- খেলা
- ফেরার সিরিজেও কষ্ট কিনলেন মাশরাফি
ফেরার সিরিজেও কষ্ট কিনলেন মাশরাফি

চারদিকে সবুজ, মাঠের জমিনও। শুধু ধূসর মাটির গ্যালারি ছাড়া। অদূরের গ্যালারির টিলার মতো মাশরাফির মনের জমিনটিও কখন যেন রুক্ষ হয়ে উঠল। মাশরাফির এক জীবনের লম্বা ক্যারিয়ারে এতটা অভিমানী হতে কে কবে দেখেছে বা আদৌ দেখেছে কিনা, জানা নেই। গত ছয়-সাত মাসের নানা ঘটনায় বিরক্তির শিশিরবিন্দুগুলো হৃদয়ে জমাট বেঁধে কখন যে ক্ষোভের বরফপাহাড়ে রূপ নিয়েছে, খেয়ালই করেননি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ শুরুর ঠিক আগের দুপুরে সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন খেলা নিয়ে কথা বলতে। কিন্তু ১৮ মিনিটের সিংহভাগ সময় ধরে অবসর, ব্যর্থতা, ক্যারিয়ার শেষের প্রশ্নে জর্জরিত হলেন। ম্যাচ নিয়ে বলার সুযোগ পেলেন সামান্যই। একটি প্রশ্নে 'আত্মসম্মান' শব্দটি উঠতেই যেন ক্ষোভের বিস্ম্ফোরণ ঘটে। ধরে আসা কণ্ঠে বলে গেলেন, আত্মসম্মান বা লজ্জা পেতে হবে কেন? চুরি তো করছেন না, দেশের জন্য, মানুষের জন্য ক্রিকেট খেলছেন। হৃদয়ে রক্তঝরানো একগুচ্ছ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তবেই ড্রেসিংরুমে ফিরতে হলো তাকে।
বেশিদিন আগের কথা নয়, তাকে ছাড়া বাংলাদেশের ওয়ানডে দল কল্পনা করা যেত না। কত রকম বিশেষণে বিশেষায়িত করা হতো তাকে! সেই মাশরাফির বিদায় দেখতে কারও যেন তর সইছে না। অথচ বিপিএলে ঢাকা প্লাটুনের খেলা শেষে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে তিনি তো পরিস্কার করে বলে দিয়েছেন, অবসর নিয়ে ভাবছেন না। শরীর-মন সায় দিলে খেলা চালিয়ে যেতে চান। জোর করে যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলবেন, তাও নয়। বিসিবি ও জাতীয় দল নির্বাচকরা সুযোগ দিলে কেবল লাল-সবুজ জার্সিতে মাঠে নামবেন। অধিনায়ক মাশরাফির ওপর বোর্ড আস্থা রেখেছে, তাই সিলেটে খেলতে এসেছেন। এর পরও রাগ ও ক্ষোভ উৎপন্নকারী প্রশ্নগুলো জোঁকের মতো লেগে আছে তার পেছনে, যা প্রভাব ফেলতেও পারে তার মাঠের পারফরম্যান্সে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেছিলেন, ৮ মার্চ বোর্ডসভায় পরবর্তী ওয়ানডে অধিনায়ক ঠিক করা হবে। মাশরাফিকে নেতৃত্বে রেখে দেওয়া হবে না বাদ দেওয়া হতে পারে, তেমন কিছুই বলেননি তিনি। তবুও সিলেটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজটি অধিনায়ক মাশরাফির শেষ ধরে নেওয়া হচ্ছে। তাই গতকাল জানতে চাওয়া হলো এ সিরিজই তার নেতৃত্বের শেষ কিনা? উত্তরে নড়াইল এক্সপ্রেস বললেন, 'সেটা তো আমি জানি না। এটা নিয়ে বলার কিছু নেই। বলার থাকলে অবশ্যই বলতাম। বোর্ড সভাপতি যেটা বলেছেন, আপনারা তো সেটা জেনেছেনই। আমার মুখ থেকে শোনার আর কী দরকার।'
