
তরঙ্গ থেকে তলিয়ে যায়নি তল। শুধু ক্ষণিকের জন্য স্থির হয়ে গিয়েছিল সব কিছু। স্তব্ধ হয়েছিল তার সরব উপস্থিতি। মুখ খোলা, তার পরও 'ক্রিকেট' নিয়ে কিছু বলতে পারেননি। হাত খোলা, তার পরও ব্যাট ধরতে পারেননি। প্রিয় মাঠে খেলা দেখতে যেতেও পারেননি। একলব্যের মতো নিষ্ঠাভরে আইসিসির সব ব্রত পালন করে, সব যন্ত্রণার রাত্রিগুলো পেছনে ফেলে সাকিব আল হাসান এখন মুক্ত এক বিহঙ্গ। গত সপ্তাহে নির্বাসন উঠে যাওয়ার পর গতরাতে দেশে ফিরেছেন।
কথা বলেছেন মন খুলে, জানিয়েছেন গত একটি বছর ক্রিকেটের বাইরেও সুন্দর একটি জীবন উপভোগ করেছেন তিনি। জীবনের দর্শনও বদলে গেছে তার অনেকটা- লকডাউনে বেড়ে ওঠা লম্বা চুলে এখন ঝুঁটি বাঁধতে হয়। আর পাঁচটা বাবার মতো তাকেও মেয়েকে স্কুলে আনা-নেওয়া করতে হয়। পরিবারের এই সুখী মুহূর্তগুলোর সঙ্গেই সাকিব ফের জুড়ে নিতে চান তার 'নিউ নরমাল ক্রিকেট' জীবনও। যেখান থেকে দাঁড়ি পড়েছিল, শুরুটা আবার সেখান থেকেই করতে চান। রাজার সিংহাসনে রাজার মতোই মুকুট পরে বসতে চান। তার এই ফিরে পাওয়া ক্রিকেট জীবনকে স্বাগতম।
সোনা যেমন আগুনে পুড়ে খাঁটি হয় তেমনি সাকিব পরিশুদ্ধ হলেন নিষেধাজ্ঞা ব্রত পালন করে। উদাসীনতা যে বড় ভুল বিগত এক বছরে নিশিদিন নিত্যনতুন উপলব্ধি দিয়ে জেনেছেন তিনি। গতরাতে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেছেন অন্য সাকিব। যার জীবন দর্শনে বিপ্লব ঘটে গেছে ৩৬৫ দিনের চক্রে। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে সে কথা বলেছেনও ৩৩ বছর বয়সী এ অলরাউন্ডার। সাকিবের জীবনেরই গল্প যেন এই যে নিউ নরমাল সময়। নিজের জীবনদর্শনে যুক্ত করেছেন নতুন এক অধ্যায়, ভালো ক্রিকেটারের পাশাপাশি ভালো মানুষ হওয়া। এই বদলে যাওয়া সাকিবকে বেশিরভাগ মানুষ স্বাগত জানাচ্ছেন। দূরের মানুষরা দূর থেকে ভালোবাসবেন তাকে। এ মুহূর্তে সাকিবের জন্য বেশি প্রয়োজন কাছের আলিঙ্গন। বিশেষ করে ড্রেসিংরুমের সতীর্থদের ভালোবাসা ও সমর্থন। মাঠের সতীর্থদের কাছ থেকে সাদর সম্ভাষণ পেলে চেনারূপে ফেরা সহজ হবে সাকিবের জন্য। দেশের ক্রিকেটেরই মঙ্গল নিহিত হবে তাতে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে সাকিব বলেছেন, আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়ার পর থেকেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বিশ্বকাপের মতো মেগা টুর্নামেন্ট খেলেছেন প্রচণ্ড মানসিক চাপ নিয়ে। শাস্তির ব্যাপারে তখনও জানতেন না। যেদিন জেনেছেন ললাটে নিষেধাজ্ঞার তিলক পরতে হচ্ছে, সেদিন খুবই মর্মাহত ছিলেন এ সব্যসাচী। হতাশা, দুঃখবোধে কিছুদিন অস্থির সময় পার করতে হয়েছে তাকে। ২৯ অক্টোবর আইসিসির দেওয়া শাস্তি মেনে নেওয়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না তার। আইসিসি দুর্নীতি দমন বিচার বিভাগের ঘোষিত রায় যে সাকিবকে চরম হতাশায় নিমজ্জিত করেছিল; যৌথ সংবাদ ব্রিফিংয়ে কান্নার লোনা জলের ধারায় তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। সেদিনের সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করে ক্রিকটে প্রত্যাবর্তন করছেন সাকিব।
