
রেল ভবনের সামনে সোমবার দুপুরে শিশু ফুটবলারদের জটলা -সমকাল
শরীরে জার্সি। সবাই খেলোয়াড়। রাজধানীর রেল ভবনে সোমবার দুপুরে জনাদশেক শিশু ফুটবলারের জটলা দেখে চোখ স্থির। কান পাততেই ভেসে এলো ট্রেনের টিকিটের জন্য 'হাউকাউ'। টিকিটের বেচাকেনা তো কমলাপুর রেলস্টেশনে! তারা রেল ভবনে কেন? জানা গেল, তারা ফুটবল বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে কাতার! এবার চক্ষু চড়কগাছ! কাতারে নভেম্বরেই ফুটবল বিশ্বকাপ। বাংলাদেশ তো ফুটবল বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জনের স্বপ্নেও নেই। তাহলে এই কন্যাশিশুর দল কারা?
ব্যাপারটা খোলাসা করলেন ওই শিশুদের 'বাবা' সোহেল রানা। তিনি লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (লিডো) ব্যবস্থাপক। এই শিশুদের রেল ভবনে এনেছেন সোহেল। জানালেন, আগামী ৫ থেকে ১৫ অক্টোবর কাতারের দোহাতে অনুষ্ঠিত হবে পথশিশুদের ফুটবল বিশ্বকাপ। মেয়েদের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী ১২ দেশের একটি বাংলাদেশ। প্রস্তুতি নিতে কক্সবাজারে যাবে শিশুর দল। সে জন্যই চট্টগ্রাম পর্যন্ত ট্রেনের টিকিট দরকার।
সোহেল জানান, ৬৭ শিশু ও লিডোর কর্মকর্তারা মিলে চট্টগ্রাম যাবেন। রেলের কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছেন, টিকিটের ব্যবস্থা হবে। রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী বলেন, বিধি অনুযায়ী এই শিশুদের জন্য ট্রেন ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হবে।
জানা যায়, লিডো ৩৭টি ছেলেশিশু ও ৩২টি মেয়েশিশুর দেখভাল করে। তাদের কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাটসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে খুঁজে বের করা হয়েছে। এসব শিশু এখন থাকে বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জের ওয়াশপুরে লিডোর হোমে। এদের কারও মা-বাবা থেকেও নেই। হয়তো মা মারা গেছেন; বাবা করেছেন আরেক বিয়ে, তিনি সন্তানের রাখেন না খোঁজ। আবার কারও বাবা নেই। মায়ের অন্যত্র বিয়ে হওয়ায় সন্তানের দেখভাল করতে পারেন না। এই সোহেল রানাই এখন শিশুদের 'বাবা'।
সোহেল রানা আরও জানান, লিডোর হোমের শিশুরা স্কুলে যায়। অবসরে খেলাধুলা করে। ২০১৯ সালে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলতে চারজন ছেলে ও চারজন মেয়ে গিয়েছিল যুক্তরাজ্যে। সেবার ভারতের কাছে সেমিফাইনালে হেরেছিল বাংলাদেশ দল। এবার ১১ কন্যাশিশু যাবে কাতার। আন্তর্জাতিক সংস্থা 'স্ট্রিট চাইল্ড ইউনাইটেড' বিশ্বকাপের আয়োজক।
রেল ভবনে আসা শিশুদের মধ্যে ১১ বছর বয়সী আলিয়া ও ১৩ বছর বয়সী রিপা দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। পরিবার বা নিজেদের জীবন সম্পর্কে বলতে নারাজ তারা। সোহেল বললেন, 'এই শিশুদের দুঃখ-দুর্দশা ছাড়া বলার মতো কিছু নেই। কারও কারও জীবনে ঘটেছে নানা ভয়ংকর ঘটনা। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চায় না বলে নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে চাইছে না তারা।'
স্ট্রিট চাইল্ড ইউনাইটেডের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, মেয়েদের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ, ব্রাজিল, বলিভিয়া, সুদানের দারফুর, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, ফিলিস্তিন, পেরু, ফিলিপিন্স, যুক্তরাষ্ট্র ও জিম্বাবুয়ের পথশিশুরা খেলবে। ছেলেদের বিশ্বকাপে খেলবে ব্রাজিল, বুরুন্ডি, ইংল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ভারত, মরিশাস, নেপাল, পাকিস্তান, ফিলিপিন্স, কাতার, তানজানিয়া ও উগান্ডার পথশিশুরা।
শিশুমনে দুঃখ না দিতে অতীত ও পরিবারের কথা বাদ দিয়ে ফুটবল নিয়ে চলে আলোচনা। আলিয়া, রিপার সঙ্গে বাকিরা একসুরে বলে উঠল, তারা খেলতে পারে। নিয়মিত অনুশীলনও করে। কে কোন পজিশনে খেলে, তা নিয়ে এত ভাবনা নেই। সবাই একসঙ্গে থাকছে, পড়াশোনা করছে; এখন বিদেশে খেলতে যাচ্ছে। তবে সুযোগ, মমতা ও সমতা পেলে প্রমাণ করবে- তারা কারও চেয়ে কম নয়। বিশ্বকাপেই তার প্রমাণ হবে। লিডোর নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন বলেন, 'গত ১৬ মাসে তারা পাঁচ শতাধিক পথশিশুকে তুলে এনেছেন। এর মধ্যে দুই শতাধিক শিশুকে পরিবারের কাছে পাঠানো হয়েছে। একটি অংশকে পুনর্বাসন করা হয়েছে সরকারের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে। যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা হয়নি, তারা আছে লিডোর হোমে।'
মন্তব্য করুন