- খেলা
- ১৯৭০ মেক্সিকো: যে বিশ্বকাপ অমর করেছে পেলেকে
১৯৭০ মেক্সিকো: যে বিশ্বকাপ অমর করেছে পেলেকে

চারটি বিশ্বকাপ খেলেছেন পেলে। তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তবে পেলেকে অমর করেছে ১৯৭০ আসর। ছবি: ফাইল
আগের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে বিদায়ের পর ব্রাজিল দলকে নিয়ে সমালেচনার ঝড় ওঠে দেশটিতে। হোয়াও সালদানি ছিলেন ফুটবল লেখিয়ে ব্রাজিলের দাপুটে সাংবাদিক। তিনি দল নিয়ে এতো তীব্র আক্রমনাত্মক লেখা লিখতে শুরু করেন যে, ব্রাজিলের ফুটবল সংস্থার কর্তারা তার হাতেই তুলে দিয়েছিলেন জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব।
সালদানিয়া নতুন করে দল গোছাতে গিয়ে সান্তোসের ফুটবলারদের প্রাধান্য দেন। কিন্তু তার সমস্যা ছিল বদ মেজাজ। পেলেও সে কথা লিখেছিলেন তার আত্মজীনিতে। ‘যখনই দেখতাম মাঠের কাউকে ঘিরে জটলা, নিশ্চিত হয়ে যেতাম, আবার কাউকে বকছে সালদানিয়া।’
ক্রীড়া সাংবাদিক সালাদানিয়া এতোটাই রাগী আর কঠোর ছিলেন যে বিশ্বকাপের আগে পেলেকেই বাদ দিয়ে দেন। ক্ষোভে ফেটে পড়ে ব্রাজিল, এক সমর্থক এতোটাই চটেছিলেন যে, রিভালবার নিয়ে হাজির হয়েছিলেন সালদানিয়ার বাড়িতে। তারপর অবশ্য আর ঝুঁকি নেননি ওই কোচ। পেলেকে নিয়েই হ্যাটট্রিক শিরোপার মিশনে নেমে পরেন। ব্রাজিল দলে তখন পেলের সহচর ছিলেন তোস্তাও। এক দুর্ঘটনায় তার চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।
আমেরিকা থেকে অস্ত্রোপচার করে কোন রকমে দৃষ্টিশক্তি ফেরাতে পেরেছিলেন। তিনিই মেক্সিকো বিশ্বকাপে খেলতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু পেলের অনুরোধে দলে ফিরেছিলেন। সেই সঙ্গে একঝাক তরুন ফুটবলার উঠে আসে ব্রাজিল দলে- জেরসন আর জোয়ারজিনিও তাদেরই অন্যতম।
সেবার লাতিন আর ইউরোপের বাইরে প্রথম কোন দেশ উত্তর আমেরিকা থেকে বিশ্বকাপ আয়োজরেন সুযোগ পেয়েছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭ হাজার ফুট উচ্চতা, অসম্ভব গরম, সঙ্গে ইউরোপিয় দর্শকদের টেলিভিশনে খেলা দেখানোর জন্য দুপুরের প্রচন্ড গরমে বারোটায় খেলা। বলা হয় মেক্সিকো সেবার ঘুষ দিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজকের দায়িত্ব পেয়েছিল। কোন কোন ফিফা কর্তার টোকিও কংগ্রেসে যাতায়াতের ভাড়া, থাকা-খাওয়া, এমনকি হাতখরচও নাকি পকেটে গুজে দিয়েছিল তার।