বঙ্গবন্ধু কাপ টি২০ টুর্নামেন্ট দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে ফিরবেন বিশ্বসেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডার। ক্রিকেট সতীর্থদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি নতুনভাবে শুরু করবেন। যে ড্রেসিংরুমে গত এক বছর অবাঞ্ছিত ছিলেন তিনি। শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের উত্তরের ড্রেসিংরুমে হয়তো আগের আসনেই বসবেন সাকিব। তার ড্রেসিংরুম লকারও হয়তো এতদিন কেউ ব্যবহার করেননি। সেগুলোর সবই ফেরত পাবেন সিনিয়র ও চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার হওয়ার সুবাদে। কিন্তু সতীর্থদের সেই আস্থার জায়গা ফিরে পাবেন কিনা, বলা মুশকিল।
এমনই প্রাসঙ্গিক এক প্রশ্নের উত্তরে সাকিব বলেছেন, তিনি নিজেও কিছুটা সন্দীহান,? 'আসলে কার মনের ভেতরে কী আছে, বলা মুশকিল। সন্দেহ অবিশ্বাস তৈরি হতেই পারে। সেটা আমি কখনও অস্বীকার করি না। কিন্তু এর ভেতরে সবার সঙ্গেই আমার মোটামুটি যোগাযোগ ছিল, কথা হয়েছে। আমি কখনও ওভাবে অনুভব করিনি। আশা করি, তারা যেভাবে আমাকে বিশ্বাস করত এখনও সেভাবে বিশ্বাস করবে। এর পরও বলব, মনের কোণে এ ধরনের একটা সন্দেহ থাকতে পারে। এটা নিয়ে আফসোস করার কিছু নেই। তবে আমার ধারণা, আমার প্রতি তাদের যে বিশ্বাসটা ছিল সেটাই থাকবে।'
যদিও সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলেন, একবার বিশ্বাস হারালে তা ফিরে আসে না। সম্পর্ক গড়তে হয় নতুন করে। জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের বিভিন্ন সময়ের আড্ডায় এর প্রকাশও লক্ষ্য করা গেছে। এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের টানাপোড়েনের খেলায় সাকিব জিতে যেতে পারেন মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে। সে সামর্থ্য আছে তার। মাশরাফি বিন মুর্তজা একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সাকিবের সেরা ছন্দে ফেরার জন্য একটি-দুটি ম্যাচই যথেষ্ট। হয়তো তেমন কিছুই হবে। তবে ভালো দিক হলো, জাতীয় দলের বেশিরভাগ ক্রিকেটার সাকিবকে দূরে ঠেলে দেননি। গত বছর নভেম্বরে মাহমুদুল্লাহর নেতৃত্বে ভারত সফরে টি২০ ম্যাচ জিতে সাকিবকে উৎসর্গ করে সে প্রমাণও রেখেছেন তারা।
রকিবুল হাসান
আমি খুবই খুশি পুরো একটি বছর সে নীতিনৈতিকতার মধ্য দিয়ে চলেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় সে। গত এক বছর সাকিবের অভাবটা অনুভব করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সে ফিরে এসেছে, এটা অত্যন্ত সুখবর। একই সঙ্গে আমি চাইব, যারা এখন কিশোর-তরুণ তাদের যেন শিক্ষা দেওয়া হয় সাকিবের মতো ভুল যেন কেউ না করে।
নাজমুল আবেদীন ফাহিম
নতুন শুরুটা যেন আরও উজ্জ্বল হয়। সফলতা বাড়তে থাকে। যেভাবে বিগত সময়ে খেলেছে সেভাবে যেন খেলতে পারে। বিশ্বকাপে যে সাকিবকে আমরা দেখেছি সেই সাকিব থাকলে বিরাট পাওয়া হবে দেশের ক্রিকেটে। যদিও এ ধরনের খেলোয়াড়রা একটি গণ্ডির মধ্যে থাকে না। আমাদের আশা সে নিজেকে ছাপিয়ে যাবে। বিকেএসপিতে যেভাবে অনুশীলন করেছে আমরা তাকে যেভাবে দেখেছি তাতে ভালো কিছু আশা করা যেতেই পারে।
মোহাম্মদ সালাউদ্দিন
সাকিব খেলার জন্য মুখিয়ে আছে। এক বছর যে খেলতে পারেনি, তাতে তার ক্ষুধা আরও বেড়ে গেছে। সাকিব এমন একজন খেলোয়াড় সে জানে কীভাবে নিজেকে তৈরি করতে হয়। বিকেএসপির অনুশীলনে এতটা একাগ্র ছিল যে, দেখে মনে হয়েছে, সরাসরি আন্তর্জাতিক ম্যাচে নামলেও সমস্যা হতো না। ওর জন্য আমরা শুভকামনা থাকল।
মন্তব্য করুন