ঢাকা সোমবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩

আহমেদাবাদ কি মারাকানাকেও হার মানাল

আহমেদাবাদ কি মারাকানাকেও হার মানাল

ম্যাচ শেষে ড্রেসিংরুমে হতাশ ভারতীয় ক্রিকেটাররা। ছবি: টুইটার

Advertisement
Advertisement

সঞ্জয় সাহা পিয়াল, আহমেদাবাদ থেকে

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৩ | ১৮:১৪

অসম্ভব কাতর করুণ একটা দৃষ্টি। ভেঙে যাওয়া বিশ্বাসের আঘাত, অসহায়তা, ক্লান্তি, অনুশোচনা– সব মিলেমিশে গেলে যেমনটা হয় আরকি। তেমনই এক রাহুল দ্রাবিড়কে আবিষ্কার করা গেল ম্যাচ শেষে মাঠের এক কোনায়। আর গোটা গ্যালারিতে তখন বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নমৃত্যুর পর শোকের নিস্তব্ধতা! কে দেখবে রাতের আকাশের ড্রোন শো, কে-ই বা আন্দোলিত হবে বলিউডের হিন্দি গানে– অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৬ উইকেটে হেরে সব আনন্দ আয়োজন তখন বৃথা ভারতকে ছাড়া। নীল সমুদ্রকে বিষাদে ভাসিয়ে মাঠে তখন অসিদের হেক্সা মিশনের আপন উল্লাস। 

১৯৮৭, ১৯৯৯,২০০৩, ২০০৭, ২০১৫’র পর ২০২৩ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। পাশে বসা মেলবোর্নের সাংবাদিক তাসমানপাড়ে ফোন করে ঐতিহাসিক খবরটি দিয়েই শুভ সকাল জানাচ্ছিলেন পরিবারকে। এদিকে গোটা গ্যালারিতে তখন বোবা কান্না। ট্রাভিস হেডের ধরা রোহিতের সেই ক্যাচই বোধ হয় লেখা হয়ে যায় ফাইনালে ভারতের কপাললেখন। খেলাধুলার ইতিহাসে এমনই এক ট্র্যাজেডির গল্প রয়েছে ফুটবল বিশ্বকাপে। 

১৯৫০ সালের রিও ডি জেনেরিওর মারাকানায় প্রায় দুই লাখ দর্শকের সামনে ঘরের দল ব্রাজিল খেলতে নেমেছিল উরুগুয়ের বিপক্ষে। উৎসবের সব আয়োজন তৈরিই ছিল, সবাই ধরে নিয়েছিল ফেভারিট ব্রাজিলই জিতবে, না হয় ড্র করবে; হেরে যাওয়ার কথা তাদের মনেও আসেনি। ইতিহাসে ৭০ বছর আগের সেই ট্র্যাজেডি ‘মারাকানাজো’ নামেই পরিচিত। টানা ১০ ম্যাচ জয়ের পর ফাইনালে এসে ৯২ হাজার ৪৫৩ দর্শকের সামনে ভারতের এই হারকে তাহলে কী বলা যায়? আপাতত ‘আহমেদাবাদ ট্র্যাজেডি’ বললে বোধ হয় কেউ আপত্তি করবে না।

আসলে যার বা যাদের ভুল হয় না, তাদের ভুলগুলো হয় মারাত্মক। এদিনের ফাইনালেও পিচের ভাষা বুঝে ব্যাটিং করতে পারেনি। ভারতের ছয় ও সাত নম্বরের দুই ব্যাটার রবীন্দ্র জাদেজা এবং সূর্যকুমার যাদব ফাইনালের পরীক্ষায় দলকে ভরসা দিতে পারেননি। প্রত্যাশার চেয়ে স্লো ছিল মোদির মাঠের এই পিচ। সেখানে শুরুতে ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা যে শুরুটা দিয়েছিলেন, যে গতিতে ১০ ওভারে ৮০ রান উঠে গিয়েছিল; পরের ব্যাটারদের মধ্যে বিরাট কোহলি ছাড়া সেভাবে আর কেউ পিচের ভাষা বুঝতে পারেননি।

