- খেলা
- 'জোগো বোনিতো'তে মুগ্ধ সারাবিশ্ব
'জোগো বোনিতো'তে মুগ্ধ সারাবিশ্ব

ছবি: টুইটার
প্রায় আট বছর আগে সেভ করে রাখা দুঙ্গার পুরোনো নম্বরটি নাকি বন্ধ। দোহার কিউএসিসির মিডিয়া সেন্টারে গতকাল দুঙ্গার নতুন নম্বরটি হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন ষাটোর্ধ্ব এক ব্রাজিলীয় সাংবাদিক। নম্বরটি পেলে তিনি দুঙ্গাকে জিজ্ঞাসা করতেন, আপনি বলেছিলেন, যে কোনো মূল্যে আমার ট্রফি চাই, সুন্দর ফুটবল চাই না। আট বছর পর রিচার্লিসনের গোলটি দেখে আপনি কি সেই বক্তব্য তুলে নেবেন?
২০১০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত দুঙ্গার ওই দর্শনই নাকি ব্রাজিল ফুটবলের সৌন্দর্য নষ্ট করেছিল। কাতারে আসা ব্রাজিলীয় সাংবাদিকদের আড্ডায় অন্তত এখন সেই আলোচনা তুঙ্গে। সার্বিয়ার বিপক্ষে নেইমারদের আগের দিনের ম্যাচ দেখার পর এখানে আসা প্রতিটি ব্রাজিলীয়র মধ্যে যেন স্বস্তির হাওয়া। অবশেষে সাম্বার লাতিন লাবণ্যে ফিরেছে ব্রাজিলের 'জোগো বোনিতো'। খুশি মনে মাঠে নামো, গোল করো, অ্যাটাক করো, সৃষ্টিশীলতা দেখাও- এটাই তো বিশ্বফুটবলে ব্রাজিলের পরিচয়। সেখান থেকে সরে এসে গেল কুড়ি বছরে তো কিছুই অর্জন হয়নি; বরং ইউরোপিয়ানদের যান্ত্রিক ফুটবল আমদানি করতে গিয়ে ওই সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়েছে। তাই সার্বিয়ার বিপক্ষে নেইমারের ড্রিবলিং, ক্যাসিমিরোর লং পাস আর রিচার্লিসনের সিজার কিক দেখে যারপরনাই খুশি ব্রাজিলিয়ানরা। তারা এই সুন্দর ফুটবলেরই পূজারি। গোল তো অনেকেই করেন, অনেকভাবেই করেন, কিন্তু তাতে সব সময় নান্দনিকতা থাকে কি?
প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেলেকাওদের গর্ব তো ওই 'জোগো বোনিতা'। পেলের মুখের এই পর্তুগিজ শব্দটিই, যা এখন ফুটবল ডিকশনারিতে ব্রাজিলের পরিচিতি তুলে ধরে। জোগো শব্দের অর্থ খেলা আর বোনিতো অর্থ সুন্দর। ফুটবল পায়ে শুধু সামনে ছুটে চলাই নয়, ফুটবল হৃদয়ে ধারণ করে তাকে ভালোবাসা; ফুটবল নিয়ে শৈল্পিকতা, ফুটবল নিয়ে ড্রিবলিং, স্কিলিং- এসবই আমব্রাজিলিয়ানের রক্তে মেশা। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকেই বিশ্বমঞ্চে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে এই সুন্দর ফুটবল। যদিও ১৯৫০ বিশ্বকাপে মারকানা ফাইনালের ট্র্যাজেডির পর সেই দৃষ্টিনন্দন ফুটবল থেকে ফিরে আসার পথ ধরেছিল তারা। ১৯৫৮ সালে পেলে ফিরে আসায় ফের সেই জোগো বোনিতো। একটি গল্প আছে পেলের মুখে এই জোগো বোনিতো শব্দটি নিয়ে। সেবার ফাইনালে সুইডেনের সঙ্গে ম্যাচের আগে ব্রাজিল দলের সঙ্গে থাকা মনোবিদ হোয়াও কার্ভালেস প্রত্যেক ফুটবলারকে ডেকে একটি করে ছবি আঁকতে বলেছিলেন, মানুষের ছবি। কে কেমন মানুষ আঁকছে দেখে সেই ফুটবলারের মানসিক অবস্থার ছবি এঁকেছিলেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, ফরোয়ার্ডদের ছবিতে থাকবে আগ্রাসী মনোভাব আর ডিফেন্ডারদের ছবিতে থাকবে সতর্কতার ছাপ! সবার আঁকা ছবিগুলো দেখে তখনকার ব্রাজিলের কোচ ভিসেন্তে ফিওলার কাছে যে মূল্যায়নপত্র পাঠান ওই মনোবিদ, তাতে দু'জন সম্পর্কে দুটি মন্তব্য ছিল তাঁর। প্রথমজন, 'বড্ড ছোট, শিশুসুলভ', দ্বিতীয়জন 'দলে নিলে বিপর্যয় হবে'। ভাগ্যিস সেদিন সেই মনোবিদের পরামর্শ শোনেননি কোচ। জেনে রাখুন, সেই দু'জনের নাম পেলে ও গারিঞ্চা। একজনের বয়স ১৭ আরেকজনের মাত্র ২১।
সেদিন পেলে আগ্রাসী মানুষের ছবি আঁকেননি আর গারিঞ্চা এঁকেছিলেন নেহাতই ঠান্ডা প্রকৃতির একটি মানুষের মুখ। আসলে এটাই ব্রাজিল। ঠান্ডা মাথায় ফুটবল পায়ে তাঁরা মাঠে ছবি আঁকতে পারেন। সেই থেকেই পেলে, সক্রেটিস, জিকো, রোমারিও, রোনালদিনহো, রোনাল্ডো হয়ে আজকের নেইমার। গতকাল যেন সেই বোনিতোর মধ্যেই নিজেকে তুলে ধরলেন রিচার্লিসন। প্রথম বিশ্বকাপ তাঁর, প্রথম ম্যাচ ও দুটি গোল। কাতারে আসা ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকরা এরই মধ্যে তাঁকে সুন্দরের পূজারি বলে ভবিতব্য করছেন।
কোচ তিতের হাতে নেইমার, রিচার্লিসন, রদ্রিগো, ভিনিসিয়ুসদের মধ্যেই অব্রাজিলিয়ান খেলা ছেড়ে তাঁরা তাঁদের আত্মিক ফুটবলেই প্রবেশ করেছেন।
মন্তব্য করুন