ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

বিশেষ কলাম

আমার বাজি আর্জেন্টিনা

আমার বাজি আর্জেন্টিনা

ফিলিপ লাম

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২২ | ২১:২৩

বিশ্বকাপে মরক্কোকে নিয়ে অনেক আলোচনাই হচ্ছে। আফ্রিকা ও আরব অঞ্চলের প্রথম দেশ হিসেবে সেমিফাইনাল উঠেছে তারা। ভৌগোলিকভাবে দেশটি উত্তর আফ্রিকার হলেও ফুটবলে ইউরোপের সংস্কৃতি। দলটির তারকা খেলোয়াড়দের মধ্যে আশরাফ হাকিমি খেলে প্যারিস সেন্ট জার্মেইনে, তার জন্ম মাদ্রিদে এবং রিয়ালের যুব দলে খেলেছে। মরক্কোর আরেক তারকা হাকিম জিয়েস নেদারল্যান্ডসে বেড়ে উঠেছে এবং আয়াক্সে খেলে খ্যাতি পেয়েছে।

স্পেনের আন্দালুসিয়া থেকে মরক্কোর উপকূল সহজেই চোখে পড়ে। দেশটি স্পেনের রন্ডো স্টাইলের ফুটবল রপ্ত করেছে। তাদের খেলোয়াড়রা ছিপছিপে গড়নের, নমনীয় শরীর এবং ফুটবল টেকনিকে ভালো। তারা নিষ্ঠার সঙ্গে রক্ষণভাগ আগলে রাখে আর সাহসের সঙ্গে প্রতিআক্রমণে যায়। মরক্কোর কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুই বলেছিলেন, 'আমাদের ইউরোপীয় ধাঁচের ফুটবল নকল করতে হবে এবং এর সঙ্গে নিজস্ব মূল্যবোধ যোগ করে খেলতে হবে।' মরক্কোর কোচের কৌশল খুবই সফল হয়েছে। শেষ ষোলোতে স্পেন এবং কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালকে হারিয়ে টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে তারা।

টুর্নামেন্ট থেকে স্পেন ও জার্মানি আগেই বিদায় নিয়েছে। শেষ আট থেকে বিদায় নিয়েছে ইংল্যান্ডও। আর ইতালি তো টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার সুযোগই পায়নি। বিশ্বকাপজয়ী ইউরোপের পাঁচ দলের চারটিই এখন বাড়িতে বসে বিশ্বকাপ দেখছে। এর পরও বলব, কাতার বিশ্বকাপে ইউরোপীয় ফুটবলেরই জয় হয়েছে। কারণ কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত ওঠা দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের প্রায় সবাই ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোতে খেলে। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক লিগে খেলে নিজেদের গড়ে তুলেছে।
আলাদা করে বলতে হয় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের কথা। লাতিন অঞ্চলের এই দুই জায়ান্ট দল দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বকাপ ট্রফি জিততে পারেনি। তবে তারা সব সময়ই শক্তিশালী দল হিসেবে টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছে। সুতরাং ফুটবলের বিশ্বটা আসলে কাতার আসরে বদলে যায়নি। মরক্কো এ আসরের বিস্ময় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যদিও আমার কাছে খুব বেশি বিস্ময়ের নয়। ফুটবলে এ ধরনের সারপ্রাইজ সবসময়ই দেখা যায় এবং সেটা ফুটবলের বিপুল আবেদনে নতুন পালক যোগ করে।

এই বিশ্বকাপে আমার বাজি আর্জেন্টিনা। তাদের খেলোয়াড়রা ফুটবলের মৌলিক বিষয়ে সিদ্ধ। যেমন- মাঠে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের সঙ্গে বল দখলে রাখার ব্যক্তিগত লড়াইয়ে (ওয়ান টু ওয়ান), রক্ষণাত্মক ও আক্রমণাত্মক কৌশল এবং আগ্রাসী ফুটবলও শৈল্পিকভাবে খেলায় পটু হয়ে উঠেছে তারা। এসব ব্যক্তিগত দক্ষতাগুলো ট্যাকটিস ও সিস্টেমের বিতর্কের আড়ালে চাপা পড়ে যায়। কিন্তু ফুটবলে জয় পেতে হলে অবশ্যই খেলোয়াড়দের মধ্যে গুণাগুণ থাকা প্রয়োজন। মাঠে মেসিদের নিঃশর্তভাবে সবটুকু নিংড়ে দেওয়ার বিষয়টি সবাই দেখেছে। নিবেদিত সমর্থকদের সঙ্গে দলকে এক সুতোয় গাঁথার কাজটি করতে পেরেছে আর্জেন্টিনা। আর সমর্থকরা মাঠে এমন একটি দলকে দেখতে পাচ্ছে, যে দলটি তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিবেদিত। তাদের পারফরম্যান্স দেখেই আপনি সেটা বুঝতে পারবেন, তারা কেন ফুটবল খেলছে।

আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্কালোনির নিয়ন্ত্রণে সব কিছুই। সাধারণত জাতীয় দলে শৃঙ্খলার শেকল হালকা হয়ে থাকে। কারণ খেলোয়াড়রা কদাচিৎ একসঙ্গে অনুশীলন এবং থাকার সুযোগ পায়। কিন্তু আর্জেন্টিনা দলটি যেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ক্লাবগুলোর মতো পারফর্ম করছে। তাদের পরিকল্পনায় থাকে ধারাবাহিকভাবে বলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ও প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ডদের প্রতিহত করা। এটা একটা রক্ষণাত্মক ধারণা, কিন্তু এটা নিজেদের সুরক্ষিত রাখার কৌশল। কারণ আর্জেন্টিনাও বল নিজেদের পায়ে রাখতে জানে, প্রতিপক্ষের পোস্টে পাল্টা হানা দিতে জানে।

এ ছাড়া ৩৫ বছর বয়সী লিওনেল মেসির অনন্য নৈপুণ্য কীভাবে পুরো দলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হয়, সে ব্যাপারটি জানেন স্কালোনি। এক সাক্ষাৎকারে স্কালোনি বলেছিলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরুর দিকে ইচ্ছাকৃতভাবেই মেসিকে দলে ডাকেননি। যেন তাদের সবচেয়ে বড় তারকাকে ছাড়াই একা পথ চলতে শিখতে পারে আর্জেন্টিনা। ছেলেরা মানের দিক থেকে একটা পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পর তিনি মেসিকে দলে টানেন। যাতে মেসির কাছ থেকে কিছু নেওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারে তারা।

২০১৪ সালে মারাকানা স্টেডিয়ামে আমাদের কাছে (জার্মানি) ফাইনালে হারের পর থেকেই আর্জেন্টিনা দলে রোমাঞ্চকর একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তখন মেসি শুধু তাদের (আর্জেন্টিনা দলের) নেতা ছিল। যে কোনো পরিস্থিতি বা সংকটে মেসির দিকেই তাকিয়ে থাকত আর্জেন্টিনা। যেন সব অবস্থায় ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হবে মেসি। তার কাঁধে ভর করেই উতরে যাবে। ২০২২-এর দলটি শুধু মেসির দিকে তাকিয়ে থাকে না। বরং এবার তারা মেসির জন্যই জান বাজি রেখে খেলছে। আর মেসিও তার বিদায় বেলাটা রাঙাতে নিজেকে নিংড়ে দিচ্ছে।



আরও পড়ুন

×