'চোরাবালির মতো ডিপ্রেশন, মুক্তির পথ নেই, গ্রাস করে নিচ্ছে জীবন, মেনে নিতে পারছি না'- এ রকমই ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া তাবাসসুমের সুইসাইড নোট। মনে এক বুক হতাশা নিয়ে গত ১০ মে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে নিজ বাড়িতে তিনি গলায় ফাঁস দেন।

'জীবনের কাছে হার মেনে গেলাম। আমি আর পারলাম না'- ফেসবুকের দেয়ালে এভাবেই কষ্টের শব্দমালা লিখে স্বেচ্ছায় এ চেনা ভুবন ছাড়েন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্র সোহাগ খন্দকার। গত ৮ এপ্রিল রাতে তিনি নীলফামারীর সৈয়দপুরে নিজ বাসায় গলায় গামছা পেঁচিয়ে জীবনের গল্পের ইতি টানেন।

শুধু কি সাদিয়া-সোহাগ! গেল ছয় বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত আট শিক্ষার্থী ও এক শিক্ষক আত্মহননের পথে পা বাড়িয়েছেন। আত্মহত্যার এই মিছিলে শেষ যোগ দিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রী জান্নাতুল মাওয়া দিশা। গত সোমবার তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয় রাজধানীর আদাবরে স্বামীর বাসা থেকে। মানসিক অশান্তি ও হতাশার কারণেই ঘটেছে এসব আত্মহত্যার ঘটনা। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরও হতাশা ও দুশ্চিন্তা বাড়ে বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা। তাঁদের ধারণার সত্যতাও মেলে কিছুটা; করোনা যুগেই আত্মহত্যা করেছেন রাবির চার শিক্ষার্থী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাদিয়া তাবাসসুম ও সোহাগ খন্দকারের আত্মহত্যার আগে গত ২৩ সেপ্টেম্বর যশোরে নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র ইমরুল কায়েস। দীর্ঘদিনের হতাশা এবং পরিবারের সঙ্গে অভিমানের জেরে আত্মহত্যা করেন তিনি। একই বছরের ৪ জুন শ্বশুরবাড়িতে পারিবারিক কলহের জেরে আত্মহত্যা করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী তানমিরা খাতুন। গত বছরের ৩১ জানুয়ারি ছাত্রী হলে মেলে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মোবাসসিরা তাহসিন ইরার লাশ। প্রেমের পর হতাশায় ডুব দিয়ে নিজেকে শেষ করে দেন বলে সে সময় তাঁর ভগ্নিপতি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন।

২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর পটুয়াখালীর নিজ বাসা থেকে নৃবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র দেবজ্যোতি পার্থর লাশ গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর উদ্ধার করা হয় ফলিত গণিত বিভাগের ফিরোজ কবীরের ফাঁস দেওয়া লাশ। পরীক্ষা খারাপ হওয়ায় ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি নিজ কক্ষে গলায় ফাঁস দেন ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী সুব্রত কুমার। একই বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি নগরীর শিরোইল এলাকায় ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন এগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের শিক্ষার্থী ফারজানা আফরোজ।

এ ছাড়া ২০১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনে নিজ কক্ষে আত্মহত্যা করেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আকতার জাহান জলি।
আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজির আহম্মদ তুষার বলেন, করোনা শুরুর পর থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেড়েছে হতাশা। দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়েছে। এখন হঠাৎ ক্যারিয়ার নিয়ে এগোতে গিয়ে অনেকে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। আবার দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকায় শিক্ষার্থী অনেকের মধ্যে একাকিত্ব বেড়েছে। ফলে এখন ক্যাম্পাসে এসে তারা বন্ধুবান্ধব, ক্লাসসহ অন্য পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না। আবার করোনার কারণে অনেক শিক্ষার্থী তাদের আয়ের উৎস টিউশনিও হারিয়েছে।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁরা ঠিকমতো কাউন্সেলিং পেয়েছেন তাঁরা ভালোভাবে ফিরে আসছেন। আর যাঁরা কাউন্সেলিং পাননি, তাঁদের ডিপ্রেশন লেভেল বেশি মাত্রায় রয়েছে। তাঁরাই এসব অপ্রত্যাশিত ঘটনা বেছে নিচ্ছেন।
এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মানসিক চিকিৎসা নিতে আসা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা। তবে সুযোগ-সুবিধা ও প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন দায়িত্বরতরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে নতুন করে ৯ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী চিকিৎসা নিতে আসেন। প্রায় ৪২ হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিচালকসহ তিনজন মনোবিজ্ঞানী রয়েছেন। আর তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন একজন ইন্টার্ন কো-অর্ডিনেটর, যা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। এ ছাড়াও মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দায়িত্বরত সবাই অবৈতনিক দায়িত্ব পালন করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আনওয়ারুল হাসান সুফি জানান, বর্তমানে বিভিন্ন বিভাগের ২৬ জন শিক্ষক তাঁদের সঙ্গে নানা সমস্যা বিষয়ে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন।

তিনি বলেন, এখানে যাঁরা আছেন তাঁরা সবাই অবৈতনিক দায়িত্ব পালন করছেন। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি এখনই গুরুত্ব না দিলে পরিণতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন দক্ষ মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেওয়া, যাঁরা সার্বক্ষণিক এখানে চিকিৎসা দেবেন।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান উল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিকল্পনায় মানসিক চিকিৎসার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। সে জন্য আমাদের শিক্ষার্থী ও এখানে কর্মরত সবার মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় নিয়ে গ্রহণ করা হচ্ছে নানা উদ্যোগ।

তিনি বলেন, দ্রুতই প্রশাসন এ নিয়ে সভা করবে। পরে বিভিন্ন বিভাগ ও ক্যাম্পাসের সংগঠনগুলোর কাছ থেকে পরামর্শ চাইবে প্রশাসন।