লাইফলাইন থেকে কেউ ফেরেন, কেউ ফেরেন না। মুমিনুল হক ফিরলেন বেশ ভালোভাবেই। অভিজ্ঞ ডুবুরির মতোই অতলান্ত থেকে তুলে আনলেন হূত আত্মবিশ্বাস। বছরের শুরুর সঙ্গে শেষের একটা বন্ধন জুড়েও দিলেন। জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডে ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ে অধিনায়কের পাশাপাশি ব্যাট হাতে অবদান রেখেছিলেন ঝলমলে ৮৮ রানের ইনিংস খেলে। আর মিরপুরে লাইফলাইনের ম্যাচে চার রান কম করলেও মুমিনুলের ক্যারিয়ার পেল প্রাণের ছোঁয়া। ঢাকা টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে রান পান বা নাই পান, মুমিনুলের ব্যাটিং জীবন্ত। তাঁর ৮৪ রানে ভর করেই তো মিরপুরে বাংলাদেশের ২২৭ রানে যাওয়া।

টেস্ট ক্রিকেটে ৮৪ রান বড় কোনো ইনিংস না হলেও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মুমিনুলের জন্য অনেক কিছু। গতকাল রান না পেলে টেস্ট দল থেকেই বাদ পড়ার শঙ্কায় পড়ে যেতেন তিনি। টানা ৯ ইনিংসে দুই অঙ্কের রানে যেতে না পারা একজন ব্যাটারকে কত দিনই বা টেনে বেড়াতে পারত দল! বাংলাদেশের মতো পেছনের র‌্যাঙ্কের দলের জন্য ছন্দহীন ব্যাটারকে দীর্ঘ সময় টেনে বেড়ানোও বিলাসিতা। তাই প্রশ্ন ওঠার আগেই বাঁহাতি এ ব্যাটারের গা-ঝাড়া দেওয়া।

নিউজিল্যান্ডে রূপকথার মতো একটা সিরিজ শেষ করে নায়ক হয়ে ওঠা মুমিনুলকে মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখতে বেশি দিন লাগেনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় দলের হোয়াইটওয়াশ, ঘরের মাঠে শ্রীঙ্কার কাছে টেস্ট সিরিজে হার এবং ধারাবাহিক রান না পাওয়ায় নেতৃত্ব কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর কাছ থেকে। সে সময় বিসিবি কর্তাদের ভাষ্য ছিল- নেতৃত্বের ভারমুক্ত করে ব্যাটিং সত্তাকে জাগিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায় থেকে সে পরিবর্তন। তখন তাঁরা বুঝতে পারেননি, নেতৃত্বের ভার বহন করার কোনো এক ফাঁকে আত্মবিশ্বাসটাও হারান তিনি। যেটা ধরা পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে খেললেও দ্বিতীয় টেস্টে যেতে হয় রিজার্ভ বেঞ্চে। ওই সিরিজে সবার কাছেই একটা বার্তা গেছে সাকিবের দলে বোঝা হয়ে থাকতে পারবে না কেউ, তা অতীত রেকর্ড যত সমৃদ্ধই হোক।

উইন্ডিজ সফরের পর ভারত সিরিজ দিয়েই টেস্টে ফেরা বাংলাদেশের। যে মিশন শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। মুমিনুলের পয়োমন্ত ভেন্যু হিসেবেই যেটা সর্বজন স্বীকৃত। পরিসংখ্যানও হোম ভেন্যুতে রাজাসন দেয় ৩১ বছর বয়সী এ ব্যাটারকে। কক্সবাজারের এ ক্রিকেটারের ১১ টেস্ট সেঞ্চুরির ৭টিই চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে করা। প্রিয় সে ভেন্যুতেই ভারতের বিপক্ষে খেলা হয়নি তাঁর। চট্টগ্রামে ইয়াসির আলি রাব্বি ব্যর্থ হওয়ায় ভাগ্যের শিকে ছেড়ে মুমিনুলের। যদিও গতকাল সকালে একাদশ ঘোষণার পর বিস্ময়ের সঙ্গে সমালোচনা হতে থাকে বাঁহাতি এ ব্যাটারকে দলে রাখা নিয়ে। প্রশ্ন ওঠে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, জাতীয় লিগ, বাংলাদেশ 'এ' দলে কোনো কিছু করতে না পারা একজনকে টেস্ট সুযোগ দেওয়া নিয়ে। মাঠে থাকার কারণে মুমিনুল এসবের কিছু জানতে না পারলেও ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন, পেছনে অনেক কথাই হচ্ছে এবং এটাই শেষ সুযোগ তাঁর। নিজের সঙ্গে লড়াই করে, চাপমুক্ত হয়ে আশি ছোঁয়া একটি ইনিংস খেলে ভালোভাবে ফিরে আসার বার্তাও দিলেন তাই।

