বিশ্বকাপের সাদাকালো ইতিহাস
আর্জেন্টিনার মন্তি চলে যায় ইতালিতে
সঞ্জয় সাহা পিয়াল
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২২ | ০৫:৫১
উনিশ শতকের সেই ত্রিশের দশক- জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে খেলতে আসা থেকে শুরু। তার পর তো বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্ব রাজনীতিতে মুসোলিনি-হিটলারের দাপট- সবই দেখেছে বিশ্বকাপ ফুটবল। সাক্ষী থেকেছে ফুটবলের কিংবদন্তি পুসকাস, ক্রুয়েফ, পেলে, ম্যারাডোনা, প্লাতিনি, জিদান হয়ে বড় রোনালদোর পায়ে এই খেলাটার শৈল্পিক রূপ পাওয়ার। আর এসব নিয়েই বিশ্বকাপের গত শতাব্দীর কিছু চাপা পড়ে থাকা ইতিহাস তুলে আনার চেষ্টা করেছেন সঞ্জয় সাহা পিয়াল
ইতালি ১৯৩৪ :মুসোলিনির ভয়ে সবাই চুপ
উরুগুয়ে প্রথম বিশ্বকাপে কলার উঁচিয়ে বাকি বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছিল, ঠিকঠাক এগোলে অংশগ্রহণকারী সব দলের খরচ মিটিয়েও লাভ ভালোই হয়। তাই পরের বিশ্বকাপ যখন ইউরোপে চলে গেল, তখন একযোগে ৩২ দেশ আগ্রহী হয়ে উঠল অংশ নিতে। কিন্তু বাদ সাধল, ইউরোপের কোন দেশে হবে দ্বিতীয় আসর। ফ্রান্স ছিল ফ্রন্টলাইনে, কিন্তু ইতালির মুসোলিনি হম্বিতম্বি করতে শুরু করলেন। মুসোলিনির দেশকে বিশ্বকাপের দায়িত্ব দেওয়া যায় কিনা, দ্বিধায় ছিল ফিফা। আটবার বিশেষ বৈঠকের পর শেষ পর্যন্ত ১৯৩২-এর ফিফা কংগ্রেসে চূড়ান্ত হয়- ইতালিতেই বসবে পরের আসর। কিন্তু এবারে বেঁকে বসল উরুগুয়ে। তারা জানিয়ে দিল, আগেরবার তাদের সঙ্গে অসহযোগিতার প্রতিবাদে ইউরোপে বিশ্বকাপ বয়কট করবে। তাদের সাফ জবাব- তোরা আসিসনি যখন আমারও যাব না। সেবার আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলও দুই সপ্তাহের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইতালিতে যেতে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। অবশ্য উরুগুয়ের মতো যুক্তি নয়, তাদের কারণটা ছিল ভিন্ন। সেবার শুরু থেকেই ছিল নকআউট পর্ব, তাই শুধু একটি ম্যাচ খেলার জন্য এত টাকা-পয়সা খরচ করে ৮ হাজার মাইল পাড়ি দেওয়াটা তাদের কাছে ঝুঁকি মনে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত গেলেও ওই একটি করে ম্যাচ খেলেই জাহাজে উঠতে হয়েছিল লাতিনের ওই দেশকেই। অবশ্য সেবার আর্জেন্টিনা দলটিও ভেঙে গিয়েছিল।
ইতালির কোচ পেজো সে সময়কার নন্দিত কোচ। তাঁর দলে বেশ কয়েকজন বিদেশি খেলোয়াড় ভিড়িয়েছিল। বিশেষ করে আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডার লুইস ফিলিপ মন্তি। আগেরবার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে এই মন্তিই ফাইনাল খেলেছিলেন, তিনিই কিনা পরেরবার ইতালির হয়ে ফাইনালে অংশ নেন! এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের ইতিহাসে এই মন্তিই হলেন একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি কিনা দুটি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছেন দুটি ভিন্ন দলের হয়ে। মন্তি তখন জুভেন্তাসের হয়ে চারবার ইতালি লিগ জিতেছেন। ইতালি দলে তখন গুয়াইতো, স্কোপেলি, ওরসিদের সঙ্গে ব্রাজিল থেকে আসা ফিলো, উরুগুয়ের মাসেরোনিও খেলেছিলেন। বিদেশি খেলোয়াড় ভিড়িয়ে দল শক্তিশালী করার এই চেষ্টা দেখে অনেকেই ফিসফাস করেছিলেন, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলতে পারেননি মুসোলিনির ভয়ে। তখন এমন অনেক বিদেশি এসে ইতালি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতেন। ইতালিয়ান ভাষায় তাঁদের বলা হতো 'ওরিউন্দি'। ভিনদেশি এই খেলোয়াড়দের উদ্দেশে পেজো পরিস্কার বলে দিয়েছিলেন- 'তোমরা যদি ইতালির হয়ে মরতে পারো, তাহলে ইতালির হয়ে ফুটবলও খেলতে পারবে।'
সেবার ইতালির পাশাপাশি ফেভারিট ছিল অস্ট্রিয়া। তখন এ দুই দলের ম্যাচকে বলা হতো 'পেজো বনাম মেজেল'। দুই দলের দুই যুযুধন কোচ। অস্ট্রিয়াকে ১-০ গোলে কোনোরকম হারিয়ে ফাইনালে ওঠে ইতালি। ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে আসে চেকোস্লোভাকিয়া। ধুমধাড়াক্কা ওই ফাইনালে ২-১ গোলে জিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ হাতে পায় ইতালি। ইউরোপ তখন গর্ব করে বলতে শুরু করে- ফুটবলটা ইউরোপীয়রাই খেলে! ইংল্যান্ড কিন্তু তখনও নেই।