় আসেন কলি। এরপর একে একে সফলতার পাতা উল্টে যেতে থাকেন কলি।
ছন্দপতন ও স্বর্ণোজ্জ্বল ফেরা
২০১৮ সালের পর হঠাৎ থমকে যায় কলির শুটিং যাত্রা। ২০২০ ও ২০২১ সাল করোনার কারণে ছন্দপতন হলেও ফের নিজের পথ খুঁজে পেতে সময় নেননি কলি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়ে এয়ার রাইফেল ইভেন্টে একের পর এক তাক লাগানো স্কোর গড়তে থাকেন এই রেকর্ড বালিকা। ২০২২ সালের অক্টোবরে মিসরের রাজধানী কায়রোতে বিশ্ব শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে ৬২৯ দশমিক ২ স্কোর তুলে ১৩৪ জনের মধ্যে হয়েছেন ১৪তম।
একই বছর কায়রো ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান এয়ারগান চ্যাম্পিয়নশিপেও দারুণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে সবাইকে চমকে ফাইনালে ওঠে যান। প্রথমবারের মতো শুটিংয়ের কোনো আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়নশিপে পদক জয়ের আশা জাগে তাঁরই হাত ধরে। তবে ফাইনালে ০ দশমিক ৩ পয়েন্টের জন্য হাতছাড়া হয়ে যায় ব্রোঞ্জ পদক। ২৫৯ দশমিক ১ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ স্থানেই স্থির থাকতে হয় তাঁকে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বকাপ শুটিংয়ে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল একক ইভেন্টে সেরা আটে জায়গা করে নেন কলি। ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় বাছাইয়ে ৫৩ শুটারের মধ্যে কলি ৬২৮ দশমিক ৪ স্কোর করে ষষ্ঠ হয়েছেন, যা বাংলাদেশের জন্য ইতিহাস।
চোখে অলিম্পিকের সোনা জয়
বাংলাদেশের হয়ে যে ইতিহাস গড়লেন কলি তাতেই থামতে চান না তিনি। এখন তাঁর চোখ ২০২৪ ফ্রান্স অলিম্পিকে। তাঁর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এই আসরে ফলাফলে খুব আক্ষেপ নেই। তবে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। ২০২৪ সালের ফ্রান্স অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়ের স্বপ্ন দেখি এবং সেই পথেই হেঁটে যেতে চাই। সেই সঙ্গে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই আমার পরিবারের প্রতি।
আমার মা সবসময় আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, তুমি পারবে মা, এগিয়ে যাও। মায়ের এই কথা আমাকে কতটা অনুপ্রেরণা জোগায় তা বলে বোঝাতে পারব না। এ ছাড়া ফেডারেশন ও কোচ জায়ের রেজাইয়ের অবদানও ভুলতে পারব না। ভুলতে পারব না বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সহযোগিতাকেও। আসলে পরিবার, ফেডারেশন, কোচ ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া আমি আজকের এই অবস্থানে আসতে পারতাম না। আগামীতেও সবার সহযোগিতা নিয়ে অলিম্পিকে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম সোনা জিততে চাই।'
কলির চোখে চোখ রেখে এমন স্বপ্ন আমরাও দেখতে পারি। আর বিশ্বাসও করি, অচিরেই ফুল হয়ে
ফুটবে কলি!
মন্তব্য করুন