২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে কাঙ্ক্ষিত মানের পারফরম্যান্স করতে পারেননি মাশরাফি। আট ম্যাচে এক উইকেট ছিল তার। বিশ্বকাপজুড়েই ছোটখাটো চোট বয়ে বেরিয়েছেন। বিশ্বকাপ পরবর্তী শ্রীলংকা সফরে যেতে পারেননি চোটের কারণেই। সাত মাস পর আজ খেলতে নামছেন আরেকটি ওয়ানডে, যেখানে নিজের পারফরম্যান্স দেখানোর চ্যালেঞ্জ থাকবে। নিজের এবং দলের জন্য সেরাটা খেলতে উন্মুখ নড়াইল এক্সপ্রেস, 'পারফরম্যান্স প্রত্যেক খেলোয়াড়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেটা আমার জন্যও। মূল বিষয় হচ্ছে, দলের জেতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শেষ তিন-চারটি ওয়ানডেতে আমরা জেতার ভেতরে নেই। সুতরাং দলের জেতাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'
বাংলাদেশ শেষ ওয়ানডে সিরিজে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে শ্রীলংকার কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। মাঝের সাত মাস টেস্ট এবং টি২০ নিয়ে ব্যস্ত ছিল দল। লম্বা বিরতির পর ওয়ানডে ক্রিকেটে টাইগারদের ভালো করার তাড়া থাকবে। অধিনায়ক মাশরাফির জন্য সেটা আরও বেশি, 'আমি নিশ্চয়তা দিতে পারব না যে, আমি পারফর্ম করবই। এই নিশ্চয়তা বিশ্বের কেউই দিতে পারবে না। তবে একটা নিশ্চয়তা দেওয়া যায়, আমি শতভাগ চেষ্টা করব।' তবে এই প্রত্যাবর্তনের সিরিজকে প্রমাণ দেওয়ার মঞ্চ মনে করেন না টাইগার অধিনায়ক; বরং ক্রিকেট খেলতে চান দেশের জন্য, 'এতদিন কাউকে প্রমাণ দিতে ক্রিকেট খেলিনি, নিজের ক্রিকেট খেলেছি। আমি প্রমাণ করার জন্য ক্রিকেট খেলছি না। আমি বাংলাদেশের হয়ে খেলেছি, বাংলাদেশকে জেতানো প্রত্যেক খেলোয়াড়ের দায়িত্ব। সেরাটা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। সেটা আমার সব সময় চেষ্টা করি। নিশ্চয়তা তো কোনো খেলোয়াড়ই দিতে পারে না।'
একটা সময়ে জানতে চাওয়া হলো, টানা উইকেট না পাওয়ায় যে প্রশ্ন উঠছে তা আত্মসম্মানের কিনা? আর তাতেই অহমে আঘাত লাগল তার, 'আত্মসম্মান বা লজ্জা- আমি কি চুরি করি মাঠে? আমি কি চোর? খেলার সঙ্গে লজ্জা, আত্মসম্মান মিলাতে পারি না। এত জায়গায় এত চুরি হচ্ছে, চামারি হচ্ছে, তাদের লজ্জা নেই? আমি মাঠে এসে উইকেট না পেলে লজ্জা লাগবে! উইকেট না-ই পেতে পারি, আপনারা সমালোচনা করবেন, সমর্থকরা করবে, লজ্জা পেতে হবে কেন? আমি কি বাংলাদেশের হয়ে খেলছি, না অন্য দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলছি, যে লজ্জা পেতে হবে? লজ্জা, আত্মসম্মানবোধ কার সঙ্গে দেখাব? আমি বাংলাদেশের হয়ে খেলতে নামছি। আমি বাংলাদেশের মানুষের বিপক্ষের মানুষ না। আমার সমালোচনা করুক, কিন্তু ক্রিকেটে আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিতে আসিনি।' যদিও প্রশ্নকর্তা তাকে আঘাত দেওয়ার জন্য নয়, মর্যাদার বিষয়টি ফোকাস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে 'আত্মসম্মান' শব্দের সংযোজনে নেতার মনে রক্তক্ষরণ হয়ে বিষবাষ্পের বুদবুদের সৃষ্টি করে। আর তিনি হয়ে ওঠেন আহত, মর্মাহত।
মন্তব্য করুন