সেটা ছিল ফাইনাল, এবার তার আগের ধাপ। রং চড়ছে কিন্তু আড়াই বছর আগের লর্ডসের গৌরবময় সেই ফাইনালকে কেন্দ্র করেই। সেই স্মরণীয় বিকেলে লর্ডসে যে নাটকের পর নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল, তার ছিটেফোঁটাও যদি আবুধাবিতে ইংল্যান্ড বনাম নিউজিল্যান্ড ম্যাচে হয়, তাহলেই টি২০ বিশ্বকাপ ঘিরে উন্মাদনা তুঙ্গে পৌঁছে যাবে। ক্রিকেটপ্রেমীরাও তেমন একটি দম বন্ধ ম্যাচের প্রতীক্ষায়। যদিও সেমির আগে ইংল্যান্ড শিবির কিছুটা চোটাক্রান্ত। এর পরও ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন ইয়ন মরগানের দলই ফেভারিট। নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনও নিজেদের 'আন্ডারডগ'ই মনে করছেন। তাই বলে আপসেট ঘটানোর আশা ছাড়ছেন না তিনি। আবুধাবিতে লর্ডসের প্রতিশোধ নিয়ে ১৪ নভেম্বর দুবাইয়ের ফাইনালে জায়গা করে নিতে চান উইলিয়ামসন।

২০১৯ সালের ১৪ জুলাই বিকেলে ক্রিকেট তার সব রং নিয়ে হাজির হয়েছিল লর্ডসে। নাটকের পর নাটকে দর্শকদের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলেও ক্লাইম্যাক্স শেষ হচ্ছিল না। ৫০ ওভারের পর সুপার ওভারেও টাই হয়েছিল স্কোর। সুপার ফাইনালে শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাউন্ডারি বেশি মারায়। সেই শিরোপা ইংল্যান্ডকে যেন আরও আগ্রাসী করে তুলেছে। বিশেষ করে টি২০ ফরম্যাটে তারা যে ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলে, তা বিরল। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গুঁড়িয়ে দিয়ে এবার সুপার টুয়েলভ সূচনা করে তারা। এরপর বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়াও তাদের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তারা টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে কয়েকটি উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে গেলেও বাটলার দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করে দলকে উদ্ধার করেন। এই ম্যাচ দিয়ে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং গভীরতারও প্রমাণ মেলে। শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হেরে গেলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে মরগানের দল। ইংলিশদের এই দাপটের অন্যতম কারিগর ওপেনার জেসন রয় সেমির আগে ছিটকে গেছেন। তার বদলি হিসেবে জেমস ভিন্সকে নেওয়া হয়েছে। তাদের পেস বোলিংয়ের প্রধান অস্ত্র তাইমাল মিলসও ছিটকে গেছেন।

ইংল্যান্ডের তুলনায় কিউইরা অবশ্য এতটা দাপট দেখাতে পারেনি। প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের কাছে হেরে যায় তারা। পরের ম্যাচেই হটফেভারিট ভারতকে হারিয়ে সেমির দৌড়ে এগিয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। তাদের সামনে শেষ বাধা ছিল আফগানিস্তান। ঠান্ডা মাথায় নিখুঁত ক্রিকেট খেলে আফগান-বাধা টপকে ভারতের হৃদয় ভেঙে সেমিতে নাম লেখায় নিউজিল্যান্ড। নিজেদের আন্ডারডগ মনে করলেও ভীষণ ধারাবাহিক কিউইরা। আইসিসির সর্বশেষ চার টুর্নামেন্টের শেষ চারে খেলেছে তারা। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে হারের পর গত জুলাইয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে কিউইরা। আজকের সেমিতে কিউইদের খানিকটা নির্ভার থাকার আরেকটা কারণ হলো, ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালের দুই নায়ক বেন স্টোকস ও জোফরা আর্চার নেই ইংল্যান্ড দলে।