ঢাকা টেস্টের প্রথম ইনিংসে মুমিনুল ছাড়া পঞ্চাশ ছোঁয়া ইনিংস নেই দ্বিতীয় কোনো ব্যাটারের। চট্টগ্রাম টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে সেঞ্চুরি করে ওপেনার জাকির হাসান মরা ম্যাচে যেভাবে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন, মিরপুরে ধারাবাহিকতাটা রাখতে পারেননি। জাকির গোল্ডেন ডাক হতে গিয়েও বেঁচে গেছেন মোহাম্মদ সিরাজ ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ ফেলায়। শূন্যতে জীবন পেয়েও ইনিংস বড় করা হয়নি দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নামা ২৪ বছর বয়সী ওপেনারের। নাজমুল হোসেন শান্ত ও জাকির হাসান জুটি প্রথম ঘণ্টা সংগ্রাম করে টিকে থাকলেও পানি পানের বিরতির পরই ঘটে বিপত্তি। ১৫তম ওভারে উমেশ যাদবের পঞ্চম বলটি অনুমানের চেয়ে বাড়তি বাউন্স করায় কাট করতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ হন জাকির। গ্লাভসে লেগে স্লিপ ফিল্ডার লোকেশ রাহুলের হাতে জমা পড়ে বল। ঠিক পরের ওভারেই শান্ত আউট। ৩৯ রানে দুই ওপেনারকে হারালেও মধ্যাহ্ন বিরতি পর্যন্ত নিরাপদ ছিল পরের জুটি। আশা করা হচ্ছিল, সতেজ উইকেটে মুমিনুল ও সাকিব বড় রান করে দলীয় স্কোর উঁচুতে পৌঁছে দেবেন। মধ্যাহ্ন বিরতি থেকে ফিরে সে স্বপ্ন বিসর্জন দেন সাকিব উইকেট ছুড়ে। উমেশ যাদবের প্রথম বলটি (২৮.১) তুলে মারতে গিয়ে ক্যাচ দেন চেতেশ্বর পুজারার হাতে। মুশফিকুর রহিম এবং লিটন দাস সেট হয়ে উইকেট হারান। সময়ের সেরা ব্যাটার লিটন দাস ঝলমলে শুরুর পর খেয়ালি শটে উইকেট ছুড়ে দেওয়ায় লুকাতে পারেননি মুমিনুল। এভাবেই উইকেট পড়ার মিছিল বড় হতে থাকে এবং ২২৭ রানে শেষ হয়।

বাংলাদেশকে কম রানে বেঁধে ফেলা ভারত গতকাল ব্যাট করেছে ৮ ওভার। কোনো উইকেট না হারিয়ে ১৯ রানে দিনের খেলা শেষ করে স্বস্তিতে। যদিও সাকিবের আবেদনে রাহুলকে এলবিডব্লিউ দিয়েছিলেন আম্পায়ার শরফৌদ্দোলা ইবনে সৈকত। রিভিউ নিয়ে বেঁচে গেছেন ভারত অধিনায়ক। এই জীবন কতক্ষণ ধরে রাখতে পারেন, সেটাই দেখার। কারণ গতকাল তৃতীয় সেশন থেকেই স্পিনাররা যেভাবে বলে টার্ন পাচ্ছিলেন, তাতে করে আজ মুড়িমুড়কির মতো উইকেট পড়তে দেখলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। যে উইকেট স্বভাবগতভাবে ট্রিপিক্যাল টার্নিং, তাতে ব্যাটারদের রানের কাব্য, মহাকাব্য লেখার সুযোগ কোথায়।