উনিশ শতকের সেই ত্রিশের দশক- জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে খেলতে আসা থেকে শুরু। তার পর তো বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্ব রাজনীতিতে মুসোলিনি-হিটলারের দাপট- সবই দেখেছে বিশ্বকাপ ফুটবল। সাক্ষী থেকেছে ফুটবলের কিংবদন্তি পুসকাস, ক্রুয়েফ, পেলে, ম্যারাডোনা, প্লাতিনি, জিদান হয়ে বড় রোনালদোর পায়ে এই খেলাটার শৈল্পিক রূপ পাওয়ার। আর এসব নিয়েই বিশ্বকাপের গত শতাব্দীর কিছু চাপা পড়ে থাকা ইতিহাস তুলে আনার চেষ্টা করেছেন সঞ্জয় সাহা পিয়াল

সুইডেন (১৯৫৮)

হোয়াও কার্ভালেস- ভদ্রলোকের নামটি চিনে রাখুন। পেশায় মনোবিদ। হ্যাঁ, সেই উনিশ শতকের ষাটের দশকেই ব্রাজিল দল মনোবিদ সঙ্গে নিয়ে সুইডেন বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল। তাঁর কাজের ধরনও ছিল অদ্ভুত। ফুটবলারদের টিম মিটিংয়ে কোনো অভয় বাণী বা ফুটবলারদের একে একে ডেকে এনে তাঁদের কথা শোনা বা উপদেশ দেওয়ার সনাতনী পদ্ধতিতে তিনি কাজ করতেন না। তিনি প্রত্যেক ফুটবলারকে ডেকে একটি করে ছবি আঁকতে বলেছিলেন, মানুষের ছবি। কে কেমন মানুষ আঁকছে দেখে, সেই ফুটবলারের মানসিক অবস্থার ছবি এঁকেছিলেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস ছিল ফরোয়ার্ডের ছবিতে থাকবে আগ্রাসী মনোভাব, আর ডিফেন্ডারদের ছবিতে থাকবে সতর্কতার ছাপ! সবার আঁকা ছবি দেখে তখনকার ব্রাজিলের কোচ ভিসেন্তে ফিওলার কাছে যে মূল্যায়নপত্র পাঠান ওই মনোবিদ, তাতে দু'জন সম্পর্কে দুটি মন্তব্য ছিল ওই মনোবিদের। প্রথমজন 'বড্ড ছোট, শিশুসুলভ', দ্বিতীয়জন 'দলে নিলে বিপর্যয় হবে'। ভাগ্যিস সেদিন সেই মনোবিদের পরামর্শ শোনেননি কোচ। জেনে রাখুন, দু'জনের নাম যথাক্রমে পেলে ও গারিঞ্চা। একজনের ১৭, অন্যজনের মাত্র ২১।

ওই বিশ্বকাপে এই দু'জনের পায়ের জাদুতেই ব্রাজিল প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের স্বর্ণের পরীর ট্রফিটি জিততে পেরেছিল। ওই বিশ্বকাপেই প্রথমবারের মতো ৪-২-৪ ছক এনেছিল ব্রাজিল। কী দুর্দান্ত সব খেলোয়াড় সেই দলে- নিলতন সানতোস, দিদি, ভাভা, জাগালো, জিতো, গারিঞ্চা এবং অবশ্যই পেলে। সেবারের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড দল কোনো রকমে একটি দল সাজাতে পেরেছিল। ইংল্যান্ড দলের কাছে প্রথম পর্বে শক্তিশালী ব্রাজিল গোলশূন্য ড্র করে। তখনও অভিষেক হয়নি পেলের। কোচ ফিওলা হয়তো মনোবিদের কথায় কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে পরের ম্যাচেই শক্তিশালী সোভিয়েত রাশিয়ার বিপক্ষে পেলে, গারিঞ্চাকে নামান কোচ। ১৫ জুন, ১৯৫৮ বিশ্বকাপে অভিষেক হয় কালো মানিক পেলের। তবে সেই ম্যাচে পেলে ও গারিঞ্চা দু'জনেরই দুটি শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে। ১৭ বছরের ওই কৃষ্ণ বালকের প্রতিভা পরিস্ম্ফুটিত হয় কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলসের বিপক্ষে। ওয়েলসের গোলরক্ষক কেলসি যখন ৭৬ মিনিট পর্যন্ত দুর্গ আগলে রেখেছেন, তখনই দিদিও হেড থেকে বল বুক দিয়ে রিসিভ করে ছোট্ট ফ্লিক, ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে ৮ গজ দূর থেকে পেলের শট। বিশ্বকাপে তাঁর প্রথম গোল এবং সেই গোলই ব্রাজিলকে নিয়ে যায় সেমিফাইনালে। পেলে আজও স্বীকার করেন, জীবনের অন্যতম সেরা তো বটেই, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওয়েলসের বিপক্ষে তাঁর ওই গোলটি। এর পর ব্রাজিল- ফ্রান্স সেমিফাইনাল। স্কিলের চূড়ান্ত প্রদর্শন। একদিকে কোপা, ফঁতে, পিয়ানতোনি। অন্যদিকে পেলে, দিদি, ভাভা, গারিঞ্চা। শেষ পর্যন্ত ৫-২ ব্যবধানে ম্যাচ জিতেছিল ব্রাজিল। দ্বিতীয়ার্ধে পেলের হ্যাটট্রিক। বিশ্বকাপে কম বয়সী হিসেবে হ্যাটট্রিকের সেই রেকর্ড আজও অক্ষত পেলের কাছে। ফাইনালে তারা স্বাগতিক সুইডেনের মুখোমুখি হয়। পশ্চিম জার্মানিকে সেমিতে হারিয়ে তখন টগবগ করছে সিমনসনদের সুইডেন দল। তবে ফাইনালে আর কোনো ছাড় দিতে রাজি ছিল না ব্রাজিল। ফিওলার একাদশে প্রথমবারে মতো জায়গা হলো জালমা সানতোসের। বিরাট চেহারার এই ডিফেন্ডারের কাজই ছিল সুইডেনের সব আক্রমণ প্রতিহত করা। আর পেলের কাজ বেঁধে রাখা হয়েছিল প্রতিপক্ষের ডিবক্সের সামনে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। ফাইনালেও পেলের দুই গোল।

প্রথমটি নিলতনের ক্রস বুক থেকে উরুতে নিয়ে গুস্তাভসনের মাথার ওপর দিয়ে তুলে পড়তি বলে ভলি। শেষে জাগাওকে ব্যাকহিল করে দুই ডিফেন্ডারের মাঝে পৌঁছে হেড। ফাইনালের রেজাল্ট ব্রাজিল ৫, সুইডেন ২।

ব্রাজিলকে সেদিন প্রথম বিশ্বকাপ এনে দেওয়ার আনন্দে শিশুর মতো কেঁদেছিলেন পেলে। বাকি বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, আমি এসে গেছি।