তার পরও ইংল্যান্ড এগিয়ে থাকবে তাদের 'পাওয়ার প্যাকড' টপঅর্ডারের জন্য। যার নেতৃত্বে আছেন দুরন্ত ছন্দে থাকা ওপেনার জস বাটলার। চলতি বিশ্বকাপের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান এই ইংলিশ ওপেনার রান সংগ্রহে শীর্ষে থাকা বাবর আজমের পেছনেই রয়েছেন। এ ছাড়া ডেভিড মালান, জনি বেয়ারস্টো এবং লিয়াম লিভিংস্টোনের মতো বিগ হিটার আছে তাদের দলে। অধিনায়ক ইয়ন মরগার অতীতের সেই বিধ্বংসী ফর্মে না থাকলেও প্রয়োজনের সময় ঠিকই হাল ধরছেন। তবে ইংল্যান্ডের তুরুপের তাস হলেন মঈন আলি। বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার দলের প্রয়োজনে টপঅর্ডারে নেমে উড়ন্ত সূচনা এনে দিচ্ছেন, আবার ফিনিশার হিসেবেও কার্যকর ভূমিকা রাখছেন। সে সঙ্গে স্পিনেও উইকেট তুলছেন নিয়মিত। ওপেনার জেসন রয় ও পেসার তাইমাল মিলস ছিটকে যাওয়ার পরও ইংল্যান্ডকেই এগিয়ে রাখছেন কিউই অধিনায়ক উইলিয়ামসন, 'তারা দুজনই ইংল্যান্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। টুর্নামেন্টের মাঝপথে এমন দুই জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের চোটে পড়া দুঃখজনক। তার পরও আমি বলব, তারা ভীষণ শক্তিশালী একটি দল। ব্যাটিং গভীরতা ও বোলিং বৈচিত্র্যের জন্যই বছরের পর বছর তারা দারুণ পারফর্ম করছে। আর চোটাক্রান্ত দুই জনের অভাব পূরণ করার মতো যথেষ্ট মানসম্পন্ন ক্রিকেটার তাদের দলে রয়েছে।' একই সঙ্গে কিউই পেস আক্রমণের প্রশংসা করেছেন তিনি, 'তারা দুর্দান্ত। আমাদের জন্য দারুণ কাজ করছে। ভিন্ন ভিন্ন কন্ডিশনে মানিয়ে নিয়ে পারফরম্যান্স দিয়ে আমাদের আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা। আমাদের শক্তির জায়গা হলো এই পেস আক্রমণ।'

তবে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিতে নিজেদের ফেভারিট মানতে নারাজ ইংল্যান্ড অধিনায়ক ইয়ন মরগান। গতকালের সংবাদ সম্মেলনে কিউইদের সমীহই করেছেন তিনি, 'আমি নিজেদের হটফেভারিট বলতে পারছি না। নিউজিল্যান্ড পূর্ণ শক্তি নিয়ে মাঠে নামবে। তারা কতটা ভালো ও ধারাবাহিক, সেটা আমরা জানি। তাদের হারাতে হলে আমাদের নিজেদের সেরাটা খেলতে হবে। তবে চ্যালেঞ্জ নিতে আমরা মুখিয়ে আছি।' একই সঙ্গে জেসন রয়কে হারানোর জন্য আক্ষেপও করেন তিনি, 'জেসন রয়ের মতো অভিজ্ঞ একজনকে হারানোর দলের জন্য বড় ক্ষতি। তার বদলি সম্ভব নয়। আমাদের গত দুটি বিশ্বকাপে সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।'

সন্ধ্যার পর শিশির পড়ার কারণে এবারের বিশ্বকাপে টসজয়ী দল প্রথমে বোলিং করে নিতে চায়। অধিকাংশ ম্যাচে রান তাড়া করা দলই জয়ী হয়েছে। এ ম্যাচেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা কম, টস জয়ী দল ফিল্ডিংই নেবে। কাগজে-কলমে এগিয়ে থাকার পাশাপাশি দুই দলের ইতিহাসও ইংল্যান্ডেরই পক্ষে। দু'দলের ২১ মোকাবিলায় ইংল্যান্ড জিতেছে ১৩ ম্যাচে, কিউইদের জয় ৭টি, একটি ম্যাচ পরিত্যক্ত।