মন্থর পিচে একটা অলিখিত ‘স্পিড ব্রেকার’ ছিল এই পিচে, যা কিনা প্রচণ্ড গতিতে ছোটা এই বিশ্বকাপে ভারতীয় ব্যাটারদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আগের দশ ম্যাচে প্রথম পাঁচ ব্যাটার এতই ভালো করেছিলেন, কখনও ছয় ও সাত নম্বর ব্যাটিং পজিশনে থাকা ব্যাটারদের পরীক্ষায় পড়তে হয়নি। এদিন হার্দিক পান্ডিয়ার অভাবটা বেশ টের পেয়েছেন রোহিত। সেই সঙ্গে একাদশে অশ্বিনের অনুপস্থিতিটাও। সূর্যকুমার যাদব আইপিএলের খেলোয়াড়, সাধারণত বলের পেস কাজে লাগিয়ে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে থাকেন। কিন্তু এদিন তাঁকে আটকানোর জন্য হ্যাজেলউডরা স্লোয়ার বেছে নিয়েছিলেন। ডিপথার্ডম্যানে ফিল্ডার রেখে তাঁর অস্বস্তির জায়গাটি সবার সামনে বের করে এনেছিলেন। আসলে বেশ গুছিয়ে, সূক্ষ্ম সব কৌশলে ফাইনাল খেলতে নেমেছিল অস্ট্রেলিয়া।

শুরুতেই টস জেতা দিয়ে যার শুরু। রাতে শিশিরের কারণে বল গ্রিপ করতে বোলারদের সমস্যা হয়। এটা তারা বেশ ভালোভাবেই জানত। অসি অধিনায়ক প্যাট কামিন্স এটাও জানতেন, আগের রাতে মাঠের আউটফিল্ডে কেমিক্যাল স্প্রে করা হয়েছিল, শিশিরের প্রভাব কমানোর জন্য। কিন্তু সেদিকে প্রলুব্ধ না হয়েই তিনি প্রথমে বোলিং বেছে নিয়ে মিচেল স্টার্ক ও জশ হ্যাজেলউডকে দিয়ে মারমুখী রোহিতকে আউট করেছিলেন ম্যাক্সওয়েলকে এনে। 

ওই সময় চার বলের মধ্যে রোহিত আর শ্রেয়াস আয়ার আউট হতেই ম্যাচের রং বদলে যায় অনেকটা। গ্যালারির নীল সমুদ্রের গর্জনও যেন থেমে যায়। এর পর বিরাট কোহলি ও কেএল রাহুল মিলে পিচের ওই স্পিড ব্রেকারের ঝাঁকুনি এড়িয়ে দেখেশুনেই পার হচ্ছিলেন। কোহলি তাঁর ৫০ পূরণ করেছিলেন ৩২ রান দৌড়ে নিয়ে। তবে প্যাট কামিন্সের গতিতে বিভ্রান্ত হয়ে ব্যাটের কানায় লাগা একটি বলে বোল্ড হয়ে যান তিনি। তার পর থেকে যেন নিজেকে আরও বেশি গুটিয়ে নেন কেএল রাহুল। রেকর্ড বলছে, দশ ওভারের পর থেকে টানা ৯৭ বল পর্যন্ত কোনো বাউন্ডারি পায়নি ভারত। কেএল রাহুল তাঁর ১০৭ বলে ৬৬ রানের ইনিংসে বাউন্ডারি মারার সাহস দেখিয়েছেন মাত্র একবারই। আসলে তিন অসি পেসারই এদিন নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে বোলিং করে গেছেন। 