যাই হোক, মেক্সিকোর এই বৈরি আবহাওয়ায় কাল হয়ে দাঁড়ায় ইউরোপের দল ইংল্যান্ডের জন্য। প্রথম ম্যাচেই তারা হেরে যায় ব্রাজিলের কাছে। তবে সেই ম্যাচটি স্মরণীয় হয়ে আছে পেলের একটি হেড থেকে ইংরেজ গোলরক্ষক গর্ডন ব্যাঙ্কসের একটি গোল বাঁচানোর জন্য। বাঁ দিয়ে পড়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ডান দিকে উঠে এসে পেলের হেড বার পোস্টের ওপর দিয়ে পাঠিয়ে দেন ব্যাঙ্কস। পেলে তার আত্মজীবনীতে ওই সেভটির কথা লিখেছিলেন বিশেষভাবে। কোয়ার্টার ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে গিয়েছিল ইংল্যান্ড সেদিনই, ব্যাঙ্কস সেদিন বিয়ার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
সেমিফাইনালে দেখা হয়ে যায় দুই লাতিনের সঙ্গে। উরুগুয়ে বনাম ব্রাজিল। তোস্তাও-এর দুর্দান্ত পাস থেকে ব্রাজিল প্রথমার্ধে সমতায় আসে। দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে ধরা পড়ে সাম্বার ছন্দ। জোয়ারজিনিও আর রিভেলিনোর গায়ে ৩-১, ফাইনালে ব্রাজিল। প্রতিপক্ষ? ইতালি। সেমিতে পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে তাদের একশ’ কুড়ি মিনিটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। শেষ পর্যন্ত বেকেনবাওয়ারের শেষ বিশ্বকাপে ইতালি ৪-৩ এ জয়ী।
ফিফা আগেই বলে দিয়েছিল যে তিনবার যারা বিশ্বকাপ জিতবে জুলেরিমে চিরতরে চলে যাবে তাদের কাছে। দু’বার করে সেই ট্রফি জেতার পর ব্রাজিল আর ইতালির সামনে ফাইনালের একমাত্র লক্ষ হয়ে দাঁড়ায় কারা দেশে নিয়ে যাবে ওই সোনারপরী ট্রফিটি। পেলে না ফাচেত্তি? আর ওই ফাইনালেই পেলে নিজেকে নিয়ে যান এমন উচ্চতায় যেখানে কেউ আর কখনো প্রশ্ন করতে পারেননি।
ওই ফাইনালের পর পেলে ফুটবল বিশ্বে এমন একটি জায়গা করে নেন যেখানে আর কাউকে কখনো বসানো যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ফাইনালে পেলে নিজে গোল করেন একটি, দুটি গোল তৈরি করে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে অধিনায়ক কালোর্স আলবের্তোর জন্য চতুর্থ গোলের বল সাজিয়ে দেওয়া দেখলে, ইউটিউবে এখনো সেই ম্যাচের হাইলাইটস দেখে বিস্মিত হতে হয়। তোস্তাও, রিভেলিনো, জেয়ারজিনিও, জেরসন আর পেলের কী দুর্দন্ত দল ছিল ব্রাজিলের।
অনেকে বলেন, ব্রাজিল ফুটবলে সর্বকালের সেরা দলটি ছিল ওই সত্তর দশকেই। আর তখন থেকেই বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলকে নিয়ে প্রচণ্ড এক ভালোবাসা জন্মেছে গোটা বিশ্বজুড়ে। সেই বিশ্বস্ততা নিয়ে আজও অটুট অনেকেরই কাছে। পুসকাসের হাঙ্গেরি বা ক্রুয়েফের হল্যান্ড চুড়ান্ত ফেভারিট হয়েও বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। আর পেলের ব্রাজিল তিন তিন বার বিশ্বকাপ জিতে চিরতরের জন্য ওই জুলেরিমে ট্রফি নিয়ে যায় নিজেদের দেশে। যদিও পরে সেই ট্রফি চুরি হয়ে গিয়েছিল। পুলিশ গোয়েন্দা মিলে হন্যে হয়েও সেটা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, চোর সেটা স্যাকারের কাছে নিয়ে গিয়ে সোনা গলিয়ে হাপিশ করে দিয়েছে!
মন্তব্য করুন