তাঁর বিচক্ষণ নেতৃত্ব এবং কঠোর পরিশ্রমে বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলে এত বড় সাফল্য এসেছে। মেয়েদের ফুটবলের জন্য বছরের পর বছর ব্যক্তিগতভাবে অর্থ দিয়েছেন বাফুফে নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরন। হিমালয়ের দেশে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানো সাবিনা খাতুন-কৃষ্ণা রানী সরকারদের নিয়ে তাঁর অনেক বড় স্বপ্ন। শুক্রবার সেই স্বপ্নের কথা এবং নারী ফুটবলে নিজের ত্যাগের কথাগুলো বলেছেন সমকালের সঙ্গে। তা শুনেছেন সাখাওয়াত হোসেন জয়
সমকাল: মেয়েদের হাত ধরে ইতিহাস। এই সাফল্যের মূল কারিগর তো আপনি
কিরন: ফুটবলকে ভালোবাসি, ফুটবলের প্রতি ডেডিকেশন আছে। আমি সব সময় শতভাগ দিয়ে কাজ করি, যেন সাকসেস হই। এই সাফল্য কিন্তু একদিনে আসেনি। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও কঠোর পরিশ্রমের ফসল এটি। আমি কী করেছি, না করেছি তা সবাই জানে। আসলে আমার জীবনটাই ওদের জন্য। মেয়েরা ভালো থাকা মানে আমার ভালো থাকা।
সমকাল: কতটা প্রতিবন্ধকতা পাড়ি দিয়েছেন, কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছেন এই মেয়েদের পেছনে?
কিরন: ২০১৪ সালে আমার ক্যান্সার ধরা পড়ে। আমি তখন চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক হসপিটালে থাকি এবং আমার সার্জারি হয়। তার পরে কেমো দেয়। একটা মানুষকে যখন কেমো দেওয়া হয়, সেই মানুষটি উঠে দাঁড়াতে পারে না। বিভিন্ন রকমের সাইড এফেক্ট থাকে। ওই পরিস্থিতিতে ডাক্তাররা কখনোই রোগীকে হাসপাতাল থেকে ছাড়েন না। তো আমার আগে থেকে জাপানের সঙ্গে একটা মিটিং সেট করা ছিল। তখন তো আমি অসুস্থ ছিলাম না, হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যাই। তখন আমি ডাক্তারকে অনেক বোঝালাম, তবে ডাক্তার কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। ডাক্তারকে বললাম, এমন কিছু ব্যবস্থা নেন, যাতে আমি ট্রাভেলটা করতে পারি। আমাকে বুস্টারিং ইনজেকশন দিলেন, যেটাতে অনেক পেইন হয়। আমি সেটাও নিলাম। তিনি আমার জন্য একটা প্রেসক্রিপশন তৈরি করলেন, আমার যদি রাস্তায় কোনো সমস্যা হয়, তখন যে ডাক্তারই থাকেন, তিনি সেই প্রেসক্রিপশনটা দেখে বুঝতে পারবেন, আমাকে কী ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। কেমো দিয়ে পরদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি জাপানে গেলাম। ক্যান্সার নিয়েও ওদের জন্য ছুটেছিলাম। এখন আপনারা জেএফএর যে ফান্ডটা দেখতে পান, জেএফএর যে টুর্নামেন্ট দেখছেন, সেটা আমি নিয়ে এসেছিলাম এবং একজন কোচও নিয়ে এসেছিলাম। আমাদের পথচলা তো অনেক কঠিন ছিল; এটা তো অনেকেই জানেন না বা জানলেও স্বীকার করেন না।
সমকাল: যত দূর জানি, আপনি নিজ থেকে অনেক অর্থ দিয়েছেন এবং অর্থের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছেন
কিরন: আমরা ট্যালেন্ট হান্ট করে, তিন মাস ক্যাম্প করে যদি ওদের ছেড়ে দেই, তাহলে তো যেভাবে ওদের তৈরি করতে চেয়েছি, সেটা সম্ভব হবে না। তখন আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বললাম, আমাদের দীর্ঘমেয়াদি ট্রেনিং করা দরকার। কিন্তু আমাদের কাছে টাকা ছিল না। তখন প্রেসিডেন্ট বললেন, অসুবিধা নেই; শুরু করো, একটা ব্যবস্থা হবে। শুরু করলাম এবং দেখা গেল ২০১৫, ২০১৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই ক্যাম্প করতে হয়েছে প্রেসিডেন্ট আর আমার টাকা দিয়ে। প্রতিদিন খাবার খরচই আসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা। তাদের মেডিকেল খরচ, স্পোর্টস গিয়ার, তারপরে ওদের পড়াশোনার জন্য ৪-৫টা প্রাইভেট টিউটর ছিল। এই খরচটা ৩-৪ বছর ধরে আমাদের বহন করতে হয়েছিল। যখন এই মেয়েদের ক্যাম্পে নিয়ে আসি, তখন প্রেসিডেন্ট আমাকে একদিন বললেন, কিরন ওদের বেতন দিতে হবে, তা না হলে কাজ করতে পারবা না। আমি তখন বললাম, কোথা থেকে দেব, টাকা তো নেই। প্রথম কিন্তু মেয়েদের বেতন কাজী সালাউদ্দিনের কোম্পানি থেকে দেয়া হয়।
সমকাল: স্পন্সর নিয়ে আপনার একটা হাহাকার ছিল। সাফ জেতার পর প্রেক্ষাপটটা কি পরিবর্তন হবে?