অধিনায়ক প্যাট কামিন্স কথা রেখেছেন উন্মুখ গ্যালারির মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে। আগের দিন তিনি বলেছিলেন, ১ লাখ ৩২ হাজারের গ্যালারিকে চুপ করানোর মধ্যেই আনন্দ রয়েছে। এদিন শ্রেয়াস আয়ার ও কোহলির উইকেট নিয়ে সত্যিই ঠান্ডা করে দিয়েছিলেন মাঠে বসে থাকা নীল জার্সিধারীদের। গোটা দশ ওভারের কোটা সম্পূর্ণ করা কামিন্স এদিন একটি বাউন্ডারিও দেননি। কাটার করেছিলেন বেশ কয়েকবার। পুরোনো বলে কিছু রিভার্স সুইং করেছিলেন হ্যাজেলউডও। সেই অস্ত্রেই ঘায়েল করেছিলেন জাদেজাকে। জাম্পা তাঁর সেরাটা দিয়েছিলেন মাত্র একটি বাউন্ডারির খরচে। এদিন ভীষণভাবে প্যানিকড হয়ে পড়েছিল ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ। শেষ পর্যন্ত টেনেটুনে ২৪০ রান করতে পারে তারা।

সে সময় প্রেস বক্সের এক গুজরাটি সাংবাদিক জানালেন, মোদিজি মাত্রই শহরে পা রাখলেন। মাঠে আসবেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই। এমনিতে শাহরুখ, দীপিকাদের নিয়ে বলিউডের সরব উপস্থিতিই ছিল গ্যালারিতে। ইনিংস বিরতির মাঝে নাচগানও ছিল। কিন্তু তার কিছুই উপভোগ করেনি আহমেদাবাদ। দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর পর মোহাম্মদ শামির প্রথম ওভারেই ওয়ার্নারকে ফিরিয়ে দেওয়া এবং বুমরাহর বলে স্মিথের এলবিডব্লিউ হওয়ার সময় কিছুক্ষণের জন্য বিস্ফোরিত হয়েছিল লাখো দর্শকের হর্ষধ্বনি। ৪৭ রানের মধ্যে ওয়ার্নার, মিচেল মার্শ ও স্মিথ ফিরে যাওয়ায় একটা হাড্ডাহাড্ডি সমাপ্তির গন্ধ ছড়াচ্ছিল প্রেস বক্সেও। কেউ একজন তথ্য দিয়ে সাহায্য করলেন, ১৯৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে ১৮৩ রান করেও জিতেছিল ভারত। আরেকজন পাশ থেকে বলে উঠলেন– গত বিশ্বকাপে এই একই রান তাড়া করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইংল্যান্ড। সুতরাং, যা হওয়ার তাই হলো। 

শিশিরভেজা মাঠে কুলদীপ-সিরাজরা বল বারবার মুছেও সফলতার কোনো সূত্র খুঁজে পেলেন না। ওদিক থেকে অনেকটা নীরবেই চারের বন্যা বইয়ে দিয়ে ৯৫ বলে সেঞ্চুরি করে বসলেন ট্রাভিস হেড। গ্যালারির দিকে ব্যাট উঁচিয়ে উদযাপন করলেন, কিন্তু হাততালিতে সাড়া পেলেন না। মূলত তাঁর মাথায় চড়েই শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার মিশন হেক্সা সম্পন্ন হলো। ১৯৮৭ সালের পর আবারও ভারতের মাটি থেকে বিশ্বকাপ নিয়ে গেল অসিরা। পুরস্কার মঞ্চ ও মনখারাপের গ্যালারিকে সঙ্গে নিয়েই তারা ট্রফি হাতে উল্লাস করলেন। 
শুধু বিশ্বাস ভঙ্গের বেদনায় সান্ত্বনা খুঁজল ভারতীয়রা। একটা না একটা ম্যাচ তো হারতেই হয়– মনে এমন একটা ধারণা সেই শুরু থেকেই ছিল যাদের, তারাই এদিন প্রেস বক্সে বলতে থাকলেন– তাই বলে সেটা ফাইনালেই! ১২ বছর অপেক্ষার পর ট্রফি জেতার যে সুযোগ এসেছিল ভারতের সামনে, সেই প্রতীক্ষা বাড়ল আরও। ২০০৩ সালের পর ২০২৩– আরও একটি হদয়ভাঙা ফাইনালের সাক্ষী থাকল তারা।

আরও পড়ুন