কিরন
: আমি বিশ্বাস করি, স্পন্সররা এগিয়ে আসবেন। আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে সাড়া পাচ্ছি। তবে অনেক সময় দেখা যায়, শুধু বলার জন্য বলে, পরবর্তী সময়ে আসে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ওভাবে বলতে পারছি না।
সমকাল: সাফল্য ধরে রাখতে হলে তো প্রয়োজন শক্তিশালী ঘরোয়া লিগ
কিরন: পেশাদার লিগের ক্লাবগুলো যদি অংশগ্রহণ করে, তখনই একটা শক্তিশালী লিগ হবে। সেটা ছাড়া তো শক্তিশালী লিগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ বছর অনেক ক্লাব আসছে, যারা আর্থিকভাবে ভালো এবং ভালো টিম করার পক্ষে। এ রকম ক্লাবগুলোকেও আমরা উৎসাহ দেব, তারা আসুক।
সমকাল: সামনে তো জাতীয় দলের খেলা নেই, সিনিয়র মেয়েদের কী হবে?
কিরন: ট্রেনিং অব্যাহত থাকবে। ফিফা উইন্ডোতে যতগুলো সম্ভব, প্রীতি ম্যাচ খেলব। আর ম্যাচগুলো সহজ প্রতিপক্ষ নয়- জাপান, কোরিয়া, চীন, সিঙ্গাপুরের মতো বড় বড় দলের বিপক্ষে খেলব।
সমকাল: মহিলা ফুটবল মূলত বাফুফেকেন্দ্রিক। সাফ জেতায় তৃণমূলে এর প্রভাব কতটা পড়বে?
কিরন: বাড়বে তো অবশ্যই। আমাদের কিন্তু তৃণমূলে অনেক মেয়ে আছে। এক নম্বর আমাদের বাফুফে ভবনে থাকার জায়গা কম। দুই নম্বর আমাদের তো অত ফান্ড নেই, আমরা হাজার হাজার মেয়েদের রাখব। আমাদের যতটুকু সামর্থ্য আছে, তার ভেতরে যতটা সম্ভব করার চেষ্টা করি। আসলে বাংলাদেশে আমরা যেভাবে ফুটবল চালায়, পৃথিবীতে কেউ এভাবে এত কষ্ট করে ফুটবল চালায় না।
সমকাল: সংবর্ধনার দিনে বিমানবন্দরে আপনার চোখে পানি দেখেছিলাম
কিরন: আপনি যেটা বলেছেন, সেটা ঠিকই বলেছেন। আমি সে দিন অনেক বেশি আবেগতাড়িত হয়ে গিয়েছিলাম। নেপালেই আমি মেয়েদের জানিয়েছিলাম, তোমাদের জন্য বড় সংবর্ধনা হচ্ছে। দেশে ফিরে বাফুফে এবং মন্ত্রী সাহেব যে সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেছিলেন, মন ভরে গিয়েছে। স্বতঃস্ম্ফূর্ত মানুষের এত ভালোবাসা ছিল, আমার কষ্টগুলো তখন আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
সমকাল: আপনি শুধু উইমেন্স কমিটির চেয়ারম্যানই নন, মেয়েদের একজন অভিভাবক
কিরন: দেখেন, আমি মেয়েদের ফুটবল নিয়ে এতদিন কাজ করেছি, এখন অনেক বড় একটা সফলতা এসেছে। আমি যখন এই মেয়েদের নিয়ে এসেছিলাম, ওরা তখন অনেক ছোট, ১০-১২ বছর বয়স। আমি নিজের বাচ্চার মতো করেই ওদের দেখি। আমি সব সময় ওদের নিয়ে বিভিন্নভাবে কাউন্সেলিং করি। ওদের বিভিন্ন রকম স্বপ্ন দেখাই; তোমরা বড় হও, তোমরা গরিব থাকবে না। তোমাদের বাবা-মাকে সাপোর্ট করতে হবে। ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়তে হবে। মাথার মধ্যে ফুটবল ছাড়া অন্য কিছু থাকবে না। যখনই তোমরা ফ্রি থাকো, তখন তোমরা ইউরো, ইংলিশ লিগ- এগুলো দেখবা, যাতে করে নিজেদের তৈরি করতে পার। সানজিদা ইংলিশ লিগ দেখেই কিন্তু ছাদ খোলা বাসের ধারণা নিয়েছে। আমি ওদের বড় করে দেখতে চাই। ওরা গরিব থাকবে না। এটাই আমার সাকসেস, আমি ওদের একটা বেটার জায়গায় দেখতে চাই।'